সুবিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক রোয়াল্ড ডালের অনেকগুলো বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সেসব সংস্করণে কিছু বাক্য, শব্দ, দ্যোতনা বদলে দেওয়া হয়েছে নানাবিধ কারণে। তবে তীব্র প্রতিবাদের জেরে আদি ও মৌলিক রোয়াল্ড ডাল আবার ফিরতে চলেছেন। এ যেন ছুরি-কাঁচির অনুশোচনাতুল্য। ভেবে দেখলে শেক্সপিয়র বা বঙ্কিমচন্দ্র এখনও ভাগ্যবান। সেন্সরশিপের তিরস্কার, শাসন ও অপচ্ছায়া তাঁদের গিলে খেতে পারেনি আজও। লিখলেন রঞ্জন বন্দ্যো পাধ্যায়
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বৃহস্পতি নিঃসন্দেহে তুঙ্গে! রেহাই পেয়েছেন তিনি। তঁাকে পড়তে হয়নি ‘অ্যান্টি-সেমিটিক’ বা ইহুদি-বিরোধী অপবাদের হতশ্রদ্ধায়। তঁার ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ নাটকের নির্মম, অর্থগৃধ্নু, নৈতিক মূল্যবোধহীন ইহুদি চরিত্র শাইলককে খোলনলচে বদলে তাকে পরিণত করা হয়নি সুমিত, দয়ালু, কোমল বান্ধব চরিত্রে! শেক্সপিয়রের ভাগ্য সত্যিই ভাল, তঁাকে ‘ওথেলো’ লেখার জন্যও জাত্যাভিমানী বা জাতিবিদ্বেষীর পরবাদ ঘাড়ে করে কালযাপন করতে হচ্ছে না। এবং শেক্সপিয়রের কৃষ্ণাঙ্গ নায়ক ওথেলোর শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রী-র প্রতি সমস্ত গালিগালাজ, অসম্ভ্রম, অপমানসূচক, গ্লানিকর উচ্চারণ নিটোল সযত্নে এখনও রক্ষিত– এ শুধু শেক্সপিয়রের সৌভাগ্য নয়, আমাদেরও।
কিন্তু সব লেখকের ভাগ্যে জোটে না এমন সৌভাগ্য। সুবিখ্যাত ইংরেজ গল্পকার রোয়াল্ড ডালের (Roald Dhal) অনেকগুলো গল্পের বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে পেঙ্গুইনের ‘পাফিন’ থেকে, যেসব সংস্করণে ডালের মূল লেখার কিছু বাক্য, শব্দ, দ্যোতনা, এমনকী ভাষাও বদলে দেওয়া হয়েছে নানা সূক্ষ্ম কারণে। যেমন ‘এনরমাসলি ফ্যাট’-কে করা হয়েছে শুধু ‘এনরমাস’, পাছে মেদবহুল মানুষ মনে আঘাত পান। এসব সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কয়েকটি ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। যেমন, রোগা-মোটা নিয়ে তেমন কোনও কথা থাকবে না। থাকতে পারবে না এমন কোনও দ্যোতনা, যা শারীরিকভাবে কাউকে লজ্জা দেবে বা আঘাত করবে। কাউকে ‘পাগল’, ‘খ্যাপা’, ‘উন্মাদ’– এসব বলা যাবে না। কারণ এই সমস্ত শব্দ মানুষকে মানসিকভাবে আঘাত করতে পারে। এমনকী, ‘মা-বাবা’ না বলাই ভাল। কারণ ‘মা-বাবা’ পুরুষ ও স্ত্রী– বিভেদ বোঝাচ্ছে। সেক্স ডিসক্রিমিনেশন। অতএব ডাল-এর গল্পে ‘মা-বাবা’ এখন ‘পরিবারে’ পরিণত। এবং ডাল-এর আধুনিক সমাজবোধ-প্রসূত সংস্করণে সম্পাদনা কতদূর গড়িয়েছে দেখা যাক: ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন’ নতুন সংস্করণে ‘ফোক্স’, ‘বয়েজ অ্যান্ড গার্লস’ শুধুমাত্র ‘চিলড্রেন’, এবং ‘লাভলি পিঙ্ক স্কিন’-এ বাদ গিয়েছে ‘পিঙ্ক’ শব্দটি, কেননা, ‘গোলাপি’ শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে বর্ণসচেতনতা, এবং সেই বর্ণসচেতনতা-প্রসূত ঘৃণা!এই সম্পাদনার ফল হয়েছে ভয়াবহ।
[আরও পড়ুন: ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ যেন ‘টিকটক ওয়ার’, প্রচারযুদ্ধে মস্কোকে টেক্কা কিয়েভের]
পৃথিবী জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তীব্র প্রতিবাদ এসেছে সলমন রুশদি-র কাছ থেকে এই ভাষায়: রোয়াল্ড ডাল দেবদূত ছিলেন না। তা’ বলে, তঁার ভাষাকে, তঁার ব্যবহৃত শব্দকে এভাবে ছেঁটে ফেলা হবে! এ তো উদ্ভট সেন্সরশিপ! ‘পাফিন বুকস’ এবং ডালের সাহিত্যকর্মের যঁারা রক্ষক, তঁাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। রাজা তৃতীয় চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলা জগতের সমস্ত লেখকের উদ্দেশে লিখেছেন, আপনাদের ভাষা ও শব্দের অধিকার যঁারা ছেঁটে ফেলতে চাইছেন, তঁাদের দ্বারা বিঘ্নিত ও বাধাপ্রাপ্ত হবেন না। আপনাদের পেশার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে নির্ভয়ে লিখুন। যঁারা আপনাদের কল্পনাকে সীমিত করে দিতে চাইছেন, বাধা দিচ্ছেন মনের কথা খুলে বলার ভাষাকে, তঁাদের বাধা মানতে বাধ্য নন আপনারা।
পেঙ্গুইন ও পাফিন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা স্বীকার করেছে, বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে। ক্ষমাপ্রার্থী তারা। এবং বাজারে আবার ফিরে আসছে অ-সম্পাদিত, কোনওরকম পরিবর্তন ছাড়া, রোয়াল্ড ডালের একেবারে গোড়াকার, মূল লেখাগুলি, তঁার নিজস্ব আদি, মৌলিক ও মার্ভেলাস গদে্য। আমরা যারা যৌবনে ও মধ্যবয়সে রোয়াল্ড ডালের গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং ১৯৯০-এ যে লেখককে ৭৪ বছর বয়সে হারিয়ে আমরা হতাশ হয়েছিলাম– তিনি যেন আবার নতুনভাবে ফিরে আসতে চলেছেন, আপাতত ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়, এবং অচিরে কলকাতাতেও, ‘রোয়াল্ড ডাল স্টোরি কোম্পানি’ এবং ‘পাফিন বুক্স’-এর অনুশোচিত সৌজন্যে।
[আরও পড়ুন: ‘মোদি নীতিগতভাবে স্বচ্ছ’, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ভারতের সাহায্য প্রার্থনা আমেরিকার]
রোয়াল্ড ডাল তো মননহীন, বোধহীন, সংস্কারাচ্ছন্ন সেন্সরশিপের একমাত্র শিকার নন। লেখকের স্বাধীনতায়, তঁার, মতপ্রকাশ, ভাষার স্বাধীনতা ও বন্ধনহীনতার উপর যুগে যুগে নেমে এসেছে তিরস্কারের ঝড়, তথাকথিত নীতিবোধের ও সমাজচেতনার বাধা। আমাদের পড়তে বাধ্য করা হয়েছিল এক সময়ে “লেডি চ্যাটার্লি’জ লাভার”-এর মতো ক্লাসিকের কাটাছেঁড়া, নির্মমভাবে সম্পাদিত সংস্করণ। ১৯২৮ সালে, প্রকাশের বছরেই, নিষিদ্ধ হয় এই অনন্য উপন্যাস। ১৯৬০ সালে উঠে গেল সেই বাধা। ১৯৬৩ সালে বেরল বিটলস্দের প্রথম এলপি। সে এক প্রবল সাংস্কৃতিক ঝড়!
কী সৌভাগ্যবান আমি, আমার বাইশ বছর বয়স আলুথালু হয়েছিল সেই ঝঞ্ঝায়! আর হাতে এসেছিল ফিলিপ লারকিন-এর ‘অ্যানাস মিরাবিলিস’ কবিতাটির উদ্ধত উক্তি: ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স বিগ্যান ইন নাইনটিন সিক্সটিথ্রি!’ সাহিত্যে যৌন মিলন যে কোনও তীব্র সংরাগের গৌরবে পৌঁছতে পারে, তা বুঝিয়ে দিয়েছিল লরেন্সের উপন্যাসের ভাষা, বিট্লস-দের প্রথম এলপি: প্লিজ প্লিজ মি! আমাদের যৌবনের সমবেত সংবেদনায় খুলে গিয়েছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন সংজ্ঞা ও স্বাধীনতা। এরপর যখন বুদ্ধদেব বসুকে “রাত ভ’রে বৃষ্টি” লেখার অপবাদে দঁাড়াতে হল অশ্লীলতার দায়ে কাঠগড়ায়, ১৯৬৭ সালে, কী যে কষ্ট পেয়েছিলাম, কী বলব! তারপর সমরেশ বসুকেও দঁাড়াতে হল এই একই অপরাধে বিচারকের সামনে, তঁার ‘বিবর’ উপন্যাসের জন্য।
যুগে যুগে লেখক ও তঁার ভাষার উপর কি নেমে আসতেই থাকবে তিরস্কার, শাসন ও বাধা? ছিঁড়ে ফেলা হবে তঁার প্রকাশের অধিকার ও ভাবনার ব্যঞ্জনা! এমনকী, রবীন্দ্রনাথের পত্রকেও হতে হবে সম্পাদিত? প্রকাশিত হবে তার ছিন্নরূপ? সেই কবে জন মিল্টন লিখেছিলেন তঁার ‘অারিওপাজিটিকা’ (১৬৪৪) লেখকের পূর্ণ স্বাধীনতার যাচনায়! কিন্তু এখনও কি আমরা পেয়েছি সেই স্বাধীনতা? এখনও কি পারি সেই কথা বলতে যে-কথা বলতে চাই? কত দে্যাতনায়, ব্যঞ্জনায়, কত আড়াল টেনে, কত নিরাপদ ঘুরপথে, কত হতাশ তির্যকতায় বলতে হয় মনের কথা! কোথায় এল লেখকের স্বাধীনতা? আজও তো অন্তত এ-দেশে নিষিদ্ধ ‘ইউলিসিস’-এর মতো উপন্যাসের লেখক জেমস জয়েসের লেখা বেশ কিছু পত্র, যেসব চিঠি তিনি লিখেছিলেন স্ত্রী নোরাকে! কেন নিষিদ্ধ? অশ্লীলতার জন্য! আমি পড়েছি সেসব পত্র। স্বাদ পেয়েছি সেই হিরণ্ময় অশ্লীলতার! সেই অশ্লীলতাই প্রবিষ্ট হয়েছে ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসের অন্তর-বুননে। জয়েস স্বয়ং স্বীকার করেছেন, ইউলিসিসের ঋণ তঁার স্ত্রী ও তঁার পত্রের কাছে! আমার তো মনে হয়, স্ত্রী নোরাকে লেখা জয়েসের পত্রাবলি না পড়লে ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসের অনেকটাই থেকে যায় অনাবৃত আড়ালে! কবে ভারতে পাওয়া যাবে নোরাকে লেখা জয়েসের অপবিত্র পত্রাবলি?
এইখানে একটু ব্যক্তিগত বেদনা ও তাড়নার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যদিও যে-লেখকদের নাম করলাম, যঁাদের বাধাপ্রাপ্ত স্বাধীনতার কথা বললাম, তঁাদের ধারে-কাছে কোথাও আসি না আমি। তবু আঘাত ও কষ্ট যে পেয়েছি, এবং তা সত্ত্বেও নিজের মনের কথা যতদূর সম্ভব খোলাখুলি বলার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি, একথা তো সত্যি! রবীন্দ্রনাথও তঁার নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর সম্পর্কের অন্তর-সত্যটি উন্মোচন করার চেষ্টা করেছি নানাভাবে। এবং কী ভয়ংকর ঝড় উঠেছে প্রতিবাদের, তা অনেকেই জানেন। তারপর দেখলাম কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। সিনেমার বিষয় হয়ে উঠল রবীন্দ্র-কাদম্বরী প্রণয় ও প্রলয়!
রবীন্দ্রনাথের জীবনে নানা নারী এসেছেন, বন্ধুত্বে, প্রণয়ে, গভীর সম্পর্কে। আমি লিখেছি খোলামেলা ভাষায়, আড়াল সরিয়ে– রবীন্দ্র-রাণু, রবীন্দ্র-ইন্দিরা, রবীন্দ্র-ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো অন্বয় নিয়ে একাধিক লেখা। তোলপাড় হয়েছে। নিন্দিত হয়েছি। এমনকী, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের মন’ নিয়ে বলার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েও শাসিত, তিরস্কৃত, সমালোচিত হয়েছি। শেষ পর্যন্ত শুনতে হয়েছে, এই রবীন্দ্র-অন্বেষ অশ্লীল। সম্প্রতি লিখেছি নিজের কথা– যতদূর সম্ভব একটি মুক্ত, নির্ভয়, সাহসী আত্মজীবনী। না, সেই অধিকারও নাকি লেখকের নেই– বলছেন অনেকেই। এমন আত্মজীবনী নাকি আক্কেলহীন, অর্বাচীন!
পুনশ্চ: একটি কথা মনে আসতে বাধ্য এখানে। রোয়াল্ড ডালের লেখাপত্তরের ডালপালা কেটে ‘টেক্সট’গুলিকে সীমিত, সংকীর্ণ বনসাইয়ে পরিণত করার বিরুদ্ধে যেভাবে ব্রিটেন সরব হয়েছে, তা কিন্তু ব্রিটিশ জাত্যভিমানের জয়টীকা হতে পারে। স্বয়ং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্ষুণ্ণ। ‘আ মরি বাংলা ভাষা’-য় এমন দিন কখনও দেখতে পাব? নিজের জন্য না-ই হোক, অন্য কোনও লেখকের জন্য!