অবশেষে লোকসভার সদস্য পদ ফিরে পেলেন রাহুল গান্ধী। প্রশ্ন উঠছে, তাঁকে কেন্দ্রীয় শাসক দল হঠাৎ এতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে কেন? বিশ্লেষণে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সুপ্রিম কোর্ট রাহুল গান্ধীর সাজা স্থগিত করেছে। সাড়ে চার মাস পর তিনি লোকসভার সদস্য পদ ফেরত পেয়েছেন। তাতে বেজায় অখুশি বিজেপি। তারা ভেবেছিল, যেভাবে ধাপে ধাপে গুজরাটের আদালত তাদের ইচ্ছাপূরণ করে এসেছে, রাহুলের সাজা বহাল রেখেছে, সুপ্রিম কোর্টও তেমনই কিছু একটা করবে। কিন্তু তা না হওয়ায় এবার তারা নতুন করে তাল ঠুকতে শুরু করেছে। একটা নয়, দুটো নয়, ‘মোদি পদবি’ নিয়ে একডজন মামলা রাজ্যে রাজ্যে ঝুলে রয়েছে। একটা না একটায় তারা ফের রাহুলকে গেঁথে ফেলতে চেষ্টায় কসুর করবে না।
এটা কাল্পনিক কোনও শঙ্কা নয়। একেবারে সোজাসাপটা এ-কথা বলে দিয়েছেন বিজেপির আইটি সেল-এর অমিত মালব্য। শাসক দলের এই ‘সেল’ কাঁড়ি কাঁড়ি মিথ্যে উৎপাদনকারী এক কারখানা। ‘ফেক নিউজ’ কীভাবে তৈরি করে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হয়, কেমনভাবে তা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে হয়, এই সেল তা শুধু দেখায়নি, বেসাতিকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে পরিণত করেছে। এজন্য বহুবার ভর্ৎসিতও হয়েছে। কিন্তু তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। চোর যেমন ধর্মের কাহিনি শোনে না, শত ধুলেও কয়লার ময়লা যেমন যায় না, তেমনই বিজেপির এই ‘লাই ফ্যাক্টরি’ শোধরানোর নয়।
রাহুলের রাহুমুক্তির দিন-ই অমিত মালব্য টুইট করে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন। ইংরেজিতে লেখা টুইটের শিরোনাম হিন্দি ভাষায় খুবই প্রচলিত এক বাগ্ধারা, ‘বকরে কি অম্মা কব তক খের মনায়েগি?’ অর্থাৎ, পাঁঠার বলিদান অনিবার্য। কতদিন আর তা ঠেকিয়ে রাখা যাবে? বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যাও করেছেন বিস্তারে। বলেছেন, ‘এবার রাহুল না হয় বেঁচে গেলেন। কিন্তু কতকাল বাঁচবেন? এর আগেও তিনি নিজের কথা সুপ্রিম কোর্টের নামে চালিয়ে ভর্ৎসিত হয়েছেন। ওঁর বিরুদ্ধে আরও অনেকগুলি মামলা চলছে বিভিন্ন আদালতে। একটি ঠুকেছেন বীর সাভারকরের পরিবার। তাছাড়া ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় মা সোনিয়ার সঙ্গে তিনি জামিনে মুক্ত। এসব মামলার একটা না একটায় দোষী সাব্যস্ত হলে ফের ওঁর সদস্য পদ খারিজ নিশ্চিত।’
[আরও পড়ুন: মমতার গণ-আন্দোলন বনাম অনিলের মস্তিষ্ক, কলমে কুণাল ঘোষ]
এ-কথা লেখার পর জয়ললিতা ও লালুপ্রসাদের উদাহরণ টেনে অমিত মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘রাহুল খুব পাতলা এক বরফের আস্তরণের উপর দাঁড়িয়ে। যে কোনও সময় বরফের সেই চাদর ভেঙে যেতে পারে। আর তাহলেই সলিল সমাধি।’
এটা নিছকই ভয় দেখানো নয়। রাজনীতি আজকাল এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে প্রতিহিংসা-পরায়ণতা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার তো বটেই, যেসব প্রতিষ্ঠান ভারতীয় গণতন্ত্রর বিকাশে এতগুলো বছর ধাত্রীর ভূমিকা পালন করে এসেছে, যাদের উপর নির্ভর করে এ-দেশের গণতন্ত্র পল্লবিত, তাদেরও নির্লজ্জভাবে কবজা করে এই সরকার বিরোধিতার শিকড় সমূলে উপড়ে ফেলতে চাইছে। রাহুল গান্ধী আজ হয়তো বাঁচলেন। লোকসভার সদস্যপদ ফেরত পেলেন সুপ্রিম কোর্টের কৃপা বা বদান্যতায়। কিন্তু বারবার বাঁচতে পারবেন কি? রাষ্ট্র যদি উঠে-পড়ে লাগে?
তবে বিজেপির এই শত্রুতার মধ্য দিয়ে একটা কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার- রাহুলকে তারা ভয় পাচ্ছে। যাঁকে এত কাল তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছে, ‘বালখিল্য’ বলে বিবেচনা করেছে, মনে করেছে রাহুল থাকা মানে তাদের দিকে আরও বেশি সমর্থনের ঢল নামা, হঠাৎ তাঁকেই তারা প্রবল প্রতিপক্ষ হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র পর থেকে রাহুলকে তারা আর উপেক্ষা করতে পারছে না। বারবার আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য করে তুলেছে। এবং এর মধ্য দিয়ে বিরোধী নেতা হিসাবে তারা রাহুলকেই মান্যতা দিতে শুরু করেছে।
পশ্চিমবঙ্গে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম-ও ঠিক এইভাবে আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিহ্নিত করেছিল। এবং তাঁকে ‘জননেত্রী’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেছিল। জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা যত তাঁর সমালোচনা করেছেন, নেত্রী হিসাবে ততই মাথা উঁচু হয়েছে মমতার। শেষমেশ তাঁরাও বুঝেছিলেন, ১৯৯০-এর ১৬ আগস্ট হাজরা মোড়ে লালু আলমের ডান্ডা মমতার নয়, সিপিএমের মাথাতেই পড়েছিল!
রাহুলকে বিজেপি কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছে? সহজ উত্তর, তিনি বিজেপির বিপরীতে রাজনীতির নতুন ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করতে পেরেছেন বলে। লড়াইটাকে তিনি আদর্শগত করে তুলেছেন। যার ট্যাগলাইনও তাঁর দেওয়া, ‘ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান’। পাশাপাশি, নিজেকেও তিনি আমূল বদলে ফেলেছেন। জমিনি বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সাধারণের সুখ-দুঃখকে গুরুত্ব দিয়ে ঘৃণার রাজনীতির বিপদের দিক তুলে ধরে, শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে দাগ কাটতে চাইছেন। বিজেপির রাজনীতি কেন খারাপ ও অমঙ্গলের, তা বোঝাতে পারছেন। বহু মানুষ বুঝছেও। আজকের মণিপুর কিংবা হরিয়ানা যে, সেই ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতিরই ফল, সেই বোধোদয়ে দেরি হচ্ছে না।
একই সঙ্গে ২০১৯ থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচনকে ‘ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি’-তে পরিণত না করে তিনি ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদ বনাম গণতন্ত্রী বহুত্ববাদ’-এর রূপ দিতে চাইছেন। নিজেকে আড়ালে রেখে অন্যদের গুরুত্ব দিয়ে আগামী দিনের লড়াই করে তুলেছেন ‘মোদিত্ববাদ বনাম I. N. D. I. A.’-র। হিমাচল প্রদেশ ও কর্নাটকে কংগ্রেসের জয়ে ফেরা রাহুলের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। সাফল্য সংক্রমিত হয়েছে সংগঠনেও। ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে বিজেপির নার্ভাসনেস ও রাহুলকে ক্রমাগত আক্রমণ বুঝিয়ে দিচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব সত্ত্বেও তারা খুব একটা নিরাপদ বোধ করছে না।
নিরাপদ বোধ করছে না বলেই সুরাতের নিম্ন আদালতের রায়ের ২৬ ঘণ্টার মধ্যে রাহুলের লোকসভার সদস্য পদ খারিজ হয়। গুজরাটি কোর্টগুলো শাসকের ক্রূর হাসি চওড়া করে। রাহুলের বাসভবন কেড়ে নেওয়া হয়, অথচ গুলাম নবি আজাদ আজও ঠাঁইনাড়া হন না! অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা পাশে ঠেলে অনৈতিকভাবে একের পর এক বিল পাস করানো হয়। মণিপুর নিয়ে মুলতুবি প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়। মণিপুর নিয়ে বিবৃতি তো দূরের কথা, প্রথম দিন ছাড়া একবারের জন্যও প্রধানমন্ত্রীকে সংসদের কোনও কক্ষে দেখা যায়নি।
সংসদের অধিবেশন চলাকালীন সভাকক্ষে না গিয়ে এত দেশ-বিদেশ আর কোনও প্রধানমন্ত্রী চষেননি। বিদেশের পার্লামেন্টে ভাষণ দিয়ে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন, দেশের সংসদ তখন উপেক্ষিত। এটাই মোদি সরকারের ‘নতুন ভারত’! সুইডেনের ‘ভি. ডেম ইনস্টিটিউট’ এমনিই এমনিই ভারতকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে অভিহিত করেনি।
কাল অবশ্য প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলবেন। অন্তত খোলার কথা। কারণ, অনাস্থা প্রকাশ করা হয়েছে তাঁর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-পরিষদের বিরুদ্ধে। জবাব তাঁকেই দিতে হবে। মৌন ভাঙাতে এছাড়া দ্বিতীয় কোনও উপায় বিরোধীদের ছিল না। সেই বিচারে এই অবস্থা প্রধানমন্ত্রীরই অবদান। ‘মাদার অফ ডেমোক্রেসি’-র কাছে এর চেয়ে লজ্জার আর কীই-বা হতে পারে? মৌন থাকার কীসের এত জেদ, কী কারণ ও কোন যুক্তি, তা এখনও বোধগম্য নয়। মণিপুর নিয়ে সরব হলে, প্রথম দিনেই সংসদে নিজের ব্যথাতুর হৃদয় মেলে ধরলে প্রধানমন্ত্রীর উঁচু মাথা হেঁট হত না। বরং বিরোধী পালের হাওয়া কাড়া যেত। প্রধানমন্ত্রীর বোঝা উচিত, অশান্ত ও উত্তপ্ত মণিপুর তঁারই সাধের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিকে পরিহাসের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ফের অগ্নিগর্ভ করে তুলতে চলেছে। উৎসাহিত করছে সদা তৎপর চিনকে।
লোকসভার স্পিকার ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান সংসদীয় বিধির প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা নিজেদের ইচ্ছামতো করে চলেছেন। অনাস্থা প্রস্তাবের জবাব দিতে প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য না করানো হলে, তা অত্যাশ্চর্য হবে না। কিন্তু জবাবি ভাষণ দিতে মুখ খুললে সেটা প্রধানমন্ত্রীর পরাজয় বলেই গণ্য হবে। জেদ আঁকড়ে থাকতে না-পারার হার।
(মতামত ব্যক্তিগত)