shono
Advertisement

Breaking News

এত ‘খিল্লি’ কেন! ওরা ফেল করলে কি বেশি খুশি হতেন?

মাধ্যমিকে পাশের হার নিয়ে অশোভন খিল্লি ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে।
Posted: 08:46 PM Jul 20, 2021Updated: 08:47 PM Jul 20, 2021

সরোজ দরবার: মাধ্যমিকে (Madhyamik 2021) সকলেই পাশ! সমবেত দীর্ঘশ্বাস পড়ল নেটদুনিয়ার অধিবাসীদের। হা কপাল! পাশ আছে ফেল নেই; এ আবার একটা ফলাফল হল নাকি! কয়েক পলেই সে-দীর্ঘশ্বাস বদলে গেল নির্মম রসিকতায়। সোশ্যাল মিডিয়ার (Social media) খোলা দেওয়াল। মালিকানা নিজের নিজের। অতএব শুরু হল সৃজনশীল খিল্লি প্রতিযোগিতা। কিন্তু, এই ‘খিল্লি’ কার উদ্দেশে? শিক্ষাব্যবস্থা, পরিস্থিতি নাকি নিরপরাধ বাচ্চাগুলোর প্রতিই ধেয়ে আসছে এইসব ‘শিক্ষিত’ মশকরা!

Advertisement

নাহ্‌, সে ভাবার সম্ভবত সময় কারও হাতেই নেই। সাধারণত ভারচুয়ালের খোলা দেওয়ালে মতামত ঝুলিয়ে দেওয়ার সময় আমাদের আগাপাশতলা ভাবার খেয়াল থাকে না। এক্ষেত্রেও সেই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনাহীন হয়ে থাকার ট্র্যাডিশন বজায় থেকেছে। ফলে মাধ্যমিকে পাশের হার নিয়ে যে অশোভন খিল্লি বঙ্গজ শিক্ষিত সমাজের মুখাবরণ অতিক্রম করে প্রচ্ছদ হয়ে উঠেছে ক্রমশ, তা আসলে একরকমের নিষ্ঠুরতা। যেন মব লিঞ্চিংয়ের আনন্দ মিশে আছে এই মশকরায়।

[আরও পড়ুন: মাধ্যমিকের ফল নিয়ে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে নিজেই ট্রোলড Shatarup Ghosh, কী বললেন নেটিজেনরা?]

এই রসিকতা তো আখেরে তাদের উদ্দেশেই করা হচ্ছে, যারা এর জন্য কোনও ভাবেই দায়ী নয়। যাদের পরীক্ষা দিয়ে ফল অর্জন করার কথা, তারা পরীক্ষা দিতেই পারেনি। দিতে যে পারেনি, তার কারণও তারা নয়। বরং সেই কারণ এবং কারণটি জিইয়ে থাকার পিছনে আমজনতার অবদান কোনও অংশে কম নয়। বিকল্প মূল্যায়নের পথ নেওয়া ছাড়া বোর্ডেরও হাতে আর কি কিছু ছিল? সম্ভবত একমাত্র উত্তর না, ছিল না। তাহলে, এমত পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট অঙ্ক মেনে স্কুলের মূল্যায়নের ভিত্তিতে যে ফলাফল এসেছে, তা মেনে নেওয়াই তো সহজবোধ্য ছিল। কিন্তু হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন!

তাই সকাল হতে না হতেই এই নিয়ে ভারচুয়ালের মাতব্বরগণ চণ্ডীমণ্ডপে খাপ বসিয়েছেন। এ কেমন পরীক্ষা! পরীক্ষা না দিয়েই ৭৯ জন প্রথম! পাশের হার ১০০ শতাংশ! হাসি আর থামে না। ক্রমে দেখা গেল মান্যবর এক বাম নেতাও এই ৭৯ জন প্রথমকে এক বিখ্যাত প্রকাশনীর মডেল হিসেবে ধরে নিয়ে এক লাইন লিখে ফেললেন। বোধহয় বিরোধিতার ‘ফ্যাশনে’ না লিখে থাকতে পারেননি! শুধু তিনি নন। যাঁরা এই মশকরা করছেন, তাঁদের প্রাথমিক লক্ষ্য সরকার এবং শিক্ষ্যাব্যবস্থা। কিন্তু তাঁরা বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন, আসলে তাঁরা কাদা ছুঁড়ছেন বাচ্চাগুলোর গায়েই।

[আরও পড়ুন: শিশুদের শরীরে আঘাত হানতে পারবে না করোনার তৃতীয় ঢেউ, দাবি শহরের চিকিৎসকদের]

ভাবুন তো, আপনার বাড়িতেই যদি এমন একটা বাচ্চা থাকত! যে বছরভর প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষা দিতে পারেনি। আজ যদি সে পরীক্ষা না দিয়ে অকৃতকার্য ঘোষিত হত, তবে কি তা বেশি খুশি হওয়ার কারণ ছিল! নাকি সেটা করলেই বোর্ড যথার্থ কাজ করেছে এমন প্রতিপন্ন হত! মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ পড়ুয়া অসংখ্য ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ এই মহামারীর কারণে যে অকূল পাথারে পড়েছে, তাতে তাঁদের জন্য আরও নাগরিক সহমর্মিতা বোধহয় প্রত্যাশা ছিল। এই যে ‘পরীক্ষা না দিয়ে পাশ’ ছাপ লেগে গেল তাদের গায়ে, তার ভার যে কত অসহ হতে পারে, অতীত তার সাক্ষী আছে।

’৭১-এর ব্যাচের স্মৃতি আজও তো অনেকের কাছেই টাটকা। কেউ কেউ শুনেছেন অগ্রজের মুখে। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলেও আমাদের শিক্ষা হয় না, ফলে প্রহসনই জারি থাকে। যেমন এবার বিনা দোষে কাঠগড়ায় উঠছে পড়ুয়ারা। শুধু তাই নয়, সামগ্রিক ভাবেই এই লকডাউন পর্বে শিক্ষকদের সম্পর্কেও একইরকম কুরুচিকর কথাবার্তা ক্রমশ শোনা গেছে। এখনও তা থামেনি। তাঁরা বসে বসে মাইনে নিচ্ছেন, এই বার্তা রটিয়ে দেওয়া হয়েছে সর্বত্র। এক অধ্যাপক কিছুদিন আগে করুণ মুখে বলছিলেন, পড়াব কী করে? আমি তো ছাত্রদের চোখই দেখতে পাচ্ছি না! আর এক শিক্ষিকা জানিয়েছিলেন, সবই তো বলে বলে পাঠাচ্ছি, কিন্তু ক্লাস হলে যেভাবে বুঝতে পারি ওরা কতটা বুঝেছে, সেটাই তো সম্ভব হচ্ছে না। এঁদের এই অসহায়তার খবরই বা আমরা ক’জন রেখেছি!

প্রতিটি কাজেরই একটা ধরন আছে। শিক্ষকতারও আছে। সবকিছুই তো ভারচুয়াল হয়ে যেতে পারে না। ভারচুয়ালি কি কুমোরটুলিতে প্রতিমা তৈরি হতে পারে না প্রাণপ্রতিষ্ঠা সম্ভব! যে কাজের যা ধরন, সেটাকেই অস্বীকার করে সমস্তটাকেই অর্থমূল্যে যাচাই করার এই যে ব্যাপ্ত জালে আমরা নিজেরাই পা দিয়েছি, এ আসলে আমাদের কোথায় নামাচ্ছে হয়তো নিজেরাই তা ঠাহর করতে পারছি না। মহামারী এসে শিক্ষাব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। পরন্তু সমাজের চোখে শিক্ষকদের নীচু করে দেখানোর মানসিকতা রপ্ত হচ্ছে জোরকদমে। তার উপর ফলাফল নিয়ে চলছে খিল্লি। এই যে প্রহসন, এর সামগ্রিক পরিণতি ভালো হতে পারে বলে তো অন্তত সুস্থমস্তিষ্কে ভেবে ওঠা যায় না। কিন্তু মশকরাপ্রবণ বাঙালিগণ তা শুনলে তবে তো!

নিজের আগামীর জন্য যারা মশকরা বরাদ্দ করে তাদের সঙ্গে কালিদাসের উপমাই বুঝি অভিপ্রেত। আজ যে পড়ুয়ারা এই পরিস্থিতির স্বীকার তাঁরা আজ নয় কাল নিজেদের মতো করে নিজেদের ভার নিশ্চিতই কাঁধে তুলে নেবে। এই ফলাফল অতিক্রম করে জীবনের বৃহত্তর পরীক্ষায় নিশ্চিতই সাফল্য ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু এই অবিবেচকের মশকরাময় মার্কশিটখানা হাতে নিয়ে আমরা আর কতদূর এগোব! হয়তো এই কথাটুকু ভেবে দেখার সময় এবার সত্যিই এসেছে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement