কুণাল ঘোষ: দৃশ্যটা মনে আছে? দ্রুতলয়ে ঢ্যাঁড়া পেটানোর বুক-কাঁপানো শব্দ। পাইক-পেয়াদার ছুটোছুটি। বিদেশি অতিথিদের কাছে যা কিছু দৃশ্যদূষণের সম্ভাবনাময়, তা সে হোক না গরিব মানুষের বসতি, সব নিমেষে ধ্বংস, উচ্ছেদ। আর ধ্বংসাবশেষ ঘিরে রঙিন কাপড়। উচ্ছেদ যারা হল, ঘর বা দোকান, দূরে কোথায় পাঠানো হল, ধ্বংসাবশেষে একলা বলা শিশুর কান্নায় সেই ঠিকানা তো লেখা ছিল না, লেখা থাকেও না। দৃশ্যটি ‘হীরক রাজার দেশে’র। সত্যজিৎ রায় কি মন থেকে তৈরি করেছিলেন? না। লোকে বলে, এটি ছিল একটি রাজনৈতিক খোঁচার দৃশ্য।
আটের দশকে দিল্লিতে একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্ট করার সময় এই ঝুপড়ির দৃশ্য দেখাতে চাননি ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi)। তাই সঞ্জয় গান্ধীর নেতৃত্বে সেই অন্যরকম ‘গরিবি হঠাও’ শেষে ‘গরিব হঠাও’তে পরিণত হয়েছিল। উঠেছিল বিতর্কের ঝড়। সত্যজিৎবাবুর ‘হীরক রাজা’র কাণ্ডকারখানায় এসব প্রতিফলিত ছিল। কিন্তু শুধু কি ইন্দিরা গান্ধী? যুগে যুগে, দেশে-বিদেশে, বিদেশি তারকাদের সফরের সময় এভাবে নিজেদের কিছু বাস্তব ছবি আড়াল করার চেষ্টা তো বারবার দেখেছি আমরা। তা সে অরণ্যদেবের কমিকসে হোক, কিংবা বাস্তবে। বিশেষ করে তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলিতে। করোনাকালের ঠিক আগে গুজরাটে মার্কিন রাষ্ট্রপতির সফরের সময়ও পথের ধারের পেল্লায় কাপড়ের আড়াল নিয়ে কথা কম ওঠেনি।
[আরও পড়ুন: চিনা বাঁধে বন্যার মুখে অরুণাচল প্রদেশ, পালটা দিতে ব্যারেজ তৈরির পরিকল্পনা কেন্দ্রের]
আপাতত, এই জি-২০ (G-20) মোহগ্রস্ত নয়াদিল্লিও এক অদ্ভুত জ্বরে কাঁপছে। একদিকে, এতবড় আসর বসানোর চ্যালেঞ্জ, সম্মান, দেশের সম্মান বাড়ানোর আয়োজন, ঝাঁ-চকচকে পরিকাঠামো দেখানোর চেষ্টা। অন্যদিকে, রুগ্ণতাকে আড়াল, নিরাপত্তার কড়াকড়ি। বিদেশিদের রুটে পড়া ঝুপড়ি, ফুটপাথের ধারের শ্রমজীবীর দোকান, যা কিছু ম্লান, যা কিছু আধুনিক ঔজ্জ্বল্যের বিপরীত, বেমানান, সেখানেই চলেছে বুলডোজার। সামনে রঙিন কাপড় বা টিনের আড়াল। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছে ফুটপাথের হকারের সন্তান, এরপর আমরা বসব কোথায়? খাব কী? আশ্বাস কিছু আছে বটে, কিন্তু এসব আশ্বাসের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। বেশ কিছু রাস্তা একেবারে শুনশান করে দিয়েছে পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী। সৌন্দর্য চলছে।
নয়াদিল্লির ভিআইপি এলাকায় ফুটপাথের গাছে ফুল, কিছুদূর অন্তর রঙিন স্বাগতম বোর্ড, বন্দুকধারী জওয়ান, টহলদারি। কিছু রাস্তা প্রায় অচল। কনভয়ের মহড়া, দিনরাত নাকা চেকিং। গোয়েন্দারা নাকি বলেছেন, জঙ্গি তৎপরতা হতে পারে। প্রায়শই মোড়ে মোড়ে চেকিং। সারারাত। জয়পুর, আগ্রা বা বাইরের কোনওদিক থেকেই দিল্লিতে সহজে ঢোকা যাচ্ছে না। দুর্গের মতো মুড়ে ফেলা হয়েছে। রাস্তা কখন কোনটা বন্ধ, কোনটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে ঠিক নেই। জি-২০’র ক’টা দিন সব বিক্ষোভ বন্ধ। অর্ধেক অফিস ছুটি। বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মীরা অধিকাংশই তিন-চারদিনের ছুটি নিয়ে দিল্লি ছেড়েছেন। জি২০-র হেভিওয়েট অতিথি রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য বিমানবন্দরেও তিনদিন ব্যাপক এলোমেলো হবে বিমান চলাচল। বড় হোটেল, যেখানে অতিথিরা থাকবেন, এলাহি সুসজ্জিত, নিরাপত্তা। দিল্লিতে রাস্তায় বেরোলেই বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা ঘটছে বটে। এমনিতেই ব্যাপক নির্মাণকাজের জন্য দ্রুত বদলাচ্ছে দিল্লি। তার উপর এই জি২০। গোল মার্কেটের ঐতিহাসিক বাজার চক্করটাও দেখলাম টিন দিয়ে ঘেরা। পুরনো কিছু কি আর থাকবে না? সংস্কার আসুক, আধুনিকতা আসুক, কিন্তু, কখনও বিভিন্ন নামে আধুনিকীকরণ প্রকল্প, কখনও জি২০-র মতো উচ্চমার্গের অধিবেশন, পুরনো সাধারণ লোকগুলো যাবে কোথায় বলতে পারেন?
[আরও পড়ুন: পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনা, ট্রেনে ওঠার সময় পড়ে দুই পা কাটা গেল ছাত্রীর]
আরও শুনবেন? লুটিয়েন দিল্লিটা যে শুধু দুর্গ হয়েছে তাই নয়, সাধারণ গরিব মানুষের হয়রানির একশেষ তো বটেই; প্রশাসন এখন রাস্তার কুকুর তুলছে। একদিকে লেমুরের ছবি বসাচ্ছে, অন্যদিকে যেখানে হনুমান, বাঁদর বেশি, সেগুলোকে তাড়াতে বাহিনী নেমেছে। বিদেশিদের কাছে বাঁদর চলে এলে যদি বিড়ম্বনা হয়! জয় বজরংবলী বলা দলের সরকারের তাণ্ডবে হনুমানের পাল দিশেহারা, তারাও উচ্ছেদের শিকার। ফুটপাথে হকার নেই, খেতে দেবে কে? পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগে ‘বিশ্বগুরু’ সাজতে যাওয়া নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) নাকি বলেছেন, “এই সম্মেলন আমজনতার আন্দোলনের প্রতীক। কংগ্রেস (Congress) জমানার ইভেন্টের মতো শুধু বিজ্ঞান ভবনে সীমাবদ্ধ নয়। এটা আমজনতার।”
কিন্তু, মোদির ছবিতে মোড়া রাতের আলোঝলমল দিল্লি দেশের আমজনতাকে বোঝাতেই তো পারছে না এই জি২০ খায় না মাথায় দেয়। এরকম সম্মেলন হয়তো দরকার। কিন্তু শুধু সম্মেলনে তো সাধারণের যন্ত্রণার মূল সমস্যাগুলো দূর করা যাচ্ছে না। উলটে আয়োজন ও প্রচারে হাজার হাজার কোটির খরচ। এতে লাভ হবে কার? এখনও পর্যন্ত যা হিসাব, তাতে মোদিজির ব্যক্তিগত প্রচার আর কিছু ফাইভ স্টার হোটেলের। তার বাইরে একটা বড় কয়েক হাজার কোটি খরচের হুজুগ আর আমজনতার হয়রানি ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।