১৪ বছর পর আবার বাংলা ছবিতে ফিরলেন শর্মিলা ঠাকুর। পয়লা বৈশাখের মুখে আসছে তাঁর অভিনীত 'পুরাতন'। দিল্লি থেকে ধরা দিলেন তিনি। শুনলেন শম্পালী মৌলিক।

কিছুদিন আগে 'নায়ক'-এর পুনর্মুক্তি হল। রেস্টোর্ড ভার্সন দেখলাম বড়পর্দায়। সত্যজিৎ রায়ের এই ছবি পুরনো হয় না। প্রত্যেকবার নতুন কিছু শেখার। দিল্লিতে আপনার কী দেখার। সুযোগ বা ইচ্ছে আছে?
- হ্যাঁ, আমি তো বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে মিলে ছবিটা দেখতে গেলাম। এত ভালো লাগল কী বলব। বিগ স্ক্রিনে দেখার একটা ব্যাপার আছে। সেই কবে দেখেছি, প্রায় ষাট বছরের পুরনো ছবি। এখন দেখতে গিয়ে ভীষন ভালো লাগল। নিজেকেও ভালো লাগল। উত্তমবাবু তো দারুণ। সুমিতা সান্যাল একটা ছোট্ট পার্টে কী দারুণ অভিনয় করলেন। সুব্রত মিত্রের কাজ, তার পর বংশীবাবুর কাজ, কী যে ভালো লাগল বোঝাতে পারব না।
আপনি শেষবার বাংলা ছবি করেছিলেন ২০০৯ সালে। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরির 'অন্তহীন'। তার প্রায় ১৪ বছর পর সুমন ঘোষের 'পুরাতন'-এ কাজ করলেন। ছবিটা করতে রাজি হওয়ার কী কী কারণ?
- প্রথম কারণ তো ঋতুপর্ণা, ও আমাকে বলেছিল, 'তোমাকে ভেবে খুব ভালো একটা রোল লেখা হয়েছে, পাঠাব।' ওটা যখন এল, আমার খুব ভালো লাগে। শি ইজ আ ওয়ান্ডারফুল প্রোডিউসার অ্যান্ড অ্যাক্টর। আমি ভাবলাম ওর সঙ্গে কাজ করে খুব ভালো লাগবে আর তাই হল। সুমনের অনেক ছবি আমি দেখেছি, ওর 'কাদম্বরী', 'বসু পরিবার' খুব ভালো লেগেছিল। ওর সঙ্গে একটা কাজের সুযোগ পেলাম, সেটাও খুব ভালো লাগল। এই ছবিটা করে আমার এত ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়। এখন জানি না দর্শকের কেমন লাগবে। আর একটা ব্যাপার হল, আমার স্ক্রিপ্টটা খুব ভালো লেগেছে। এই ছবিতে যে ধরনের রোল করেছি, সেটা পড়ে আমার বেশ লেগেছে। আর কাজ করেও খুব আনন্দ পেয়েছি।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এই ছবির প্রযোজক এবং আপনার মেয়ের চরিত্রে। মা-মেয়ের সম্পর্ক এই ছবির শিরদাঁড়া। কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
- খুব ভালো লেগেছে। আমরা অনেক কঠিন দৃশ্য করেছি। আমার প্রথম দিনের কাজও ঋতুপর্ণার সঙ্গে হয়েছে। নিজেদের টাইমিং ইত্যাদি যেমন হওয়া উচিত তেমন ছিল। আর প্রযোজক হিসাবে তো সবরকমের বন্দোবস্ত করেছে ঋতুপর্ণা। আমাদের একটু দূরে লোকেশন ছিল। সেখানে পৌঁছনো এবং ভ্যানিটির বাবস্থা করা, সময় মতো লাঞ্চ ব্রেক করা, সবকিছুই নিখুঁত ছিল। কোনও কমপ্লেন করার সুযোগ পাইনি (হাসি)।
কিছুদিন আগে আপনার ৮০তম জন্মদিন গেল। এই ছবিতে আপনার যে চরিত্র তাঁর বয়সও ৮০। এটা কি কাকতালীয়? এই বয়সেও আপনি অভান্ত গ্রেসফুল। কীভাবে সম্ভব করলেন?
- সেইটা তোমরা বলো, যে গ্রেসফুল। আমি জানি না। খাবারদাবার একটু হয়তো রেগুলেট করতে হয়, একটু হয়তো এক্সারসাইজ। আর ভালো ভালো কথা ভাবতে হয়, নো নেগেটিভ থটস (হাসি)।
আপনার সাক্ষাৎকার পড়লে বা শুনলে বোঝা যায়, সব বিষয়ে খবরাখবর রাখেন এখনও। দিনগুলো এখন কীভাবে কাটে?
- একটু তো খবরাখবর রাখতেই হয়, নইলে কথা বলার কোনও টপিক পাওয়া যায় না, তাই না? দিনগুলো বেশ ভালোই কাটে। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব রয়েছে। অনেক বিষয়ে আমার ইন্টারেস্ট। ছবি দেখতে ভালোবাসি, দিল্লি শহরে অনেক কিছু হয়- লেকচার, এগজিবিশন, স্টেজ পারফর্ম্যান্স বা গানবাজনার অনুষ্ঠান হয়। অনেক ইন্টারেস্টিং লোকজনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আসে। এখানে অনেক বাইরের এমব্যাসিও আছে, ইউকে, কানাডা বা আমেরিকার। সেখানে গেলে তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। মোটামুটি দিনগুলো ভালোই কেটে যায়।
এখন বৃদ্ধ বয়সের কমন সমস্যা ডিমেনশিয়া। সেটা আপনাকে কখনও ভাবায়?
- না, ভেবে কোনও লাভ নেই, নিজেকে এনগেজ রাখতে হয়। মনে হয় ইয়ং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা করা উচিত। সব এরিয়াতে একটু পড়াশোনা করা দরকার। ডিমেনশিয়া অনেক সময় জেনেটিক-ও হয়। এনগেজ থাকা সত্ত্বেও হতে পারে, কিন্তু সেটা ভেবে কোনও লাভ নেই। আর এখন অনেক কিছু করা যায়, আই থিঙ্ক ইউ ক্যান ডিলে দ্য প্রসেস। ন্যাচারালি সবারই ভয় লাগে। ডিমেনশিয়া নিয়ে। ভয় লাগারই কথা। জানি না কী করে প্রিভেন্ট করা যায়, বাট সো ফার সো গুড।
ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত ছবিতে ঋতুপর্ণার স্বামীর চরিত্রে। আপনার সঙ্গেও তাঁর দৃশ্য রয়েছে। তাঁকে কেমন লাগল?
- ইন্দ্রনীল ছবিতে অন্যরকম একটা এনার্জি নিয়ে আসে। ছবিতে একটা ওয়েল ট্র্যাভেলড, ওয়েল এক্সপোজড ছেলে সে। আর একটু অবাঙালি ভাব আছে, সেটাও খুব ভালো লাগে। বাঙালি পরিবেশে একটু অন্যরকম, যার নট জাস্ট বাঙালি এক্সপোজার হয়েছে, অবাঙালি এক্সপোজার-ও হয়েছে। তেমন চরিত্রে খুব ভালো মানিয়েছে ইন্দ্রনীলকে। ও যেমন ভাবে হাঁটেচলে, কথা বলে তার মধ্যে একটা স্মার্টনেস আছে। সেটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
এখনকার বাংলা ছবি দেখা হয়? আপনি যে সময় বাংলায় কাজ করেছেন, তার সঙ্গে কতটা তফাত খুঁজে পেলেন?
- দেখা হয়। তখনও আমি খুব ভালো পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছি। তপন সিনহা, অজয় কর, তাঁরা খুবই ভালো ছিলেন। এখনকার টপিকগুলো বদলে গিয়েছে, একটু অন্য ধরনের ছবি হচ্ছে, আরও আধুনিক। বা ধরো 'ময়ূরাক্ষী'র মতো ছবি হচ্ছে, ওটাও ডিমেনশিয়া নিয়ে। ভালো ভালো ছবি দেখছি বাংলায়।
কলকাতা কখনও মিস করেন। আর বাংলা ছবি করবেন?
-কলকাতা আমার খুবই প্রিয়। শহর, কলকাতায় আসতে খুব ভালো লাগে। এখানকার খাবার, রাস্তাঘাট, ভিড় সবই পছন্দ আমার। কলকাতায় আমি অনেকদিন থেকেছি। এখনও একজন খুব ভালো বান্ধবী আছেন, তাঁর বাড়িতেই উঠি, শহরে গেলে। খুব ভালো লাগে কলকাতার সবকিছু। আর ছবি করার ব্যাপারে জানি না। এই ছবিটা করে খুব আনন্দ পেয়েছি। যদি সেরকম ছবি আসে, হয়তো চেষ্টা করব। শরীরে কুলোলে নিশ্চয়ই করব।
শুটিংয়ের বিশেষ কোনও ভালো স্মৃতি?
- সেই সময় আমি যেখানে থাকতাম সেখান থেকে প্রায় দুঘন্টার রাস্তা, টিনিগড়ের কাছে শুটিং ছিল। আমার জার্নি একেবারে সার্থক হয়ে যেত, যখন আমি লোকেশনে পৌঁছতাম। এত সুন্দর লোকেশন। গঙ্গার ঘাট, গঙ্গার হাওয়া কী সুন্দর লাগত। আর বাড়িটাও ছিল খুব পুরনো। বাড়ির গা জড়িয়ে ঘন ঘন শিকড় যেন একেবারে ভিতরে ঢুকে গিয়েছে, এমনকী বারান্দার মধ্যেও। ইট ওয়াজ আ পারফেক্ট লোকেশন ফর 'পুরাতন'। ও সব দেখে আমার মনটা ভালো হয়ে যেত। পুরো টিম খুব ভালো ছিল। রাতের বেলা ভীষন মশা, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা ভীষণ আনন্দ করেছি।
আপনার বাঙালি দর্শক যাঁরা অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন ১৪ বছর পরে বাংলার মেয়ের বাংলা ছবি দেখতে, তাঁদের জন্য কী বলবেন? ১১ এপ্রিল 'পুরাতন' মুক্তি।
- আশা করি দর্শকের আমার ছবি ভালো লাগবে, আমার অভিনয় ভালো লাগবে। সেটাই আমার প্রার্থনা। আর আমি বাংলা ভাষায় অভিনয় করে খুব আনন্দ পেয়েছি। কারণ নিজের ভাষায় অভিনয়ে যে আনন্দ আছে, সেটা হিন্দিতে বা ইংরেজিতে করে সেরকম নেই। সেই জন্য এই ছবিটা আমার খুবই স্পেশাল। আর দর্শকের যদি ভালো লাগে, আমি খুব খুশি হব।