জয়ন্ত ঘোষাল: ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে মাধবরাও সিন্ধিয়া কংগ্রেস দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তারপর নরসিমা রাওকে সরিয়ে সীতারাম কেশরী যখন দলের সভাপতি হন, তখন তিনি আবার ফিরে আসেন। যেদিন ফিরেছিলেন, সেদিন, নিয়ম মেনে দলীয় ফর্মে স্বাক্ষর করার জন্য অর্জুন সিংকে একটি কলম দেন। অর্জুন সিংয়ের কাছেই থেকে যায় সেই কলম। পাঁচ বছর পর যখন মাধবপুত্র জ্যোতিরাদিত্য বাবার আকস্মিক মৃত্যু পর কংগ্রেসে যোগ দেন। সেদিন আবার দলীয় ফর্ম ভরার জন্য অর্জুন সেই স্মৃতিবাহী কলমটি তাঁকে উপহার দেন। সেই ঝরনা কলমটি আজও রয়েছে জ্যোতিরাদিত্যর কাছে। জানি না, বিজেপির প্রাথমিক পদ গ্রহণের ফর্মটিতে স্বাক্ষর করার সময় তিনি কোন কলম ব্যবহার করেছেন! শুধু বুঝতে পারছি, ইতিহাস কীভাবে পুনরাবৃত্ত হয়। ফিরে আসে ইতিহাস, নব নব রূপে ফিরে আসে।
আজ মনে পড়ছে এক সন্ধ্যার কথা। নভেম্বর ১৯৯৭। লালকৃষ্ণ আদবানি তখন থাকতেন পান্ডারা পার্কে। সেদিন হঠাৎ গিয়ে দেখি খাওয়ার ঘরে বসে আছেন কংগ্রেস নেতা রঙ্গরাজন কুমারমঙ্গলম। তামিলনাড়ুর এই নেতা আবার প্রয়াত সিপিআই নেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। দারুণ বাংলা বলতেন ‘রঙ্গা’ (এই নামেই তাঁকে সবাই ডাকত)। রঙ্গার অনুরোধে সেদিন রাতে খবরটা লিখতে পারিনি যে তিনি কয়েকদিন বাদেই বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। পরে রঙ্গা ডিনার সেরে চলে যাওয়ার পর আমাকে আদবানি বুঝিয়েছিলেন, কেন তিনি দলে কিছু বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাকে নেওয়ার পক্ষে। প্রথমত, বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ হল কংগ্রেস। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে শতাধিক বছরের প্রাচীন এই দলটি যতই দুর্বল হবে, বিজেপি ততই প্রতিপক্ষের পরিসর পাবে। একজনের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে অন্যের অধোগতি সমানুপাতিক। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের ল্যাটারাল এন্ট্রি, যা সংঘ পরিবারের সংকীর্ণ ভিত্তি থেকে দলকে আরও প্রসারিত করবে। তৃতীয়ত, যেসব রাজ্যে বিজেপির রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল, সেসব রাজ্যে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠিত নেতা এলে তাঁর পরিচিতিকে ‘মূলধন’ করে বিজেপির শক্তি সেখানে বাড়ানো যেতে পারে। আদবানির সেসব চেষ্টা যে সবটা সফল হয়েছে, তা নয়। কিন্তু, আজ মোদি-অমিত শাহ যা করছেন, তাতে সেই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতিই পরিলক্ষিত হচ্ছে। জ্যোতিরাদিত্যর বিজেপিতে যোগদান সেই রাজনীতির সম্প্রসারণ। নতুন সংস্করণ মাত্র।
[আরও পড়ুন: মনে মনে রঙের এই উৎসবকে হত্যা করি ]
এর ফলে কংগ্রেসের ক্ষতি কতটা, আর বিজেপির লাভ কতটা! তা নিয়ে ময়নাতদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রেও আর পাঁচটা বিষয়ের মতো, নানা মুনির নানা মত থাকতেই পারে। তবে গান্ধী পরিবারের চরণতলের দাসানুদাসও আজ একথা বলতে পারছেন না, এই পরিস্থিতিতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। এই ঘটনার পরদিন, সংসদে এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও রাজ্যসভার সদস্য (নামটি প্রকাশ করা সৌজন্য বিরোধী) বললেন, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে দিল্লির তখত থেকে নরেন্দ্র মোদিকে সরানো সম্ভব নয়। আবার, রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস কখনওই নরেন্দ্র মোদিকে সরাতে সক্ষম হবে না। যেকোনও কংগ্রেস নেতার সঙ্গে একান্তে আলোচনা করুন, দেখবেন, তিনি স্বীকার করছেন রাহুল গান্ধীকে দিয়ে হবে না। এমন কথাও বহু নিন্দুকে বলেন, মোদির জন্য সবচেয়ে বড় ‘সেফটি ভাল্ভ’ হলেন রাহুল গান্ধী।
২০০৩ সালে কংগ্রেস মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতাচ্যুত হয়। তারপর ১৫ বছর বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে আবার সবে তারা ক্ষমতায় এসেছে। এসেছে, কারণ দলের ভোটব্যাংক অটুট ছিল। রাহুল নয়, কমলনাথ, দিগ্বিজয় সিং ও জ্যোতিরাদিত্যর মতো বিশিষ্ট রাজ্যনেতা ছিলেন। যাদের রাজ্যস্তরে জনভিত্তি ও সাংগঠনিক শক্তি আছে। আর মধ্যপ্রদেশে কোনও ‘তৃতীয়’ রাজনৈতিক দলও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু, ক্ষমতায় আসার পর, গত ১৬ মাস ধরে কমলনাথ মুখ্যমন্ত্রী ও দলের রাজ্য সভাপতি। হাইকমান্ড অন্য কোনও নেতাকেই রাজ্য সভাপতি করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। রাজস্থানেও একইভাবে শচীন পাইলট গত ১৬ মাস ধরে উপমুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য সভাপতি। সে রাজ্যেও যে কী ভয়ংকর কলহ চলছে তা আমি জানি, আর রাহুল গান্ধী জানেন না? রাহুল গান্ধী বলতে পারেন যে, তিনি এখন সভাপতি নন, মা সোনিয়া গান্ধীই দলনেত্রী। আর তাও তো অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, রাহুল যদি সত্যিই আর সভাপতি হতে না চান। রাজনীতি থেকেই দূরে সরে যেতে চান। তবে সেটা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
শাহিনবাগের ঘটনার পর দেশে বিরোধীরা নড়েচড়ে বসেছিল। মনে হচ্ছিল, ধর্মীয় মেরুকরণের সাহায্যে বিজেপি একদিকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টা করলেও তার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে উদার বাম দৃষ্টিভঙ্গি। সম্পন্ন বিপরীত আখ্যানের রাজনৈতিক পরিসর গড়ে উঠছে। কংগ্রেস নেতারাও আবার সংখ্যালঘু ভোটলাভের প্রত্যাশী হয়ে উঠেছিলেন। তখন প্রতিপক্ষ রে রে করে বলছিল, ওহে বিজেপি, ওহে অমিত শাহ, এই সাম্প্রদায়িকতা আর নয়! আস্তে আস্তে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের বাইরেও।
[আরও পড়ুন: ৫০ বছরের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশ চাই]
এদিকে, দেশের আর্থিক অবস্থা ভয়াবহ। শেয়ার বাজারে যে ধস নেমেছে, তাও অভূতপূর্ব! করোনা আতঙ্কে শুক্রবার মাত্র কয়েক ঘণ্টায় কোটি কোটি টাকার ধাক্কা সইতে হয়েছে। এই অবস্থায় জ্যোতিরাদিত্যর ধাক্কা কংগ্রেসকে অন্তঃপুরে এতটাই দুর্বল করে দিয়েছে যে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করার ক্ষমতা এখন কংগ্রেসের কার্যত নেই। ‘জ্যোতিরাদিত্য দল থেকে চলে গিয়েছেন, আহা কী আনন্দ, এবার রাহুল গান্ধী আরও শক্তিশালী হয়ে গেলেন, এবার রাহুল গান্ধী মোদিকে আসল ধাক্কাটা দেবেন’ এসব কথা বলে কংগ্রেস নেতাদের আর হাস্যাস্পদ না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মধ্যে এক ধরনের জমিদারি ঔদ্ধত্য আছে, এমন কথা তো অনেকেই বলেন। আমার নিজেরও ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, জ্যোতিরাদিত্য আমজনতার মধ্যে মিশতে গিয়ে বা জনসভা করতে গিয়ে কোথাও যেন নিজে সেই জনসমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। এটা ওঁর ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু, বসুন্ধরা রাজের ছেলে দুষ্মন্ত সিংয়ের মধ্যে এই আপাত অ্যাটিটিউড সেভাবে দেখা যায় না। আবার একথাও সত্যি জ্যোতিরাদিত্য ওঁর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়। শুধু গোয়ালিয়র কেন, কলকাতায় এসে সভা করলেও শহুরে অভিজাত মধ্যবিত্ত বাঙালি কিন্তু বিপুল ভিড়ের বলয় গড়বে জ্যোতিরাদিত্যকে ঘিরে।
ভারতের সমাজব্যবস্থা আধা সামন্তবাদ আর আধা পুঁজিবাদের জটিল সংমিশ্রণ। এমতাবস্থায় মহারাজার জনপ্রিয়তা মধ্যপ্রদেশে কম নয়। সেখানকার বিজেপি নেতৃত্বের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির নেতারা তেমন আহ্লাদিত না হলেও, নিচুতলার কর্মীরা কিন্তু বেশ উত্তেজিত। আর, জ্যোতিরাদিত্যর নিজস্ব টিমের সদস্যরা ভাবছেন, কমল নাথ তাঁদের নেতাকে মর্যাদা না দিলেও মোদি ও অমিত শাহ নিশ্চয়ই দেবেন। কৌটিল্য কী বলেছিলেন? তুমি যখন নানাভাবে এক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আছ, তখন নিজের ঘরকে সুরক্ষিত করার জন্য শ্রেষ্ঠ কৌশল হল শত্রুর শিবিরে আগুন লাগিয়ে দাও। কে জানে, অশোক গেহলটের হাতে অত্যাচারিত শচীন পাইলট এখন কী করবেন? মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস এবার ভাঙবে? শশী থারুর কি সত্যিই বিদ্রোহ ঘোষণা করতে প্রস্তুত? আজকাল দলত্যাগ, একটা দল ত্যাগ করে অন্য দলে যাওয়া, বিশেষত শাসক দলে যাওয়া জলভাত।
জ্যোতিরাদিত্য এবং রাহুল গান্ধীর সম্পর্ক নিয়েও বহু মানুষের মধ্যে ভ্রান্তিবিলাস রয়েছে। বারবার বলা হত, জ্যোতিরাদিত্য নাকি রাহুলের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। তিনি ‘টিম রাহুল’-এর সদস্য। যে কোনও সাংবাদিক, যিনি কংগ্রেস দলটিকে কাছ থেকে দেখেছেন ও ‘কভার’ করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন, তিনি বলে দেবেন, সংসদে রাহুল যতই চোখের ইশারা করুন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে। আসলে গান্ধী পরিবারের কোথাও একটা নিরাপত্তার অভাব আছে। তাই জ্যোতিরাদিত্য যেভাবে নিজেকে দলের মধ্যে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, পারেননি। কংগ্রেস তাই যেন আজ আত্মঘাতী। রাহুলের নেতৃত্বে এই হালভাঙা, পালছেঁড়া কংগ্রেস যে নরেন্দ্র মোদির মতো শক্তিশালী নেতাকে সরাতে পারবে না। তা বোঝার জন্য কি কোয়ান্টাম মেকানিক্স জানতে হয়? তুলনায় অপরিণত একটা বাচ্চা ছেলেও রাজনীতির সহজ পাঠ জানে, রাহুল গান্ধীকে দিয়ে হচ্ছে না।
The post কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতি appeared first on Sangbad Pratidin.