shono
Advertisement

কোভিড আমলে বদলেছে পৃথিবী, মূল্যবৃদ্ধির ‘ভ্রম’সামলাতে ব্যস্ত উন্নত দেশগুলি

অধ্যাপক গীতা গোপীনাথের মতে, উন্নত অর্থনীতির দেশে যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
Posted: 03:41 PM Aug 07, 2021Updated: 02:02 PM Aug 09, 2021

ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, রাশিয়া ও তুরস্ক মূল্যবৃদ্ধি রুখতে সুদের হার বাড়িয়েছে। অধ্যাপক গীতা গোপীনাথের মতে, উন্নত অর্থনীতির দেশে যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তার একটি কারণ, গত বছরের পণ্যমূল্যের পতন। ফলে, এই বছরের কিছুটা স্বাভাবিক পণ্যমূল্য ও পর্যটন, হোটেল, বিনোদন সংক্রান্ত শিল্পের মূল্যবৃদ্ধিকে মূল্যবৃদ্ধি বলে ‘ভ্রম’ হচ্ছে। লিখছেন দীপঙ্কর দাশগুপ্ত

Advertisement

ন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও গবেষণা বিভাগের অধিকর্তা গীতা গোপীনাথ তাঁর জুলাই মাসের ব্লগে বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা জাতীয় মতামত প্রকাশ করেছেন। যে-ছবিটি তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে, তা খুবই উদ্বেগের। মুক্তির উপায় নিয়েও তিনি ভাবনাচিন্তা করেছেন, কিন্তু নিশ্চিত কোনও রাস্তা যে নেই এমন ইঙ্গিতই যেন তাঁর লেখায় খুঁজে পাওয়া যায়।

তাঁর সংস্থার এপ্রিল মাসে অনুমান ছিল, ২০২১-এ বিশ্ব অর্থনীতি ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। জুলাই মাসে সেই সংখ্যা আপাতদৃষ্টিতে পরিবর্তিত না হলেও কিছুটা আশঙ্কা জাগিয়েছে। আগের হিসাবের তুলনায় ধনী দেশগুলির বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশ বেশি হবে বলে এখন মনে হচ্ছে, আর তার পাশাপাশি উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশ কমবে। ফলে, মোট বৃদ্ধির সংখ্যা এক থাকলেও, বৈষম্যের বিচারে, বিশ্বের অর্থনীতির আরও অবনতি হতে পারে। উপরন্তু ২০২২-এ বৈষম্য আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, কারণ ধনী দেশগুলির বৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের বৃদ্ধির চেয়ে অনেকটা বেশি হতে চলেছে।

[আরও পড়ুন: বিরোধী ঐক্যের জমি প্রস্তুতির কেন্দ্রে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই?]

অধ্যাপক গোপীনাথ আরও জানাচ্ছেন যে, এগিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশে মাথাপিছু আয় প্রাক‌-অতিমারী অবস্থার তুলনায় ২০২০-’২২ সময়কালে ২.৮ শতাংশ কমবে। চিন বাদে কম-অগ্রসর অর্থনীতির দেশে মাথাপিছু আয় কমবে ৬.৩ শতাংশ। এই বৈপরীত্যের একটি কারণ ডেল্টা স্ট্রেনের মোকাবিলা সারা বিশ্বে সমানভাবে করতে পারার বিফলতা।

সংখ্যা বলছে, উন্নত দেশগুলিতে ৪০ শতাংশ মানুষের পুরোপুরি টিকা নেওয়া হয়ে গিয়েছে। উদীয়মান অর্থনীতিতে হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ, আর গরিব দেশগুলিতে পুরো টিকা পেয়েছে নগণ্য- ১.২ শতাংশ। দ্রুত টিকাকরণের ফলে অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক অবস্থায় যে সমস্ত দেশ প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছে, তাদের সম্পর্কে মুদ্রাভাণ্ডার আশাবাদী। যেখানে টিকার অভাব ঘটেছে এবং নতুন করে করোনা ঢেউ আছড়ে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংস্থা চিন্তিত। এই অর্থনীতিগুলির মধ্যে ভারতকেও শ্রেণিভুক্ত করেছে।

রাজকোষ-নীতির সহায়তার ফলে উন্নত অর্থনীতিগুলির সুবিধা হয়েছে। তারা ২০২১ থেকে শুরু করে ৪.৬ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অপরদিকে অনগ্রসর দেশগুলির এই জাতীয় খরচ ২০২০-তেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, রাশিয়া ও তুরস্ক মূল্যবৃদ্ধি রুখতে আর্থিক নীতি অবলম্বন করেছে, অর্থাৎ সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি অবশ্য উন্নত দেশগুলিতেও দেখা দিয়েছে, চাহিদা-জোগানের অসংগতির কারণে। কিন্তু অধ্যাপক গোপীনাথের মতে, এ সমস্ত দেশে মূল্যবৃদ্ধি হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তার একটি কারণ হল গত বছরের পণ্যমূল্যের পতন। ফলে এই বছরের কিছুটা স্বাভাবিক পণ্যমূল্য ও পর্যটন, হোটেল, বিনোদন সংক্রান্ত শিল্পের মূল্যবৃদ্ধিকে মূল্যবৃদ্ধি বলে ‘ভ্রম’ হচ্ছে। করোনা যত নিয়ন্ত্রণে আসবে, এই কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা তত কমবে।

একটি সতর্কবার্তাও রয়েছে এর সঙ্গে। সব হিসাবই তো অনুমানভিত্তিক। তাই অনিশ্চয়তা রয়েই যাবে। এছাড়া পণ্যের জোগান এখনও স্বাভাবিক নয়, ধনী দেশে গৃহমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মূল্যবৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী হলেও আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই। উপরন্তু উদীয়মান অর্থনীতির দেশে খাদ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্ব বাজারে তাদের মুদ্রার ক্রয়মূল্য কমে গিয়ে খনিজ তেল ইত্যাদির আমদানির খরচ বাড়ছে। ফলে এই সমস্ত দেশে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যুদ্ধ চলতে থাকবে। আর ধনী দেশ যদি মূল্যবৃদ্ধি আয়ত্তে আনতে পারে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি যদি সে-কাজে অসফল হয়, তবে মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হবে।

টিকাকরণের কাজ যদি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে এমন হতেই পারে যে দুর্ভাবনা কিছুটা কমবে। কিন্তু যদি করোনা ভাইরাস নিত্যনতুন স্ট্রেন আরও তৈরি হতে থাকে, তবে আশার চেয়ে নিরাশার সম্ভাবনা বেশি। গীতা গোপীনাথের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্ব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে ৪.৫ লক্ষ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। এরই সঙ্গে যদি মার্কিন দেশে আর্থিক নীতি আরও আঁটসাঁট হতে শুরু করে, অর্থাৎ সুদের হার উঠতে থাকে, তবে অতিমারীর হাত ধরে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলি আরও বেশি ধাক্কা খেতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে তাদের ঘুরে দাঁড়াতে কতকাল লাগবে, সেটা অনুমান করা কঠিন।

মুদ্রা ভাণ্ডার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা- প্রত্যেকেই মনে করে ২০২১-এর মধ্যে সমস্ত দেশে ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া এবং ২০২২-এর মাঝামাঝির মধ্যে ৬০ শতাংশকে টিকা দিতে পারলে বিপদ কিছুটা কমবে। কিন্তু এই পথে যাওয়ার জন্য ২০২১-এর মধ্যে অন্তত ১০০ কোটি ডোজ টিকা সমগ্র পৃথিবীর দরকার। টিকার আমদানি-রপ্তানি সহজ করা, যেসব দেশে উদ্বৃত্ত টিকা রয়েছে তা অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দেওয়া এবং করোনা পরীক্ষা ও তার চিকিৎসার জন্য অন্তত ২৫০০ কোটি ডলার খরচ এখন অত্যাবশ্যক কাজ। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক ঋণের জালে যে-দেশগুলি ডুবতে বসেছে তাদের বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়াও প্রয়োজন। ঋণ শোধ করতে গিয়ে যদি তারা স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি নজর না দিতে পারে, তবে আবারও বৈষম্যের ফাঁদে আরও বেশি জড়িয়ে পড়বে।

বৈষম্য চিরদিনই ছিল, কিন্তু করোনা এসে তাকে বোধহয় আরও অনেক ভয়াবহ করে তুলেছে। বিভীষিকায় জর্জরিত বিশ্ব অর্থনীতিকে সুস্থ করে তুলতে বিশাল অর্থনৈতিক যজ্ঞের প্রয়োজন। সেই যজ্ঞ কীভাবে সংগঠিত হবে, তা একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইএসআই কলকাতার অর্থনীতির ভূতপূর্ব অধ্যাপক
d.dasgupta@gmail.com

[আরও পড়ুন: বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস নয়]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement