শম্পালী মৌলিক: আপাতত মেগা-বিয়ে পর্বের সমাপ্তি। পরে লন্ডনে রয়েছে অনন্ত আম্বানি আর রাধিকা মার্চেন্টের পোস্ট ওয়েডিং সেলিব্রেশন। গত শুক্রবার থেকে অজস্র রংদার মুহূর্ত সামনে এসেছে। সারা দেশের চর্চায় ছিল এই বিয়ে। রাজনীতি, গ্ল্যামার জগৎ, ক্রীড়া জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ-বিদেশ থেকে যোগ দিয়েছেন। মহা-উদযাপনে বাংলা-যোগও উজ্জ্বল। ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় এবং অনামিকা খান্নার পোশাক পরেছিলেন নবদম্পতি বিশেষ দিনে। টলিউড থেকে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, রিয়া সেন, রাইমা সেন, রুক্মিণী মৈত্র, নুসরত জাহান-যশ দাশগুপ্ত, সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়কে দেখা গিয়েছিল বিয়ে বাড়িতে। তবে বাংলা-যোগ এখানেই শেষ নয়। রিসেপশন অনুষ্ঠানের সমাপ্তির পর দিন কথা বললেন ভিস্যুয়াল আর্টিস্ট অনিকেত মিত্র।

কলকাতার ছেলে অনিকেত এই ইভেন্টের প্রারম্ভিক পর্ব থেকেই জড়িয়ে ছিলেন। ‘শুভ আশীর্বাদ’-এর ক্রিয়েটিভ ভিস্যুয়াল ডিজাইনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। প্রচারবিমুখ অনিকেত প্রথমেই জানালেন, গোটা বিষয়টাই তাঁর কাছে স্বপ্নের মতো। একটু ভেবে শুরু করলেন–“শুরু থেকেই আমি ছবি আঁকি। এখনও ছবি এঁকে সংসার চলে। এখানে মূলত কাজ করেছি ১৩ জুলাই ‘শুভ আশীর্বাদ’ অনুষ্ঠানের। আমি এবং আমার স্ত্রী প্রিয়মের (আগরওয়াল) দায়িত্ব ছিল সেদিনেরই। যেদিন প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উপস্থিত ছিলেন, থ্রি ডি লাইট প্রোজেকশনের কাজটা আমরা করেছি। মূল অনুষ্ঠান যেখানে হচ্ছে, তার পাশে বিয়ে উপলক্ষে যে সেট-টা তৈরি করা হয়েছিল, তার ওপর লাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এর মাধ্যমে একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করি। প্রধানত আমরা ওখানে বৈকুণ্ঠলোক দেখিয়েছিলাম। এই পুরো অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফি করছিলেন শ্রুতি মার্চেন্ট আর বৈভবী মার্চেন্ট, ওঁরা দুই বোন। আমাকে ওঁর টিম থেকেই যোগাযোগ করা হয়েছিল। এর আগে আমি বৈভবী ম্যামের সঙ্গে ‘পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে কাজ করেছিলাম। রিলায়েন্স অস্ট্রেলিয়া থেকে একটি সংস্থাকে নিয়ে এসেছিল, যারা মেনলি টেকনিক্যালিটিস দিয়ে আমাদের প্রচণ্ড সাহায্য করে। যে প্রোজেশন কীভাবে হবে, বা লাইটিং কীভাবে হবে। আমি এবং আমার স্ত্রী প্রিয়ম মিলে পুরো ভিস্যুয়াল ডিজাইন করেছিলাম। যে অ্যাক্ট ওয়াইজ কী কী দেখাব, বা কেমন এলিমেন্ট আমরা ব্যবহার করব ইত্যাদি। ইট ওয়াজ অ্যান অ্যামেজিং জার্নি। মিউজিকের দায়িত্বে ছিলেন অজয়-অতুল। আমরা যখন প্রজেকশন করছি, বিখ্যাত কয়েকজন ধ্রুপদী শিল্পী পারফর্ম করলেন। আমরা প্রায় বিগত দুমাস ধরে এটার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেছি।”
[আরও পড়ুন: অনন্ত-রাধিকার সন্তানের অপেক্ষা! শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে এ কী মন্তব্য সলমনের? ]
কলকাতার গভর্মেন্ট আর্ট কলেজে অনিকেতের পড়াশোনা। কর্পোরেট জগতে ব্র্যান্ড ডিজাইনার হিসাবে কেরিয়ার শুরু। তারপর কনসেপ্ট ও স্টোরি বোর্ড আর্টিস্ট হিসাবে বহু নামী সংস্থায় কাজ করেছেন। এই মুহূর্তে যশরাজ ফিল্মস, ধর্মা প্রোডাকশন, রাজ অ্যান্ড ডিকে ইত্যাদি বিভিন্ন প্রোডাকশের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। এর আগে তিনি বড় ছবির মধ্যে মণিরত্নমের ‘পন্নিইন সেলভান’-এ অ্যাকশন স্টোরি বোর্ড করেছেন শ্যাম কৌশলের সঙ্গে। ‘পৃথ্বীরাজ’-এ স্টোরি বোর্ড, অ্যাকশন, কনসেপ্ট আর্ট, ওয়েপন ডিজাইন– এবং ‘মুঞ্জ্যা’ ছবিটির কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।
এই শহরে এখনও অনিকেতের শিকড়। তাঁর মা, দাদা-বৌদি এই এখানেই থাকেন। উত্তর কলকাতার কুমারটুলির খুব কাছেই তাঁর বাড়ি। এখন যদিও অনিকেত মূলত মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই কাজ করেন। ২০১৭ সালে এ কলকাতা ছেড়েছেন। হেসে বললেন, ‘আমি কোনওদিন ভাবিনি এরকম কিছু কাজ করার সুযোগ পাব, এটা খুবই অন্যরকম অভিজ্ঞতা। সিনেমা নয়, এটা অনেক বেশি রিয়্যাল। কারণ আমরা যেটা ডিজাইন করেছি তাতে প্রচণ্ড প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। এত মানুষের সামনে আমাদের কাজটা দেখানো হবে, তাই বিশেষ যত্ন আর সতর্কতার প্রয়োজন ছিল।’
এই মেগা ইভেন্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সেরা মুহূর্ত কোনটা? অনিকেত একটু থেমে বললেন, ‘একদিন আমাদের অ্যান্টিলিয়া-তে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে রাত্রিবেলা বসে আমি পুরো কাজগুলো দেখাই। তখন মধ্যরাত হবে। নীতা ম্যাম এবং মুকেশ স্যরকে দেখাই বিস্তারিত ভাবে। আমাদের সঙ্গে শ্রুতি ম্যাম এবং বৈভবী ম্যাম-ও ছিলেন। ওঁদের আমরা পুরোটা বিশদে বলি। কাজগুলো ওঁদের বেশ পছন্দ হয়। একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, যেখানে প্রধামন্ত্রী, শঙ্করাচার্যরা উপস্থিত থাকবেন এবং আরও বিশিষ্টজনরা, সেখানে আমাদের আর্ট ওয়ার্ক দেখানো হবে– ফলে তার আনন্দ এবং দায়িত্ব কতখানি ছিল বুঝতেই পারছেন। ওঁদের সঙ্গে কথোপকথন থেকে, আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি, ওঁরা এমন খ্যাতির শীর্ষে, এত বিরাট ব্যক্তিত্ব হয়েও, ওঁরা ভীষণ হাম্বল, মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ। ওঁদের আতিথেয়তার কোনও তুলনা নেই। আমাদের মিটিংগুলো বেশিরভাগ দিনই রাতে অ্যান্টিলিয়াতে হত। মুকেশ স্যর, নীতা ম্যাম দুজনেই প্রাণশক্তিতে ভরপুর। প্রচণ্ড পরিশ্রমী এবং প্রতিটি খুটিনাটি জিনিস তাঁদের নখদর্পণে। মুকেশ স্যর একটাই অনুরোধ করেছিলেন, আমরা যেন এই প্রজেকশনে কোনও ভাবে ধীরুভাইয়ের ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারি। সেটা আমরা করতে পেরেছিলাম। ওই মুহূর্তে উনি খুবই ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন।”
অনিকেত যখন কলকাতায় চাকরি করতেন মুম্বইয়ে শিফট করার প্ল্যান ছিল না। সেটা ২০১৬-১৭ হবে। তাঁর শর্ট ফিল্ম ‘আতর’ মুম্বইয়ে একটি কম্পিটিশনে জায়গা পায়, যেটার আয়োজক ছিল রিলায়েন্স জিও। ‘মামি’র সঙ্গে ওরা প্ল্যান করেছিল। সেখানে একমাত্র বাংলা ছবি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায় সেটা ছিল অনিকেতের ‘আতর’। সেই প্রথম তাঁর কাছে মুম্বই যাওয়ার ডাক আসে। “সারা রাত জেগে কাগজে সিনেমাটা এঁকেছিলাম। যেটা ছবির প্রেজেন্টেশনে দেখিয়েছিলাম। ওখানে আমি ছাড়া সকলেই প্রায় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন মুকেশ ছাবড়া। ঘটনাচক্রে তাঁর প্রথম ছবি ‘দিল বেচারা’র স্টোরি বোর্ডের জন্য আমাকে ডেকে নেন। আর সেই সময় আমার শর্ট ফিল্মের জন্য সার্টিফিকেটটা পাই। যেখানে নীতা আম্বানির সই করা ছিল। আজ মনে হয় একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।” বলে একটু থামলেন অনিকেত।
টেনশন কতটা ছিল জিজ্ঞেস করতে হেসে ফেললেন অনিকেত, “আমি তো এর আগে এই ধরনের কাজ করিনি। ওখানে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার ওপর মানুষ বিশ্বাস করছে এবং তারা সেই সুযোগটা দিচ্ছে। আর আমার স্ত্রীও প্রচণ্ড ভাবে আমাকে সাপোর্ট করেছে। আমাদের আলাদা কোনও টিম নেই। আমি আর ও (প্রিয়ম) দুজনে মিলেই কাজটা করি। দুজনে এত বড় মাপের ভিস্যুয়ালের কাজটা করতে পারব তো, ভাবনা ছিল। তাছাড়া অস্ট্রেলিয়ার টিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময় ম্যাচ করিয়ে কাজটা করতে হচ্ছিল। আমরা এখান থেকে ডিজাইন করে ওদের পাঠাতাম। তাদের কল নেওয়া, ব্রিফ দেওয়া সবটাই বুঝেশুনে করতে হয়েছে। হিন্দু পুরাণকে আমরা ছবিতে তুলে আনছিলাম, সেখানে আমাদের ব্রিফিং প্রপারলি হতেই হত। ফলে ভালই টেনশন ছিল। থ্যাঙ্কফুলি সব ভালভাবে মিটে গিয়েছে। আমরা অনুষ্ঠানের প্রতিদিনই জিও ওয়ার্ল্ড কনভেনশন সেন্টারে উপস্থিত ছিলাম। আর বুঝতে পারছিলাম কেমন মহাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। শুরুতে কেউ জানতও না, আমি এই কাজটার সঙ্গে যুক্ত। সবই হল। একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল। আমার বাবা দেখে যেতে পারলেন না। বাবার আমার মুম্বইয়ের বাড়িতেও আসা হয়নি। ওঁকে হারাই ২০২০ সালে। আজকে সারা দেশ থেকে শুভেচ্ছা পাচ্ছি, শুধু বাবার ফোনটা এল না।”