কুণাল ঘোষ: শুরুতেই মূল প্রশ্নটা সরাসরি রাখছি। বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ নেতাজির (Subhas Chandra Bose) মূর্তি বসানোর রাজনীতি করে দেশনায়ককে ঘিরে থাকা আবেগটি ব্যবহার করতে চাইছেন, সেটা তাঁদের বিষয়। কিন্তু হাবিবুর রহমান, আবিদ হাসানদের বাদ দিয়ে শুধু নেতাজির মূর্তি আর ভাষণবাজি করে কি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব?
যে নেতাজির মূল বিশ্বাসে ধর্মনিরপেক্ষতা, যাঁর কঠিন সংগ্রামের প্রতি পদক্ষেপে মুসলমান সহকর্মী সসম্মানে জড়িত, সেখানে উগ্র হিন্দুত্ব এবং কথায় কথায় ৭০ : ৩০ বা ৮০ : ২০ বলে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করা বিজেপি (BJP) নেতাদের মুখে নেতাজির কথা মানায় কি?
বস্তুত সমাজ ও দেশগঠনের বিষয়ে নেতাজির যা ভাবনা, বিশ্বাস, তার সঙ্গে বিজেপি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আসলে বিজেপির এখন কংগ্রেস এবং গান্ধী ঘরানা কেন্দ্রিক প্রচলিত ইতিহাসকে মুছতে নেতাজির মতো একজন রোমাঞ্চকর অভিযানের দেশনায়কের মুখ চাই।
সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্কে যে মুখটি তারা একদিকে কংগ্রেসি ঘরানা মুছতে এবং একই সঙ্গে বাংলা-সহ দেশের একটি বড় অংশের মনকে স্পর্শ করতে কার্যকর হবে। তাই বাংলার তৃণমূল সরকারের ট্যাবলো বাদ দিলেও নেতাজির মুখ তাদের দরকার। নেতাজির প্রতি সম্মান জানানোর আসল পদক্ষেপ নয়, মূর্তিজনিত নাটকীয়তা ও চমক দিয়ে বিভ্রান্ত করাটাই তাদের রণকৌশল।
আর এখানেই লোক দেখানো রাজনীতির সঙ্গে মূল বিশ্বাসের সংঘাত। নেতাজির সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায় দেখুন। মেজর আবিদ হাসান সাফরানি। নেতাজির ঐতিহাসিক জার্মানি থেকে জাপান সাবমেরিন যাত্রাপথের বিশ্বস্ত সেনাপতি ও সহযাত্রী। সবচেয়ে বড় কথা, ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটিও তাঁর তৈরি। তিনিই প্রথম এটি বলেন নেতাজিকে। হাবিবুর রহমান থেকে শাহনওয়াজ, মির্জা আনায়েত আলি বাগ, আব্দুল মজিদ প্রমুখ আজাদ হিন্দ ফৌজের (Azad Hind Fauj) অন্যতম শীর্ষশক্তি।
[আরও পড়ুন: মুখস্ত দেশ-বিদেশের রাজধানী, নেতাদের নাম, দক্ষ হরবোলা চন্দ্রকোনার ‘বিস্ময় বালক’]
শুধু তাই নয়, তাইহোকুর বিতর্কিত বিমান দুর্ঘটনার সেই যাত্রায় নেতাজি একমাত্র হাবিবুরকেই বেছে নিয়েছিলেন সহযাত্রী হিসাবে। হাবিবুর ফৌজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতাজি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রশাসন ও সেনাকর্মীদের দায়িত্বে। দেখুন মওলানা ওবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে। নানা নামে ছদ্ম পরিচয়ে নেতাজিকে দেশ থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। নেতাজিকে ‘মওলানা জিয়াউদ্দিন’ নামটিও তিনিই দিয়েছিলেন। এই সময়ে আমির খান খট্টকের নামও উল্লেখযোগ্য।
মহম্মদ হাবিবুর অনেকের মধ্যে একটি বড় নাম, যিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য বিপুল টাকা ও নিজের সর্বস্ব দিয়েছিলেন। কর্নেল নিজামউদ্দিন দীর্ঘদিন নেতাজির গাড়ি চালিয়েছিলেন, এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন। আবার সেনা হিসাবেও দক্ষ ছিলেন তিনি। মেজর জেনারেল জামান খান কিয়ানি। ফৌজ প্রথম তৈরির সময় সাধারণ কর্মীদের প্রধান। নেতাজি আসার পর ফৌজের প্রথম ডিভিশনটির প্রধান। নেতাজির শেষ বিমানযাত্রার পর তিনিই সেনাপ্রধান।
কর্নেল এহসান কাদির। আজাদ হিন্দ রেডিওর ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। পরে সামরিক সচিব হন আজাদ হিন্দ সরকারে। নেতাজির তৈরি সম্প্রীতি কাউন্সিলের প্রধান। ফৌজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার দায়িত্ব ছিল তাঁর। বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর খবর পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারান তিনি। ইয়ানেতুল্লাহ হাসান। আজাদ হিন্দ রেডিওর অন্যতম ডিরেক্টর। দেশাত্মবোধক নাটক বা চিত্রনাট্য লিখতেন যা ভারতে উৎসাহ তৈরি করার লক্ষ্যে সম্প্রচারিত হত। পরে নেতাজি তাঁকে প্রশিক্ষণ বিভাগের দায়িত্বে আনেন। মহিলা, অসামরিক নাগরিক, এমনকী শিশুদের নিয়েও কাজ করতেন তিনি।
শাহনওয়াজ তো ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলিতে আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে।
সৌকত আলি মালিক মণিপুরের মৈরাংয়ে প্রথম স্বাধীন জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা তুলেছিলেন। নেতাজি তাঁকে ফৌজের সেরা সামরিক সম্মান উপাধি দিয়েছিলেন। মেহবুব আমেদ ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকার আর ফৌজের সেতুবন্ধনকারী। আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানি। ব্যবসা করতেন। ফৌজকে তখনকার হিসাবে কোটি টাকার মূল্যের সামগ্রী ও টাকা দেন। পরে নিজে ফৌজের খাকি উর্দি পরতেন।
এই তালিকা এখানে শেষ নয়, বরং দীর্ঘ। আমার বক্তব্য, নেতাজি ছিলেন একজন প্রকৃত দেশনায়ক। সকলের নেতাজি। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান-সহ সব ধর্মকে সমানভাবে দেখে এসেছেন তিনি। সনাতনী হিন্দুত্বের প্রকৃত বার্তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এবং নিজের জীবনের কঠিনতম লড়াইগুলির সময়েও তিনি সবার উপরে মানুষকে জায়গা দিয়েছেন।
আজ বিজেপি যেভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে নেতাজির মুখ, মূর্তিকে সামনে আনছে, নেতাজির মূল ভাবনাটিকে স্বীকৃতি দেবে তো?
আবিদ হাসান, হাবিবুর রহমানদের ৭০ : ৩০ ইস্যুতে দূরে রেখে নেতাজির প্রতি প্রেম দেখাতে গেলে সেটা অলীক কুনাট্যর পর্যায়ে পড়বে না তো? বিজেপির ছোট- বড় নেতারা উগ্র হিন্দুত্বের উন্মাদনাকে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে ব্যবহার করবেন; কাল কা যোগী তৎকাল বিজেপি নেতাও বলবেন আমার ২০% দের ভোট লাগবে না; আবার এরাই বলবে আমরা নেতাজির মূর্তি বসিয়েছি, এর মধ্যে কোনও আন্তরিক সামঞ্জস্য থাকে কি? নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সব রহস্যের আজও সমাধান হয়নি। কত নিহত। কত নিখোঁজ।
আবিদ হাসানের তোলা ‘জয় হিন্দ’ আজ আমরা সগর্বে বলে চলেছি। ভারতকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করেছেন সব ধর্মের সবাই। আর এখন বিজেপি হিন্দুত্বের ভোট-ব্যবসা করতে গিয়ে, অ-কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদের তাস খেলতে গিয়ে বিভ্রান্তির ভুলভুলাইয়ায় দেশকে ঢোকাচ্ছে। হ্যাঁ, নেতাজির সম্মান চাই। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি চাই। অন্তর্ধান রহস্যের যথাযথ সমাধান চাই। ২৩ জানুয়ারি জাতীয় ছুটি চাই। তাঁর আদর্শের দেশ ও সমাজ চাই।
নেতাজির মূর্তি যেখানেই বসুক, ভাল লাগছে। কিন্তু শুধু মূর্তির রাজনীতি ভাল লাগছে না।
বিজেপি, নেতাজিকে যদি আপনারা পূর্ণ সম্মান দিতে চান, আবিদ হাসান, হাবিবুর রহমানদেরও প্রণাম করার মানসিকতা তৈরি করুন। এই ইতিহাসটাও কিন্তু বিকৃত করা যাবে না। মুছে দেওয়া যাবে না।