‘আপনারাও আসুন!’ এমনই বার্তা স্পেনে গিয়ে বাংলার শিল্পমহলের। বরেণ্য শিল্পপতিরা তুলে ধরছেন বাম আমলের অসংগতির কথাও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বিদেশসফর নিয়ে যথারীতি তিরিক্ষি সিপিএম নেতারা! তা, শিল্পমহল যে-প্রসঙ্গে বামেদের সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঢালাও সার্টিফিকেট দিচ্ছে, সে-প্রসঙ্গে হঠাৎ কমরেডরা বাক্যিহারা কেন? লিখছেন কুণাল ঘোষ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সফরসঙ্গীদের যেভাবে আক্রমণে ব্যস্ত বিরোধীরা, বিশেষত সিপিএম, তা রীতিমতো হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই ছোট-বড় বাম নেতারা মুখ্যমন্ত্রীকে, তাঁর সফরকে নিয়ে, এমনকী, মিডিয়াকে নিয়ে আক্রমণে ব্যস্ত থাকলেও একটি জরুরি বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি সেই বিষয়টিতে আগে ঢুকতে চাই।
মুখ্যমন্ত্রীর এবারের শিল্পসফরের বিশেষ লক্ষণীয় ছিল সঙ্গে যাওয়া প্রতিনিধি দলে এ-রাজ্যের শিল্পপতিরা। মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, দুবাই– তিন শহরেই তাঁরা অনেকেই বক্তৃতা দেন। এঁরা সরকারের পক্ষে বলবেন, সেটা খানিকটা স্বাভাবিকই। কথা হল, কী বলছেন।
সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, হর্ষ নেওটিয়া, উমেশ চৌধুরী, সঞ্জয় বুধিয়া থেকে প্রত্যেকেই একবাক্যে বললেন, বাংলার কর্মসংস্কৃতি বদলেছে। ধর্মঘট, ঘেরাও, বন্ধ, অশান্তি নেই। শ্রমদিবস নষ্ট হয় না। নেগেটিভ ট্রেড ইউনিয়নিজম শেষ, এখন যা হয় পজিটিভ ট্রেড ইউনিয়নিজম। মুখ্যমন্ত্রী মাত্র একটা ‘মেসেজ’ দূরে, কিছু জানলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেন। আরপিজি, নেওটিয়া, টিটাগড়, আইটিসি, রিলায়েন্স-সহ একের-পর-এক গোষ্ঠীর শীর্ষকর্তারা বলেছেন, ‘আমরা দারুণভাবে ব্যবসা করছি বাংলায়। আপনারাও আসুন।’ সঞ্জীব গোয়েঙ্কার মতো নক্ষত্র শিল্পপতি বলেছেন, ‘৩৪ বছরের উপেক্ষা, অবহেলা, ভুল পরিকল্পনার পর এখন নিরাপদ হাতে বাংলা।’
[আরও পড়ুন: গোবরেও ‘দুর্নীতি’ কংগ্রেসের, ভোটমুখী ছত্তিশগড়ে নয়া তির মোদির]
কাট টু ২০০৫। সিঙ্গাপুর। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর শিল্পসফর। বণিকসভার অনুষ্ঠান। এখানকার শিল্পপতি আর সাংবাদিকদের কাছ থেকে একের-পর-এক প্রশ্ন, বাংলায় তো উগ্র ট্রেড ইউনিয়নিজম। কথায়-কথায় লেবার প্রবলেম। ওখানে শিল্পপতিরা যাবেন কেন? চোখের সামনে দেখেছি বুদ্ধবাবুর অস্বস্তি। একবার তো মুখ্যমন্ত্রীকে আড়াল করতে এই সঞ্জীব গোয়েঙ্কাকেই মাইক হাতে নিয়ে জোড়াতালির উত্তর দিয়ে মুখরক্ষা করতে হয়েছিল। তারপর বুদ্ধবাবু চালিয়ে ব্যাট করে নিজেকে পার্টির থেকে আলাদা করতে সেই যে শ্রমিক শ্রেণির উদ্দেশে বলে বসলেন, ‘পারফর্ম অর পেরিশ’, তারপর আর ভাঙা কাচ জোড়া লাগেনি। বুদ্ধবাবু একদিকে; পার্টি আর বামফ্রন্ট আর-একদিকে দিকে চলেছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে উলটো। এক, তিনি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ করেন। দুই, গোটা সরকার আর পার্টি তাঁর সঙ্গে। ঘরের মধ্যে পিছুটানের ব্যাপার নেই।
সঞ্জীব গোয়েঙ্কা তাই প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘এখন স্বচ্ছ, গতিশীল প্রশাসন। একবার সিদ্ধান্ত নিলে সেই কাজ ঘড়ির কাঁটার মতো এগিয়ে যায়।’
আর খোদ মুখ্যমন্ত্রীও এই পরিবর্তনের জায়গাগুলিই বারবার তুলে ধরেছেন শিল্পসভাগুলিতে– ‘আমাদের ওখানে এখন বন্ধ, ধর্মঘট, অশান্তি নেই। শ্রমদিবস নষ্ট হয় না। দক্ষ কর্মী পাওয়া যায়। শিল্পের জন্য ল্যান্ড
ম্যাপ, ল্যান্ড ব্যাঙ্ক আছে। বিভিন্ন ধরনের শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর।’
[আরও পড়ুন: আফজল খাঁকে হারিয়েছিলেন এই অস্ত্রে, শিবাজির সেই ‘বাঘনখ’ এবার ফিরছে দেশে]
এই কথাগুলো সিপিএমের কোনও মুখ্যমন্ত্রী শিল্পমহলকে বলতে পারেননি। শ্রম অশান্তির অভিযোগ থেকে কোনও দিন বেরতে পারেনি বামফ্রন্ট সরকার।
আমার কৌতূহল, আজকের মুখ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফর নিয়ে সিপিএম নেতারা এত কথা বলছেন; কিন্তু শিল্পমহল যে প্রসঙ্গে বামেদের সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঢালাও সার্টিফিকেট দিচ্ছে, সে-প্রসঙ্গে হঠাৎ কমরেডরা বাক্যিহারা কেন? তাঁরা কি অপ্রিয় সত্যটাকে মেনেই নিচ্ছেন?
****
সাংবাদিক হিসাবে আমার কয়েকজন নেতার সঙ্গে কলকাতা বা রাজ্যের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
প্রথম নাম, জ্যোতি বসু। তাঁর সঙ্গে ঠিক ‘সফরসঙ্গী’ কথাটা বলা যায় না, বলা যাক সহযাত্রী। দার্জিলিং-সহ বেশ ক’টি জেলা এবং দিল্লি সফর, বিশেষত তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যানের সময়টা। দুরন্ত অভিজ্ঞতা।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সফরসঙ্গী হয়েছি সিঙ্গাপুর, জাকার্তায়। দেশের মধ্যে রাজস্থানে। দারুণ সহযোগিতা পেয়েছি। বাম-জমানায় শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের নেতৃত্বে বাংলার একটি প্রতিনিধি দল চিন ও হংকং সফরে গিয়েছিল। আমি সেই দলের একমাত্র মিডিয়া সদস্য ছিলাম।
প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি যখন বিদেশমন্ত্রী, তখন তাঁর ১৬ আসনের বিশেষ বিমানে তাঁর সফরসঙ্গী হিসাবে মরিশাস গিয়েছি।
প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি যখন কেন্দ্রে জলসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী, তখন তাঁর সফরসঙ্গী হিসাবে ঢাকা গিয়েছি।
‘সফরসঙ্গী’ বিষয়টি শুনতে ভাল, সাংবাদিকতায় বেশ সম্মানজনক এবং রোমাঞ্চকর। অ্যাডভেঞ্চারাস কেস বটে। কিন্তু, সমান চাপের এবং ঝামেলার। কারণ, যা হচ্ছে, তার কপি পাঠানোটা বড় কাজ।
অতীতে টেলেক্স, ট্রাঙ্ক টেলিফোন। তারপর ক্রমশ এসটিডি, ফ্যাক্স, এখন মেল, হোয়াটসঅ্যাপ। আগে টেলিগ্রাফ অফিসে ছুটতে হত, পরে এসটিডি বুথ, এখন হাতের ফোন বা ল্যাপটপ। কিন্তু, কাজও তো বাড়ছে। আগে দৈনিক কাগজের জন্য সন্ধেয় একটা কপি পাঠালেই হত। তারপর ক্রমে সান্ধ্য এল। সকালেও কপি চাই। এখন টিভি চ্যানেল, পোর্টাল, ইউটিউব চ্যানেল– সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে খবর, ভিডিও তুলতে হবে। তীব্র প্রতিযোগিতা। মাদ্রিদে মর্নিং ওয়াকে পার্কে হঁাটছেন মুখ্যমন্ত্রী। চারপাশ দেখব কী! একটু এগিয়ে ভিডিও করছি– ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, মাদ্রিদেও সকালে হঁাটতে বেরিয়ে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।’ ভিডিও
আগে ছাড়তে হবে। কলকাতা থেকে ডিজিটাল তাগাদা দিচ্ছে।
[আরও পড়ুন: দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি! বন্ধ হয়ে গেল নয়াদিল্লির আফগান দূতাবাস]
সাংবাদিকদের মধ্য কপির প্রতিযোগিতাটাও একটা সুন্দর লড়াই। খবরে ঝাড়, আগে খবর দিয়ে ঝাড়, অ্যাঙ্গেলে ঝাড়, লেখার মুনশিয়ানায় ঝাড়, ছবিতে ঝাড়। তারকা চরিত্র এবং তাঁকে ঘিরে ঘটনাক্রম হয়তো প্রত্যেকের চোখের সামনেই। কিন্তু কে কোথা থেকে ছিপ ফেলছে, কেউ জানে না। বোঝা যায় পরে। হাসি-হাসি মুখের গ্রুপ ছবি দেখে পেশাদার লড়াইয়ের চাপটা বোঝা সম্ভব নয়।
****
মুখ্যমন্ত্রীর এবারের সফরের প্রাপ্তি কী? বিরোধীরা যতই নেতিবাচক কুৎসা করুন, নিশ্চিতভাবেই কিছু প্রাপ্তি স্পষ্ট চেহারায় দেখা যাচ্ছে। যেমন, এক) ‘লা লিগা’-র সঙ্গে চুক্তি। এতে ময়দানের ফুটবল উপকৃত হবে। ফুটবল পরিকাঠামোটা একেবারে শিকড় থেকে গড়ে উঠবে। এদের জন্য কিশোরভারতী স্টেডিয়ামটাও বরাদ্দ করার কথা ভেবে ফেলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। খোদ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও দেখলাম লা লিগা-র ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী। দুই) ‘লুলু’ গোষ্ঠীর লগ্নি একাধিক ক্ষেত্রে। তিন) মহামেডান স্পোর্টিংয়ের স্পনসরশিপে ‘লুলু’ গোষ্ঠীর আগ্রহ। চার) শিলিগুড়িতে পিসিএম গোষ্ঠীর কারখানা সম্প্রসারণ এবং নতুন কারখানার লগ্নি। পাঁচ) মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার একাধিক সংস্থার সঙ্গে বাংলার একাধিক সংস্থার সরাসরি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে লগ্নি, যেটা দুবাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এর পরবর্তী ধাপ নভেম্বরে কলকাতায় বিজিবিএসে বোঝা যাবে। কিন্তু এখন যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, সেটাও যথেষ্ট। জ্যোতিবাবু কখনও বিদেশ সফরের পর এই হিসাব দেখাতে পারেননি।
****
আমার একটি ভারি পুরনো, প্রিয় টি-শার্ট আছে, যেটিকে দেখলেই চেনা যায়। এবার, স্পেন যাওয়ার আগে একটা কথা মনে হল, ওটা নিলাম, পরে গেলাম, পরপর দু’দিন পরলাম। সঙ্গে মোবাইলে তৈরি রাখলাম একটা পুরনো ছবি। প্রথম দু’দিন দুবাই আর মাদ্রিদের ছবি পোস্ট করতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় জেগে উঠল সিপিএমের কিছু অতৃপ্ত আত্মা। শিল্প আনার সফরে আমি কেন গিয়েছি, ওখানে আমার কী কাজ, এসব। ফেসবুক ট্রোলিংয়ের চেষ্টা, যা আমার কাছে বিনোদন। আমি তো এইটার জন্যই ওই টি-শার্ট পরে ঘুরছি। অতঃপর ছবি দুটো ‘পোস্ট’ করলাম। একটা টাটকা। অন্যটা হল ওই টি-শার্ট পরেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে জাকার্তা শিল্পসফরে। লিখে দিলাম, একই টি-শার্ট। ওখানেও একই কাজে গিয়েছিলাম। ব্যস! তারপর থেকে সিপিএমের একাংশের এই নিয়ে পোস্ট বন্ধ। আরে, এই ধরনের টুরে সাংবাদিকদের নেওয়া হয় সাংবাদিকতা করার জন্যই। হাতে একটা ফোন থাকলেই কি কিছু লোকের তালজ্ঞান লোপ পায়?
****
এবারের সফর শুরু হতে না হতে বুঝলাম কিছু ব্যক্তি ভয়ানক ঈর্ষাকাতর, সংকীর্ণমনা আক্রমণ চালাচ্ছেন। এত নিম্নরুচির আক্রমণ আগে ছিল না। সফররত সাংবাদিকদের একটি গ্রুপ ছবি ‘পোস্ট’ করেছিলাম। কেউ কেউ সেটা দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রটিয়ে দিল, সাংবাদিকরা সরকারের বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশ সফরে গিয়েছে। অনেকে নানা বিপ্লবী মতামতও লিখল– ‘আমাদের করের টাকায় ওরা কেন যাবে?’ বুঝলাম একাংশের মধ্যে নীতিজ্ঞানের থেকেও এখন ঈর্ষা বেশি কাজ করছে। ওরা বিদেশ যাচ্ছে, তা-ও নিজের খরচে নয়, মার শালা খিস্তি। এই হল সোশ্যাল মিডিয়ার ভেড়ার পাল। ঠিক না ভুল, জানার দরকার নেই। বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলাম। বাস্তব হল, সাংবাদিকরা সরকারের খরচে সফরে যাননি। সাংবাদিকরা সরকারের আমন্ত্রণে প্রতিনিধি দলে গিয়েছেন। কিন্তু, তাঁদের যাবতীয় খরচ দিয়েছে যাঁর-যাঁর অফিস। ফলে এই তথ্যটি না-জেনে স্রেফ গাত্রদাহে মিথ্যাচার করে সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাটাকে খামকা আরেকটু নষ্ট করলেন কতিপয় অযোগ্য পরশ্রীকাতর।
****
মাদ্রিদ ছিল ঠান্ডা ঠান্ডা। মেঘ-বৃষ্টি পেয়েছি। একদিন তো রাস্তায় শীত করছিল। বার্সেলোনা রোদ ঝলমল, ঠিকঠাক। আর দুবাই উদোম গরম, চুয়াল্লিশ। স্পেন টিপিকাল ইউরোপ। দুবাই মরুভূমির বুকে মানব সভ্যতার আবিষ্কার। এখানে দুবাই মলের বাইরে রোস্ট করে দেওয়া চুয়াল্লিশ, ভেতরে আইস স্কেটিং! মাদ্রিদের জাদুঘরে সম্মোহিনী শক্তি নিয়ে দঁাড়িয়ে আছে পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’, দুবাইয়ে চোখ-ধঁাধানো মলের মধে্য পেল্লায় অ্যাকোয়ারিয়ামে ঘুরছে বিরাট হাঙর। বার্সেলোনায় ক্লাবের মিউজিয়ামে মেসি গ্যালারিটাই জাদুঘর, দুবাইয়ে শেখের প্রাসাদের সামনে সাতটা সোনার ঘোড়া। মাদ্রিদ যদি মেঘলা মোড়কে প্রাচীন আভিজাত্যের হাতছানি দেয়, বুর্জ খলিফার উচ্চতা ঘোষণা করছে দুবাইয়ের আধুনিক প্রযুক্তির উচ্ছ্বাস। আর, মুগ্ধ হলাম, মাদ্রিদ দেখাল বঙ্গ-প্যারিস যৌথ ভাষায় রবীন্দ্রসংগীত ‘মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি’ থেকে দুবাইয়ের বঙ্গ-আরবি যৌথ ভাষায় রবীন্দ্রগান ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ শুনে। স্পেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা; দুবাই মরুর বুকে আধুনিকতার কলমে আঁকা। বৈপরীত্য, তবে আকর্ষণে কেউ কম যায় না। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর শিল্পসফরের কাজ করেছেন।
আমরাও আমাদের মূল কাজ করেছি। কিন্তু তার বাইরে যতটুকু দেখার চেষ্টা করা যায় নতুন জায়গা, চোখ খুলে, মন খুলে তা-ও করেছি। অভিজ্ঞতা বাড়ে। সমৃদ্ধ হই। জীবনে স্বর্গ-নরক সবই তো দেখা হল, দেখা চলছে। স্বর্গের পাল্লা ভারী হলে সৌভাগ্যবান মনে হয়।
****
দুবাই তো বটেই, মাদ্রিদ, বার্সেলোনাতেও বাঙালির ছড়াছড়ি। তবে হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গীয় যত, তার থেকে বাংলাদেশি বঙ্গভাষী বেশি। তা হোক। বাঙালি তো! স্পেনে তো একেবারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির রাস্তা, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা। গণিত বিশেষজ্ঞ কেশব নাগের নাতির ছেলের উপস্থিতি প্রবাসী সম্মেলনে বার্সেলোনায়। এখানকার বঙ্গ সমিতির সভাপতি সঞ্জয় দাশগুপ্ত দারুণ তথ্য দিলেন, ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন বলতে আমাদের মাত্র চারজনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছিল। তার বেশি বাড়ছিল না। দিদি আসার খবরে উৎসাহ বেড়ে আট হল। তারপর এই ক’দিনে ১০৮ পার। রোজ বাড়ছে। এবার বড় করে দুর্গাপুজো হবে।’
সঞ্জয়বাবুর একাধিক রেস্তরাঁ আছে। একটির নাম ‘রঙ্গোলি’, সমুদ্রতটে। একদিন নৈশভোজ ওখানেই। শিল্পবৈঠকের পর। প্রবাসীর অনুরোধ, একবার পায়ের ধুলো দিতেই হবে দিদিকে। দিদি গেলেন। ছিলেন সামান্য কিছুক্ষণ। দিদির জন্য সঞ্জয়ের স্পেশাল মেনু: ফুচকা আর ঝালমুড়ি।
****
একটা অদ্ভুত অনুভূতির কথা লিখছি।
আমার বিদেশ সফর ২০০৫ সালে লন্ডন দিয়ে শুরু, এয়ার ইন্ডিয়ার আমন্ত্রণে। একাধিকবার লন্ডন, সিঙ্গাপুর গিয়েছি। আর গিয়েছি জাকার্তা, ঢাকা, চিন, হংকং, মরিশাস, মালদ্বীপ। এরপর জীবনে কালবৈশাখী, সব তছনছ। অপরাধ না করেও কলঙ্কিত, কারাবন্দি। ভয়ানক যন্ত্রণার সেই জীবন।
ধ্বংসের দিকে তিলে-তিলে।
আর কোনওরকমে বেঁচে থাকার লড়াই।
দমদম কিংবা প্রেসিডেন্সি জেলের সেলের উঠোন থেকে একফালি যে-আকাশটা দেখা যেত, সেখানে কোনও প্লেন দেখা গেলে চকিতে মনে পড়ত মেঘের সাম্রাজ্যের কথা, ফেলে আসা দিনের কথা। মনে প্রশ্ন আসত, আমি কি শেষ? না কি আমি এখনও আছি? জেদ বলত, থাকতে হবে, বাঁচতে হবে, আবার ওই প্লেন থেকেই ভূপৃষ্ঠ দেখতে হবে।
এই জানুয়ারিতে প্রথমে ‘নানইয়াং পলিটেকনিক’-এর আমন্ত্রণে সিঙ্গাপুর; আর এবার ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর কনসাল্টিং এডিটর হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে স্পেন, দুবাই– পুরোদস্তুর এক সাংবাদিকের ভূমিকায় আবার বিদেশে– ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা পাচ্ছি না। জীবনের নাগরদোলা কি একেই বলে! ভবিষ্যতে কপালে কী আছে, জানি না। কিন্তু আপাতত এই সেকেন্ড ইনিংসের ব্যাটিং চলতে থাকুক। অবিরাম এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছি। ধাবমান এক অবধারিত কাল তার জাল বিস্তার করে ঘিরেছে আমাকে। ভেসে আসছে চক্রে পিষ্ট আঁধারের বক্ষ ফাটা তারার ক্রন্দন। পরিবর্তনের ঘূর্ণি যেন অজস্র মৃত্যুকে পার করে নিয়ে চলেছে এক অদ্ভুত সকালের দিকে। এক নতুন গ্রামে এই সকালটা হচ্ছে। এখানে প্রতিটি মুখ, প্রতিটি মুখোশের তফাত আমি জানি। আমি এদের চিনি। কিন্তু ওরা আমাকে চিনতে পারে না; ঘূর্ণিতে আমার পুরনো নামটাও কবেই ভেসে গিয়েছে। এখন যে রয়েছে, সে আমার মতো, আমার ভূমিকায়, কিন্তু পুরনো আমি আর নেই।
সে কবেই মরে গিয়েছে!