গৌতম ব্রহ্ম: কেষ্টপুর খালে যাত্রীবোঝাই বাস পড়ে যাওয়া হোক বা নন্দরাম মার্কেটের বিধ্বংসী আগুন। পোস্তার সেতুভঙ্গ হোক বা বাগরি মার্কেট, স্টিফেন কোর্টের জতুগৃহ। বিপর্যয়ের সংবাদ শুধু পেতে দেরি। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছেন অকুস্থলে। নিজের জীবন বিপন্ন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দুর্গতদের প্রাণরক্ষায়। কখনও আবার উদ্ধারকারী দমকলকর্মীকেই উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কারসাজিতে যে নিজেই এমন ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবেন, কে ভেবেছিল?
টানা ৩৮ দিন সিসিইউ, ভেন্টিলেশন, কোমা, মৃত্যুর সঙ্গে প্রাণপণ দড়ি টানাটানি। অবশেষে সেই জীবনযুদ্ধেও জিতে একটি নজির খাড়া করে ফেলেছেন বাহান্ন বছরের নিতাইদাস মুখোপাধ্যায়। এতদিন কোমা এবং ভেন্টিলেশনে থাকার পর কোনও কোভিড পজিটিভ রোগী বিপন্মুক্ত হতে পারেননি। “বোধহয় কোমায় থাকার সময়ও লড়াই করেছি! বিপদের সঙ্গে লড়াই করাই তো আমার অভ্যাস!”, দুর্বল শরীরেও রসিকতা করতে ছাড়লেন না। কে বলবে, কোভিডের ছোবলে টানা ২২ দিন কোমায় ছিলেন? নাকে-মুখে ঘাড়ে নল গুঁজে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল? কীভাবে হল সে অসাধ্যসাধন? ‘সংবাদ প্রতিদিন’কে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন টালিগঞ্জের লেক অ্যাভিনিউয়ের নিতাইবাবু।
কেমন আছেন?
– রোগমুক্ত। তবে হাঁটাচলা করতে পারছি না। বসে খাওয়া-দাওয়া করতে পারছি।
হাসপাতালের অভিজ্ঞতা কেমন?
– দারুণ। আমরিতে অবিশ্বাস্য ভাল পরিষেবা পেয়েছি। ওরা না থাকলে আমি মৃত্যুর হাত এড়াতে পারতাম না।
রোগটা বাঁধালেন কীভাবে?
– জানলে কী আর বাঁধাতাম! সত্যি, জানি না। তবে লকডাউন শুরুর পর ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কাজ বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। কারণ, করোনা সামলানোর অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। যদিও কিছু সিনিয়রের সঙ্গে জোট বেঁধে মানুষকে খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দিচ্ছিলাম। সেখান থেকে হল কি না কে জানে? অনেকে বলছে, একটু সাবধান হলে নাকি এতটা বাড়াবাড়ি হত না। তাহলে শুনুন, বছর দু’য়েক আগে আমার নিউমোনিয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই আমি খুব সাবধানি। হাসপাতালে যাওয়ার আগে তিনজন ডাক্তারকে দেখিয়েছি। কেউ বুকের এক্স—রেও করতে বলেননি। শিশুমঙ্গলে গিয়ে এক্স-রে করে অবশেষে রোগটার পূর্বাভাস মেলে। আমরিতে গিয়ে জানতে পারি, ‘আমি কোভিড পজিটিভ’।
বিপদ নিয়েই তো আপনার কাজ-কারবার। খালে বাস পড়ে যাওয়া, বহুতল মার্কেট বা অফিসে আগুন, সবেতেই তো ‘টিম নিতাই’!
– হ্যাঁ, নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্ট, বাগরি। হালের তালতলার আগুনেও উদ্ধারকারীদের সঙ্গে দিনরাত ছিলাম। কিন্তু কখনও অকারণ ঝুঁকি নিয়ে টিমকে বিপদে ফেলিনি। বিপর্যয় নিয়ে কাজ করলেও আমি যথেষ্ট সাবধানি। ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া-এডস-আন্ত্রিক নিয়েও কাজ করেছি। কিন্ত মনে হচ্ছে, এই কোভিড—১৯ খুব লম্বা রেসের বুনো ঘোড়া। সহজে বাগ মানবে না।
ডাক্তারবাবুরা বলছেন, আপনার ফাইটিং স্পিরিট’ই এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছে।
– শুধু লড়াকু মনোভাব দিয়ে কি কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জেতা যায়? অস্ত্রশস্ত্র লাগবে না? ডাক্তারবাবুরা আমায় বাঁচাতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বোচ্চ অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। সতেরো জনের ডাক্তার-নার্সের টিম দিনরাত এক করে খেটেছে। কতবার যে মরণের দরজার কড়া নেড়ে ফিরে এসেছি!
বাইশ দিন কোমা, আটত্রিশ দিন ভেন্টিলেশন, আপনি না কি রেকর্ড গড়েছেন?
– হ্যাঁ, ডাক্তারবাবুরা তা-ই বলছেন দেখছি! তবে বেঁচে ফিরেছি, এটাই আমার কাছে বড় ব্যাপার। আমার এই সুস্থ হওয়াটা যদি সাধারণ মানুষকে বাড়তি সাহস জোগায়, মন্দ কী?
[আরও পড়ুন: নার্সিংহোম-হাসপাতালগুলিই করোনা সংক্রমণের ভরকেন্দ্র, অভিযোগ পেলেন পুরমন্ত্রী]
কতটা কঠিন ছিল এই লড়াই?
– দেখুন, আমি তো নাকে-মুখে নল গুঁজে রাজার হালে ছিলাম। বাড়ির লোকজনদের খুব টেনশন হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর কাকিমা রয়েছেন। ওঁরা মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। এর মধ্যে মাথা ঠান্ডা রেখে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছেন আমার স্ত্রী অপরাজিতা। ডাক্তার-নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুস্থ হয়ে শুনেছি, একদিন নাকি আমার ‘যাই যাই’ অবস্থা হয়েছিল। ডাক্তার-নার্সরা সব হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ওই পরিস্থিতি থেকে বেচেঁ ফেরাটা নাকি ম্যাজিক!
সেটাই তো বলছি! ম্যাজিকটা হল কী ভাবে?
– দেখুন, ভারতীয় ডাক্তাররা বিশ্বের সেরা। আমার নিউমোনিয়া ছিল। এই কারণেই এত দ্রুত আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। না হলে হয়তো আমিও প্রগতি ময়দান থানার বড়বাবুর মতো দশদিনের মাথায় হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু ফুসফুসের পুরনো সমস্যার সঙ্গে জোট বেঁধেই কোভিড এমন ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল। আমরা শুধু একটাই কাজ করেছি, ডাক্তার-নার্সের উপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করেছি। বোধহয় সেটাই মিরাকল করেছে।
ভারতে কোভিড সংক্রমণ নিয়ে আপনার রিডিং কী?
– দেখুন আমি আমেরিকায় গিয়েছি। ওখানে দু’টো বাড়ির মধ্যে কত ফারাক! আর এখানে? সবাই গা জড়াজড়ি করে থাকি। তা সত্ত্বেও কোভিড আমেরিকায় তাণ্ডব চালাচ্ছে। ভারতে কিন্তু এখনও সেভাবে সুবিধা করতে পারেনি। এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের ডাক্তারবাবুদের জন্যই। আমাদের দেশের চিকিৎসকরা কোভিডের রহস্য ধরে ফেলেছেন। তাই অন্য দেশের থেকে এখানে অনেক ভাল ট্রিটমেন্ট হচ্ছে।
কোনও ডাক্তারবাবুর কথা আলাদা করে বলবেন?
– ডা. শাশ্বতী সিনহা। এই ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ দিনরাত এক করে খেটেছেন। বাড়িতে ফেরার পরও রোজ খবর নিয়েছেন। আমি তো বলব, করোনা হেরেছে, আমরি জিতেছে।
আপনি তো জিতে গিয়েছেন। বাকিরা?
– এখন তো হুইলচেয়ার বন্দি হয়ে আছি। কোমরের নিচটা অসাড়। ফিজিওথেরাপি চলছে। ক’দিন পর নিজের পায়ে দাঁড়িয়েও পড়ব। আমার বিশ্বাস, করোনা যতই ভয়ংকর হোক। মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করে পারবে না। একটা সময় হতোদ্যম হয়ে পড়বে। পড়বেই।
[আরও পড়ুন: নার্সদের গণইস্তফা, স্বাস্থ্য পরিষেবায় সংকট কাটাতে মুখ্যসচিবকে চিঠি হাসপাতালগুলোর]
The post ‘টানা ৩৮ দিন সিসিইউ, ভেন্টিলেশন, কোমা’, করোনার সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরলেন প্রৌঢ় appeared first on Sangbad Pratidin.