উত্তরপ্রদেশে আমেঠিতে পারিবারিক আসনে হেরেছেন রাহুল। অদূর ভবিষ্যতে ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা এই রাজ্যে খুবই কম। সম্ভবত সে-কারণে এখন দক্ষিণ ভারত থেকে আসন বাড়াতেও অগ্রাধিকার দিচ্ছে কংগ্রেস। কিন্তু আসল কারণ হল, খাড়গে সাহেব রাহুল গান্ধীর খড়ম সিংহাসনে রেখে দল চালাতে প্রস্তুত। এহেন ‘জি হুজুর’ নায়েব মশাইদের এখন সর্বত্রই খুব বাজারদর। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
পুনরুক্তি সবসময় দোষের নয়। মল্লিকার্জুন খাড়গে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হলেন। গান্ধী পরিবারের কেউ দলের সভাপতি নন, এটা যে আগে কখনও হয়নি তা তো নয়, একাধিকবার হয়েছে। কিন্তু গান্ধী পরিবারের নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত হতে কখনওই পারেনি এই শতাব্দীপ্রাচীন দলটি। এবারও দলের সাংগঠনিক নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার কিছু আগে স্বয়ং রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-য় অন্ধ্রপ্রদেশে সাংবাদিক বৈঠক করে বললেন, ‘কংগ্রেস সভাপতির ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে মন্তব্য করতে পারব না। খাড়গেজি-ই বলবেন। আর আমার ভূমিকা কী হবে, তা নতুন কংগ্রেস সভাপতি ঠিক করবেন।’
ফল-ঘোষণার আগেই রাহুল কীভাবে বলে দিলেন, খাড়গেই নতুন সভাপতি? একবার নয়, দু’টি ভিন্ন প্রশ্নে সাংবাদিকদের কাছে রাহুল এ-কথা বললেন। মনে হয় না, রাহুল গান্ধী খুব সচেতনভাবে বলেছেন। আসলে তিনি ‘ট্যাক্টফুল’ ছিলেন না। যখন কংগ্রেস বিজেপির মতো কৌশলগতভাবে পাল্টা ‘নাটকবাজি’, হিন্দিতে যাকে বলা হয় ‘নৌটঙ্কি’ করতে চাইছে, তখন পুরো চিত্রনাট্য-ই তো অনুসরণ করার কথা। রাজনীতির বিপণনে এ হল রাহুলের এক ‘ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ’।
[আরও পড়ুন: ইউক্রেনে পরমাণু হামলা কি অনিবার্য?]
আসল ঘটনাটা কী? ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘ইহাও হয়, উহাও হয়’ না বলে মোদ্দা হাঁড়ির খবরটা কী? সেটা হল, গান্ধী পরিবারের হাতেই ‘রিমোট কন্ট্রোল’। খাড়গে দক্ষিণ ভারতের বর্ষীয়ান দলিত নেতা। হিন্দি বলয়ে বিজেপির (BJP) দাপট, এদিকে উত্তরপ্রদেশে আমেঠির মতো পারিবারিক আসনে হেরেছেন রাহুল। অদূর ভবিষ্যতে ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা এই রাজ্যে খুবই কম। সম্ভবত সে-কারণে এখন দক্ষিণ ভারত থেকে আসন বাড়াতেও অগ্রাধিকার দিচ্ছে কংগ্রেস। কিন্তু আসল কারণ হল, খাড়গে রাহুলের খড়ম সিংহাসনে রেখে দল চালাতে প্রস্তুত। এহেন ‘জি হুজুর’ নায়েব মশাইদের এখন সর্বত্রই খুব বাজারদর। বিসিসিআই থেকে রাজনৈতিক দল, এমনকী কর্পোরেট সংস্থাতেও। ‘কল আ স্পেড আ স্পেড’- এই কথা বলার দিন ফুরল। খাড়গেকে যদি এক সপ্তাহ পরে বলা হয় আপনি ইস্তফা দিন, তিনি হয়তো সেকেন্ডের মধ্যে তা দিয়ে দেবেন। কমল নাথ, দিগ্বিজয় সিং, পি. চিদম্বরম থেকে শুরু করে শচীন পাইলট- এত অনুগত ব্যক্তিত্ব পাওয়া দুষ্কর। তাই তো লোকসভা হারিয়েও তিনি রাজ্যসভায় আসেন। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যসভার নেতাও হন। অতএব, সহজ-সরল সত্য হল ‘রিমোট কন্ট্রোল তত্ত্ব’ ষোলো আনার উপর আঠারো আনা-ই সত্য।
বিজেপির শীর্ষ নেতারা, মায় নরেন্দ্র মোদি প্রধান টার্গেট করেছেন রাহুল গান্ধীকে। আজ নয়, সেই প্রথম দিন থেকেই। কংগ্রেস-মুক্ত ভারত মানে গান্ধী পরিবারমুক্ত ভারত। এই প্রচারে প্রধান বিরোধী দলকে কার্যত ভোঁতা করে দিয়েছেন তিনি। নেহরু দর্শনের মোকাবিলায় পাল্টা সংঘ-আখ্যানের সঙ্গে এই রাহুল গান্ধী-বিরোধিতা- তাঁকে নিয়ে সারাক্ষণ হাসি-ঠাট্টা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-কটাক্ষ- এটা বেশ ভাল ‘প্যাকেজ’। সবশেষে এর সঙ্গে যোগ হয় মা ও ছেলের বিরুদ্ধে সিবিআই ও এনফোর্সমেন্ট তদন্ত। দেশজুড়ে তাতে বিজেপি-সংঘ সমর্থক বড় আহ্লাদিত। রাহুল গান্ধীর (Rahul Gandhi) বিরোধিতা আর ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি বেশ ভাল কড়াপাক। বক্সিং খেলার প্রশিক্ষণের সময় একটা বালির বস্তা লাগে। প্র্যাকটিসের সময় তাতে রোজ ঘুষি মারে বক্সাররা। গান্ধী পরিবার ছিল এই বালির বস্তা। আপাতত, এই বস্তাটিকে সরিয়ে দেওয়া-ই কংগ্রেসের কৌশল।
সেটা কি বাস্তবায়িত হবে? আমার মনে হয়, কংগ্রেসের লাভ উনিশ-বিশ। লাভ হত, যদি সত্যি সত্যিই পট্টভি সীতারামাইয়া-র বদলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তিত্ব আসতেন। সে তো ১৯৩৯ সালের কথা। এমনকী ’৫০ সালে নেহরু-ঘোষিত প্রার্থী আচার্য কৃপালনী-কে হারিয়েছিলেন পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন। ২০২২ সালের দৃশ্যপট তো আলাদা। এখন গান্ধী পরিবার বিনে গীত নাই। শুধু গান্ধী পরিবারকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই। কংগ্রেস নেতারাও তো মানসিকভাবে গান্ধী পরিবারের কর্তৃত্ব ছাড়া দিশাহারা। খাঁচার পাখি ওয়ার্কিং কমিটির মহামান্য সদস্যগণ। ‘যা রে, যা রে উড়ে পাখি, যা রে পাখি’- বললেও তারা উড়তে পারে আর কই? বহু বছর আগে প্রমোদ মহাজন একবার আমাকে বলছিলেন, কংগ্রেসের শক্তি-ই তাদের দুর্বলতা। কংগ্রেসে গান্ধী পরিবার হল দলের মস্ত বড় ‘সিমেন্টিং ফ্যাক্টর’। তারা যা বলবে, সবাই তা নতমস্তকে মেনে নেবেন। এটা কিন্তু একনায়কতন্ত্র। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনও লালকৃষ্ণ আদবানি, যশবন্ত সিন্হা, আরএসএস নেতা সুদর্শন- অন্তত চার-পাঁচজন নেতার মতামত থাকত। কংগ্রেস কতটা সরে এসেছে এই সংস্কৃতি থেকে?
বিজেপিতেও অবশ্য সাংগঠনিক নির্বাচনের এই প্রক্রিয়া এখন অদৃশ্য। কমিউনিস্ট দলে তবু পার্টি কংগ্রেস থেকে রাজ্য ও জেলা সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আছে। যদিও হাত-তোলা সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই নেতা ঠিক হয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ মনে পড়ে? যেখানে বোর্ড বৈঠকে হারীন চট্টোপাধ্যায় ঘুমিয়ে পড়তেন, আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পাশের লোকটা হাতটা তুলে দিতেন- মনে পড়ে?
এখানেও তা-ই। বিজেপি প্রচারের বিপণনে এখনও সিদ্ধহস্ত। এই ‘রিমোট কন্ট্রোল’ নিয়েই প্রচারকে তারা তুঙ্গে নিয়ে যাবে। তবু ভাল- কংগ্রেসে কিছু একটা হয়েছে, আমরা আলোচনা করছি। লিখছি। বৃদ্ধি যখন চূড়ান্ত নেতিবাচক অবস্থানে চলে যায়, তখন শূন্যের পর আর কী হবে? যা হবে, কংগ্রেসের ভালই হবে। যাকে বলে শূন্যর চেয়ে এক সংখ্যা বেশি। দেখা যাক, খাড়গে বুড়ো হাড়ে কী ভেলকি দেখান!