কিংশুক প্রামাণিক: মে দিবস আজ। একটা সময় ছিল এই দিনে রক্তপতাকায় উদ্বেল হত বাংলা। কলকারখানার গেট থেকে পার্টি অফিসের শহিদ বেদি– সর্বত্র মুষ্টিবদ্ধ হাত সংগ্রামের গান গাইত। কত মিছিল হত সেদিন রাজ্যে!
মে দিবস এখন নিখাদ এক ছুটির দিন। শনি-রবির সঙ্গে একটি-দু’টি সিএল অ্যাডজাস্ট করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার দিন। কমিউনিস্ট পার্টিগুলির রমরমা নেই। ঘটা করে মে দিবস আর পালন করবে কে? কমরেডরা গেরুয়া শিবিরে নাম লেখাচ্ছেন। কারখানার গেটে, সিটুর অফিসের রং বদলে গিয়েছে। উড়ছে তেরঙা পতাকা। সেই লালে লাল বাংলা নেই। দেশে আজ বামপন্থার বড়ই প্রয়োজন। কিন্তু বামপন্থীদের কোমর ভেঙে গিয়েছে।
অ-বাম দলগুলির মে দিবস পালনের দায়বদ্ধতা নেই। বামেরা দুর্বল হওয়ায় ঐতিহাসিক দিনটির ঐতিহ্য ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। আলাদা করে চেনা যায় না। বেশ মনে আছে, এই দিনে বিশাল মিছিল থেকে আওয়াজ উঠত, ‘মে দিবস দিচ্ছে ডাক, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘শ্রমিকের হাতিয়ার, বামফ্রন্ট সরকার।’
মে মাস মানেই ভোটের মাস। বিধানসভা অথবা লোকসভা ভোটের বছর মে দিবসের মিছিল হয়ে উঠত পুরোদস্তুর রাজনীতিময়। স্থানীয় প্রার্থীকে ভোটে জেতার ডাক দিয়ে মিছিলে স্লোগান দেওয়া হত ‘মে দিবসে শপথ নাও, কংগ্রেসের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।’ রাজীব গান্ধী তখন ক্ষমতায়। পরে নরসিমা রাও। মিছিলের স্লোগান শুনে মনে হত, যত দোষ সব কংগ্রেসের। ওদের তাড়াতে পারলেই মে দিবসের তাৎপর্য যথার্থ হবে। দেশে প্রতিষ্ঠা হবে শ্রমিকের অধিকার।
রাজ্যে সর্বত্র না হলেও আজও বিক্ষিপ্তভাবে মে দিবসের মিছিল বের হয়। বদলে গিয়েছে স্লোগান। কংগ্রেসের ‘কালো’ হাত এখন ‘ভাল’। ওদের সঙ্গে ভোটের জোটও এখন হয়। তাই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রা নয়। এখন কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায়, রাজ্যে তৃণমূল। তাই ওদের ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।’ তার মানে এটাই দাঁড়াও যে, ক্ষমতায় থাকলে যত বিরোধ। না থাকলে সাত খুন মাফ। নীতি বড় কথা নয়। জোট করে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষ প্লেনাম ডাকারও দরকার নেই। কংগ্রেস অতীতে ‘শ্রেণিশত্রু’ ছিল, এখন নয়। তাই তাকে সমর্থন করা যায়। যারা ক্ষমতায় তারাই এখন শত্রু। রাজ্যে তৃণমূল, কেন্দ্রে বিজেপি।
কী অদ্ভুত!
কংগ্রেস কি তাদের নীতি বদলেছে? না। কংগ্রেস কি অতীতের ভুল স্বীকার করেছে? না। কংগ্রেস কি বলেছে গরিবের কথা বলবে? না। তাহলে? আজ যে শ্রেণিশত্রু, কাল সে শ্রেণিমিত্র হল কী করে?
বস্তুত, কমিউনিস্ট আদর্শ শিকেয় তুলে ক্ষমতায় থাকা না-থাকার দ্বন্দ্বেই দেশের বামদলগুলি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা। মোদি সরকারের উপর ক্রুদ্ধ দেশে কৃষকদের লং মার্চের নেতৃত্ব দিল বামেরা। কিন্তু ভোটের ময়দানে ক্ষীর খেয়ে নিল কংগ্রেস। বামেদের কেউ ভোটই দিল না। তিন রাজ্য পেল কংগ্রেস।
অর্থাৎ, বামেদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হবে কি না, তা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। ক্ষমতা পেলে কী করা উচিত, ক্ষমতা না থাকলে কী করা উচিত, তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্ত নেই। জলে নামব, কিন্তু বেণি ভেজাব না। কখনও বেণি ভেজাব, কিন্তু জলে হাত দেব না। রাজ্যে সরকার গড়ব, কেন্দ্রে সেই সুযোগ এলে নেব না। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছে, তাদের ‘বুর্জোয়া’ বলব, কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হলে তারই হাত ধরব স্রেফ আসন জেতার জন্য। এটা কি একটা কমিউনিস্ট পার্টির কাজ!
এই দ্বিমুখী পথের জন্য গোটা দেশে বামেদের সমর্থন কমে গিয়েছে। এবারের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিরোধী শক্তির যে সমন্বয়, সেখানে বামেরা থাকলেও গলা তুলে কথা বলার ক্ষমতা তাদের নেই। সবাই বুঝে গিয়েছে বামেরা এমন কিছু আসন পাবে না। ফলে তাদের তোয়াজ করছে না কেউ। অথচ একসময় জ্যোতি বসুর মতামত নিতে দিল্লি থেকে বিরোধী নেতারা ছুটে আসতেন কলকাতায়। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করা হত। বসু নেই। এখন বামেদের কেউ পাত্তাই দেয় না।
লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় কংগ্রেসের হাত ধরার জন্য কী আকুলতা! বিধানসভা ভোট থেকে শিক্ষা নেওয়া হল না। ওই ভোটে বামপন্থীরা জোট ধর্ম মেনে কংগ্রেসকে ভোট দিল। কিন্তু কংগ্রেস সমর্থকরা একটি ভোটও বাম প্রার্থীদের দিল না। ফলত, বামেদের দ্বিগুণ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হল কংগ্রেস।
এরপরও জোটের চেষ্টা কেন?
যেন কংগ্রেস তার নীতি পালটে ফেলেছে। বদলে গিয়েছেন রাজ্যের নেতারা। প্রথম থেকে বোঝা যাচ্ছিল প্রদেশ কংগ্রেস জোট করবে না। তবু আসন ছেড়ে রেখে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হল।
তিনটি নির্বাচন আগেও বহরমপুরে অধীর চৌধুরীকে হারানোর জন্য ২৫-৩০ জন মন্ত্রীকে নিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রচারে জেতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা। অধীর তখন ছিলেন প্রধান শত্রু। সেই অধীর মনে মনে এখন হাসেন, যখন দেখেন তাঁকে ভোট দেওয়ার জন্য এবার বামফ্রন্টকেই ভেঙে দিলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। বামসঙ্গী আরএসপি প্রার্থীকে একঘরে করা হল।
প্রশ্ন হল, অধীর জিতলে সিপিএমের কী লাভ? তিনি কি বদলেছেন? একদমই না। তিনি যেমন ছিলেন তেমন আছেন। কেনই বা বদলাবেন? তিনি তো সিপিএম করতে যাননি। তাঁর সুনাম হোক অথবা দুর্নাম, বামফ্রন্ট শাসনের সময় যা ছিল, তাই আছে। বরং তিনি দেখলেন, একদিন যে-সিপিএম তাঁকে ‘গুন্ডা’ বলত, আজ বলছে ‘কমরেড’! লাল ব্যানারে তাঁর নাম লিখে বলছে, ‘ভোট দিন ভোট দিন, মুর্শিদাবাদের রবিনহুড অধীর চৌধুরীকে ভোট দিন।’
এত সবের আসল কারণ, তৃণমূল যেন বহরমপুর জিতে না যায়। জিতলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত? বিজেপি তো জিতছে না। বলতে দ্বিধা নেই, বহরমপুরে ভাগীরথীর জলে বামপন্থার এই বিসর্জন নিয়েও একদিন ভুল স্বীকার হবে। উগ্র তৃণমূল বিরোধিতা চলছে। আপত্তি নেই। শাসকের বিরুদ্ধে এমন হতেই পারে। কিন্তু এ-ও দেখতে হবে তৃণমূলকে ঠেকাতে গিয়ে বিজেপির বিরোধিতা যেন লঘু হয়ে না যায়। সেই বিপদ আরও অনেক বড়। মমতা শুধু বামেদের ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। বিজেপি কিন্তু ভিটেমাটি উচ্ছেদ করে দিতে পারে।
এই ভোট দিল্লির, বলা হচ্ছে রাজ্যে পতন হোক মমতার। প্রচারসভায় মোদির চেয়েও তাই বেশি আক্রান্ত মমতা। বিজেপির ডাকে বাম ভোট ব্যাঙ্ক ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে নজর নেই। এলাকায় পার্টির নেতা দাঁড়িয়ে থেকে বলছেন, ‘বিজেপিকে ভোট দিন। কিছুতেই তৃণমূলকে নয়।’ এ এক সর্বনাশা খেলা! অ-কমিউনিস্টসুলভ ঈর্ষা! বিজেপিকে বাংলায় বাড়াল কে? বিতর্ক পুরনো। বিজেপির বাড়বাড়ন্তের জন্য সিপিএম নেতারা তৃণমূলকে আক্রমণ করেন। মজার কথা হল, একসময় এইভাবেই আক্রান্ত হতেন রাজীব গান্ধী। বলা হত, অযোধ্যায় রাম লালার মন্দিরের তালা খুলে বিজেপিকে বাবরি ভাঙতে উৎসাহী করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।
এখন সেই কংগ্রেস ভাল, তৃণমূল খারাপ। কোনও দিন তৃণমূল ভাল হয়ে যাবে। অধীরকে ভোট দেওয়ার কথা বলে যে-দল, সেই দল মমতাকেও একদিন ভোট দিতে বলতে হতে পারে। রাজনীতি বহমান। কিছুই নির্দিষ্ট নয়। তৃণমূল তো অনন্ত কাল ক্ষমতায় থাকবে না। একদিন সরতে হবেই। সেদিন হবে তাদের সাত খুন মাফ। এই দ্বন্দ্বমূলক রাজনীতি নষ্ট করে দিল বামপন্থার যাবতীয় সম্ভাবনা। অসহায় কৃষক-শ্রমিক আর লাল পতাকায় ভরসা পায় না। তাই মে দিবস কেমন বর্ণহীন লাগে।
[ইস্টার হামলার জের, শ্রীলঙ্কায় বন্ধ জেহাদি জাকিরের পিস টিভির সম্প্রচার]
The post বর্ণহীন মে দিবস, আর লাল পতাকায় ভরসা পায় না কৃষক-শ্রমিক appeared first on Sangbad Pratidin.