সম্প্রতি কংগ্রেস থেকে অমরিন্দর সিং পদত্যাগ করায় পাঞ্জাবের রাজনীতি এক নতুন বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে। ক্যাপ্টেনের উত্তরসূরি হিসাবে এখন নতুন মুখ অজ্ঞাতকুলশীল চরণজিৎ সিং চান্নি। তিনি পাঞ্জাবের ইতিহাসে প্রথম দলিত শিখ মুখ্যমন্ত্রী। এটা রাহুল-প্রিয়াঙ্কার ‘মাস্টারস্ট্রোক’ না কি ‘হারাকিরি’? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজনৈতিক জীবনের শেষ অধ্যায় যে এমন বেদনা-বিধুর ও বিষণ্ণ হবে, আশি ছুঁই-ছুঁই অমরিন্দর সিং কল্পনাও করেননি। সোনিয়া গান্ধী ছিলেন তাঁর বড় ভরসাস্থল। পদত্যাগ করার দিন অমরিন্দর নিশ্চিতভাবে জেনে গেলেন, ছেলে ও মেয়ের যৌথ সিদ্ধান্ত টলানোর মতো ইচ্ছাশক্তি কংগ্রেস সভানেত্রীর আর নেই। থাকলে তাঁকে এভাবে ‘সরি অমরিন্দর’ বলে পাশ কাটাতেন না।
শিখ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন পাটিয়ালা রাজপরিবারের অমরিন্দর ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লড়েছেন। পাঞ্জাবের (Punjab) রাজনীতিতে তাঁর চলাফেরা ছিল সিংহের মতো। কখনও তেজিয়ান, কখনও আলিস্যি ভরা। বয়সে আড়াই বছরের ছোট রাজীব গান্ধীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল ‘দুন স্কুল’-এ। রাজীবের হাত ধরেই তাঁর কংগ্রেসে আসা এবং ১৯৮০ সালের ভোটে জিতে সাংসদ হওয়া। ‘অপারেশন ব্লু স্টার’-এর প্রতিবাদে লোকসভা থেকে ইস্তফার পর যোগ দেন ‘শিরোমণি অকালি দল’-এ। কিন্তু টিকতে না পেরে গড়েন ‘শিরোমণি অকালি দল (প্যান্থিক)’।
[আরও পড়ুন: উপনির্বাচনের উত্তাপে ফুটছে ভবানীপুর, লড়াই আসলে কার?]
১৯৯৮ সালে সোনিয়া গান্ধী হাল ধরার পর ক্যাপ্টেনের সদলবলে ফের কংগ্রেসে ফেরা। জাতীয় রাজনীতি তাঁকে কখনও আকর্ষণ করেনি। তবে পাঞ্জাবের কংগ্রেসি রাজনীতির মধ্যমণি তিনিই। ২০০২ থেকে টানা পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয়বার ২০১৭-তে। সাড়ে ন’-বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর ‘অসম্মানিত ও অপমানিত’ ক্যাপ্টেন সরে গিয়ে রেখে গেলেন একগুচ্ছ প্রশ্ন।
এই অপসারণ রাহুল-প্রিয়াঙ্কার ‘মাস্টারস্ট্রোক’ না কি ‘হারাকিরি’, আপাতত চলছে সেই বিশ্লেষণ। পাঁচমাস আগেও যেখানে মনে হচ্ছিল, পাঞ্জাবে কংগ্রেস এবারও জিতবে নিশ্চিত, আজ সেখানে সংশয়ের মেঘ। পাঞ্জাবের রাজনীতিকে এক নতুন বাঁকের মুখে দাঁড় করিয়েছেন রাহুল গান্ধী, ক্যাপ্টেনের উত্তরসূরি হিসাবে অজ্ঞাতকুলশীল চরণজিৎ সিং চান্নিকে বেছে নিয়ে। পাঞ্জাবের চিত্রনাট্য এখন রহস্য-রোমাঞ্চে ভরপুর।
রাজনীতির বৈপরীত্য কতই না বাহারি! কর্ণাটক, উত্তরাখণ্ড ও গুজরাটে বিজেপিও মুখ্যমন্ত্রীর বদল ঘটিয়েছে। কোথাও এতটুকু হেলদোল দেখা যায়নি। শোনা যায়নি অশান্তির দীর্ঘশ্বাস কিংবা বিক্ষোভের বুদ্বুদ। দিল্লির দরবারে লাইন লাগায়নি কেউ। অথচ পাঞ্জাবে সাসপেন্স জিইয়ে থাকল পাঁচমাস ধরে। গোষ্ঠী-কোন্দলে দেখা দিল নিত্য চমক। অবশেষে অতর্কিত যবনিকা পতন।
ছত্তিশগড়ের ভাগ্যও এখনও ঝুলে রয়েছে। রাজস্থানে শচীন পাইলটকে মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট করুণা করবেন কি না অজানা। কংগ্রেসি হাইকমান্ডের মুঠো যত আলগা হচ্ছে, ততই ঘটে চলেছে বিজেপির কংগ্রেসায়ন। এ এক অদ্ভুত ‘রোল রিভার্সাল’! এসবের মধ্যেই বড় হয়ে উঠল প্রবীণ অমরিন্দরের অসম্মানজনক প্রস্থান পর্ব। যেভাবে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হল, কংগ্রেস রাজনীতিতে তা আগে দেখা যায়নি। এই সংস্কৃতি কংগ্রেসে (Congress) বেমানান।
ক্যাপ্টেনকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে যেসব প্রশ্ন, সেগুলো তাঁর ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক। বলেছেন বটে, আমার সব বিকল্পই খোলা। কিন্তু খুব বেশি বিকল্প আছে কি? বয়সকালে যখন উদ্যোগী ছিলেন, আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাগিদ ছিল, তখন নতুন দল গড়ে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন এই ৮০ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে সেই কাজে তিনি পা বাড়াবেন কি? বাড়ালেও সফল হবেন? নিজেই তো দেখলেন, যাঁদের ছায়াসঙ্গী ভাবতেন, মোক্ষম সময়ে তাঁরা কেউ পাশে নেই!
৮০ জন বিধায়কের মধ্যে ৬৫ জন সোনিয়াকে চিঠি লিখে নেতা বদলের দাবি জানিয়েছিলেন। ৭৮ জন পরিষদীয় দলের বৈঠকে যোগ দিলেন। বেলাশেষে অতি দ্রুত নির্বান্ধব হয়ে গিয়েছেন তিনি!
ক্যাপ্টেনের দ্বিতীয় বিকল্প, অকালি দলে যোগ দেওয়া। সেখানেও রয়েছে বাদলদের সঙ্গে এত বছরের প্রবল ব্যক্তিত্বের সংঘাত। তৃতীয় বিকল্প, আম আদমি পার্টি। কিন্তু এই দলে দলিত ও অনগ্রসর হিন্দু-শিখের দাপাদাপি বেশি। বাকি থাকে বিজেপি, পাঞ্জাবে যারা কোনওকালেই সেভাবে মাথা তোলেনি। এখন কৃষক আন্দোলন তাদের মাথাটাই কেটে দিয়েছে। অকালি দলের ডানার তলায় আশ্রয় পাওয়া বিজেপি এখন নিকেতনহীন। ফলে হয় নিভৃতে অশ্রুপাত, নয় পুনর্বাসনের জন্য সোনিয়ার কৃপাপ্রার্থী হওয়া, ক্যাপ্টেনের ভবিষ্যৎ প্রায় বিকল্পহীন।
পাঞ্জাব নিয়ে এই জুয়াখেলা ছাড়া রাহুলের উপায়ও ছিল না। কেননা, মিটমাটের সব কপাটেই পাঁচমাসে খিল লেগেছে। এই জুয়ায় তাঁকে সাহসী করেছেন প্রশান্ত কিশোর (পিকে)। ক্যাপ্টেন সম্পর্কিত পিকে-র রিপোর্ট ও রাহুলের উপলব্ধি এক। পাঞ্জাবের বাইরে ক্যাপ্টেনের মাথা যত উঁচু ও ভাবমূর্তি যতটা উজ্জ্বল, রাজ্যের মধ্যে তা নয়। ক্ষয় হয়েছে বিস্তর। বিধায়কদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। তৎপরতায় থাবা বসিয়েছে বয়স। সত্যি হোক বা মিথ্যা, গুরু গ্রন্থসাহিব অশুচি মামলায় বাদল পরিবারের সঙ্গে তাঁর আপসের অভিযোগ তীব্রতা পেয়েছে। নভজ্যোৎ সিং সিধু সেই ধোঁয়ায় ধুনো ঢেলেছেন। ক্যাপ্টেনের রাজা-মহারাজাসুলভ উন্নাসিকতা তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে। সেই সুযোগে তরতর করে জায়গা দখল করেছেন সিধু। হরিশ রাওয়াত, অজয় মাকেনদের মূল্যায়নও ছিল অনুরূপ। ফলে যে সোনিয়া সকলকে নিয়ে চলার পক্ষপাতী, শেষবেলায় তিনিও ভেটো প্রয়োগ করেননি। ‘সরি অমরিন্দর’ বলে সরে গিয়েছেন।
সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা রাহুল নতুন মুখ্যমন্ত্রী বেছেছেন মাথা খাটিয়ে। চরণজিৎ সিং চান্নি পাঞ্জাবের ইতিহাসে প্রথম দলিত শিখ মুখ্যমন্ত্রী। ৩২-৩৩ শতাংশ দলিতের এই চাহিদা এ-যাবৎ কোনও দল মেটাতে পারেনি। সাহস-ই করেনি। রাজ্যের ১৮ শতাংশ জাঠ শিখের হাতে ৭০ শতাংশ জমির মালিকানা। রাজনীতি ও অর্থনীতির চালক তাঁরা-ই। সেই কারণে আজ পর্যন্ত পাঞ্জাবে ৩৯ শতাংশ হিন্দুর কেউ মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি। জাতপাতের এই ফাঁস-মুক্ত হতে পারলেন না নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহও। বিকাশ ও উন্নয়নের জয়ঢাক পিটিয়েও কর্ণাটকে লিঙ্গায়েত, গুজরাটে পাতিদার প্যাটেল, উত্তরাখণ্ডে ঠাকুর মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের বাছতে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে বাবা-বাছা করতে হচ্ছে ব্রাহ্মণ ও অনগ্রসরদের। সেদিক থেকে রাহুলের সিদ্ধান্ত সাহসীই। যদিও গভীরে রয়েছে জাতপাতের ফল্গুধারা। দলিত শিখকে মুখ্যমন্ত্রী করায় অকালি, বিজেপি বা আম আদমি পার্টি কেউই কংগ্রেসকে কটুকথা শোনাতে পারেনি। মায়াবতীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে অকালি দল পাঞ্জাবে ভেসে থাকতে চাইছে। চান্নি তাতে জল ঢালতে পারেন। আম আদমি পার্টির ঘোষণা, ক্ষমতায় এলে উপমুখ্যমন্ত্রী হবেন কোনও দলিত। তাদেরও এবার নতুন স্লোগান খুঁজতে হবে। দলিত শিখ মুখ্যমন্ত্রী, জাঠ শিখ প্রদেশ সভাপতি, হিন্দু ও জাঠ শিখকে দুই উপমুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো মেসি, রোনাল্ডো, নেইমার, এমবাপে-কে একদলে আনার মতোই চমকদার। রাহুল বাজি জিতবেন কি না, ক্যাপ্টেন-পরবর্তী পাঞ্জাবি রাজনীতিতে সেটাই নতুন আগ্রহ।
[আরও পড়ুন: উত্তরপ্রদেশে জাঠ, মুসলিম ঐক্য কি ধাক্কা দেবে বিজেপির সিংহাসনে?]
চান্নি প্রথম পছন্দ ছিলেন না। এটা এখন আর গোপন নয়। সিধু তাঁরই অনুগামী চান্নিকে মেনেছেন পাঁচমাসের প্রহরী হিসাবে। ক্রিকেটের পরিভাষায় ‘নাইট ওয়াচম্যান’। ভোটে জিতলে কান্ডারি হবেন তিনি নিজে এই বাসনায়। সন্দেহ নেই সিধু উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু দলিত সমর্থন ছেঁকে তুলে চান্নি দলকে বিজয়ী করলে? হাইকমান্ড পারবে তো তাঁকে সরাতে? দলিতকে মুখ্যমন্ত্রী করতে সাহস লাগে। কাজটা কঠিন। কিন্তু আরও কঠিন ‘আইডেনটিটি পলিটিক্স’-এ দলিত মুখ্যমন্ত্রীকে হঠানো।
পাঞ্জাবে এবারের লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে আম আদমি পার্টির। চান্নি প্রথম দিনেই দ্বৈরথের সুর বেঁধে দিয়েছেন বংশ পরিচিতি জানিয়ে ‘আমিই আম আদমি’ বলে। তিনি সফল হলে কী হবে সিধুর ভবিষ্যৎ? সেই চমকও জিইয়ে থাকছে। আদর্শের ধার সিধু কোনও দিনই ধারেননি। বিজেপি হয়ে কংগ্রেসে এসে সাত-আট মাস আগে আম আদমি পার্টির দিকেও ঝুঁকেছিলেন। ক্যাপ্টেন-পরবর্তী পাঞ্জাবে ‘কাপ্তান’ হতে না পারলে রাহুল-প্রিয়াঙ্কার ভালবাসায় তিনি মজে থাকবেন মনে করা বৃথা। বাবুল সুপ্রিয়রা যুগে যুগে ভিন্ন অবতারে আবির্ভূত হন!