সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: আদালতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার পেশ করা দাবিতে বিপাকে কেন্দ্রেরই বাহিনী। বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে আদালতে যে চার্জশিট জমা দিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), তাতে কার্যত অভিযোগ করা হয়েছে বিএসএফের বিরুদ্ধে। বলা হয়েছে, যে চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে গরু পাচার হত, তাতে বড় ভূমিকা ছিল বিএসএফ কর্তাদের। এই প্রসঙ্গ সামনে আসতেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, এতদিন তাঁরা যে কথা বলে আসছিলেন, তা প্রমাণ হয়ে গেল। পালটা বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের দাবি, বিএসএফ তো অনুব্রতকে গরু পাচার করার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠায়নি।
ইডি’র চার্জশিটে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ‘বিএসএফ আধিকারিকদের যোগসাজশে ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্ত মারফত গরু পাচার করা হত।’ এই বক্তব্যে প্রমাণ হয়ে গেল গরু পাচার মামলায় রাজ্যের শাসকদলের বিভিন্ন সময়ে করা দাবি। প্রায় শুরুর দিন থেকেই তৃণমূলের প্রশ্ন ছিল, আকাশ থেকে তো পশ্চিমবঙ্গে এত গরু আসেনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে স্পষ্ট যে, উত্তর ও মধ্য ভারত বিশেষত গো বলয় থেকেই বাংলা হয়ে গরু পাচার হত বাংলাদেশে। বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যের উপর দিয়ে আসত এই পাচার হওয়া গরু। সেক্ষেত্রে কী করত সেই সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রশাসন, তারা কি এই সম্পর্কে কিছুই জানত না? কেনই বা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার জেরায় সেই রাজ্যগুলির বিষয়ে কিছু নেই? এদিন সেই প্রশ্নগুলিই নতুন করে তুললেন কুণাল।
[আরও পড়ুন: কমিটির সিদ্ধান্তই শিরোধার্য মারাঠা স্ট্রংম্যানের, ইস্তফাপত্র প্রত্যাহার করলেন পওয়ার]
বললেন, “আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি তৃণমূলকে বদনাম করা হচ্ছে। গরু আসছে উত্তরের গো-বলয় থেকে। সেখানকার সরকার কেন আটকাচ্ছে না? সীমান্ত পেরনোর বিষয় হলে, সে তো বিএসফের দায়িত্বে। আদৌ যদি গরু পাচার হয়ে থাকে, তার দায় তো বিএসএফের। ইডি আজ চক্ষুলজ্জার খাতিরে অন্তত এটা বলেছে যে, দায় বিএসএফের। মাঝে তৃণমূলকে হারাতে না পেরে বদনাম করছেন কেন?” তাঁর আরও প্রশ্ন, “গরু অনুব্রত মণ্ডলের জেলা পর্যন্ত এল কী করে, সেটা বলুক। অনুব্রত মণ্ডলকে ডিফেন্ড করতে যাচ্ছি না। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে বাংলা পর্যন্ত এল কী করে? আবার সেটা বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছে, তখন বিএসএফ কী করছে? ইডির চার্জশিট তো অসম্পূর্ণ। গরু যেখান থেকে আসা শুরু হচ্ছে, সেখানকার হিসাব তো ইডির কাছে নেই।”
এই প্রসঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, “বিএসএফের কেউ জড়িত থাকলে গ্রেফতার করা হবে তাকে। তবে এরকম তো নয় যে, অনুব্রতকে চিঠি দিয়ে বিএসএফ বলেছে, এসো গরু পাচার করি।” শক্তিগড়ে কোন দোকানে দাঁড়াবে অনুব্রত, তা জানিয়ে দেওয়া হয়। এই অভিযোগ নিয়ে কুণাল বলেন, “উত্তরপ্রদেশে পুলিশ যখন জানিয়ে দেয় যে, তাদের হেফাজতে থাকা দু’জনকে রাতে মেডিকেল চেকআপে নিয়ে যাবে। আর সাংবাদিকদের দিয়ে খবর করানোর ছদ্মবেশে ক্রিমিনাল দিয়ে মেরে দেয়, ইডি-সিবিআই সেগুলো দেখতে পায় না? অনুব্রত মণ্ডল কী করেছে বলতে পারব না। দঁাড়িয়েছে, খেয়েছে। তার ব্যাপার। তবে ডিফেন্ড করার জায়গা নেই।”
যে চার্জশিট জমা দিয়েছে ইডি, তার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কীভাবে বিভিন্ন উপায়ে প্রভাব খাটিয়ে, সামান্য কিছু কমিশন দিয়ে কালো টাকা সাদা করতেন অনুব্রত-সুকন্যা। একটি বড় অংশে ব্যবহার করা হয়েছে লটারি। জেলায় বড় অঙ্কের লটারি জিততেন যাঁরা, তাঁদের থেকে নিয়ে নেওয়া হত সেই টিকিট। বদলে গোটা টাকা দিয়ে দেওয়া হত নগদে। এরপর সেই লটারির মাধ্যমে নিজেদের অ্যাকাউন্টে নেওয়া হত ‘সাদা টাকা।’ এক প্রোমোটারকেও নগদ টাকা কমিশন দিয়ে দফায় দফায় কয়েক কোটি টাকা দিয়ে নিজেদের অ্যাকাউন্টে টাকা নিতেন অনুব্রত-সুকন্যা। এক এলআইসি এজেন্টকে নগদে দশ লক্ষ টাকা দিয়ে পরে বলা হয় অনুব্রত বীমা করবেন না। ২৫ হাজার টাকা কেটে অ্যাকাউন্টে বাকী টাকা ফেরত নেন তৃণমূল নেতা। এভাবেই সবজি বিক্রেতা, বাড়ির পরিচারক-সহ অন্যদের অ্যাকাউন্টেও ঘোরানো হত টাকা। চার্জশিটে উঠে এসেছে এক উল্লেখজনক দিক। যেখানে সুকন্যা দাবি করেছেন, তিনি কিছুই জানতেন না। বাবা যেখানে সই করতে বলতেন, করে দিতেন। হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারি আবার দাবি করেছেন, অনুব্রত নন। ব্যবসার বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নিতেন সুকন্যাই।