অভিরূপ দাস: নোভেল করোনা ভাইরাস প্রবেশ করেছিল স্ত্রীর ফুসফুসে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বৈবাহিক সম্পর্কও তাই প্রশ্নের মুখে। সহধর্মিনীকে কার্যত ভুলেই গিয়েছেন স্বামী! হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া দুরস্ত, অর্ধেক সময় মোবাইল সুইচড অফ করে রাখছেন। এমন ঘটনায় হতভম্ব চিকিৎসককুল। করোনা আদৌ কোনও অসুখ না অপরাধ? এমন কাণ্ডে গুলিয়ে গিয়েছে সবটাই। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের ঘটনা। সল্টলেকের পুনম জয়সওয়ালের আচমকাই জ্বর আসে। সঙ্গে খুকখুকে কাশি। কোভিড টেস্ট করাতে দেখা যায় রিপোর্ট পজিটিভ। বছর পঁয়ত্রিশের তরুণী প্রথমটায় ভয়ই পেয়ে যান। এ অসুখে আইসোলেশনে থাকাই দস্তুর। কোলের সন্তান তাঁকে ছেড়ে কীভাবে থাকবে?
শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। অগত্যা স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, সন্তানকে ছেড়ে তাঁকে ভর্তি হতে হয় বাইপাসের ধারে মেডিকা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। টানা চোদ্দোদিন সেখানে চিকিৎসা চলে। ফের টেস্ট করালে কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। রোগীকে স্থানান্তরিত করা হয় মেডিকা সেফ হোমে। হাসপাতালের এক কর্মী জানিয়েছেন, “এর পরেই গন্ডগোলের শুরু। কম করে দশবার পুনমের স্বামীকে ফোন করে বলা হয় স্ত্রীকে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি নিতে আসেননি। একসময় ফোন ধরাই বন্ধ করে দেন।” এদিকে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এমতাবস্থায় বেড আটকে রাখা অত্যন্ত সমস্যার। পুনমের বাড়ির লোক নিতে আসছেন না দেখে বাধ্য হয়েই হাসপাতালের তরফ থেকে পূর্ব যাদবপুর থানায় যোগাযোগ করা হয়।
[আরও পড়ুন: দীর্ঘ পরিশ্রম সার্থক, প্রধানমন্ত্রীর হেলথ আই-কার্ড প্রকল্পের নেপথ্যে মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী]
পুলিশের ফোন যায় পুনমের স্বামীর কাছে। “অবিলম্বে স্ত্রীকে নিয়ে যান” এমন ধমকে দু’দিন আগে হাসপাতালে এসেছিলেন পুনমের স্বামী। তবে এবারও গন্ডগোল। হাসপাতালের বিল মিটিয়ে পুনমের স্বামী জানান, “আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসছি। ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলুন।” বাড়ি যাবে বলে তৈরি হয়ে বসেছিলেন পুনম। কিন্তু কোথায় স্বামী? টানা দু’ঘণ্টা অপেক্ষার পরেও ফিরে আসেননি স্বামী। করোনার কারণে পরিবার পরিত্যক্তা ওই মহিলাকে নিয়ে সমস্যায় মেডিকা হাসপাতাল। সূত্রের খবর হাসপাতালের পক্ষ থেকে মহিলাকে বলা হয়েছে, “আপনার বাপের বাড়ির ঠিকানা দিন। আমরা সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসব।” ভয়ার্ত কণ্ঠে মহিলার আকুতি, “দয়া করে আমায় বের করে দেবেন না। ওরা আমায় ঢুকতে দেবে না।” করোনা নিয়ে সচেতনতা প্রসারের কাজ যে এখনও সকলের কাছে পৌঁছয়নি এমন ঘটনাই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।
মেডিকা হাসপাতালের চেয়ারম্যান অলোক রায় জানিয়েছেন, “মানুষ পাগল হয়ে গিয়েছে। নিজের স্ত্রী, মা, বাবাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। একজন একাকী মহিলাকে কেউ এভাবে ছেড়ে চলে যায়? অসুখটা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই। এরকম চলতে থাকলে আমাদের চূড়ান্ত অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে।” করোনা নিয়ে অন্ধবিশ্বাস এই প্রথম নয়। এর আগেও দেখা গিয়েছে কোথাও করোনায় মৃতের দেহ পড়ে থাকছে দীর্ঘক্ষণ। কোথাও বা করোনা আক্রান্তকে একঘরে করছেন পাড়া প্রতিবেশীরা। এবার নিজের স্ত্রীকে ভুলে যেতে বসেছেন জীবনসঙ্গী! ডা. দীপ্তেন্দ্র সরকার এই অযথা আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরির জন্য দুষেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে। তাঁর কথায়, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সচেতনতা প্রসারের বিরোধিতা না করেও একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যে কোনও ধরনের প্রচারই যদি অতিপ্রচারে পরিণত হয়, তার ফল আর ইতিবাচক থাকে না। প্রথম দিন থেকে ‘করোনা’ নিয়ে মানুষকে ঘরবন্দি রাখার চেষ্টায় বিজ্ঞান কম ছিল। জুজু দেখানোই ছিল বেশি। তার ফলে লড়াইটা যে রোগের বিরুদ্ধে সেটাই মানুষ বেমালুম ভুলে গেল।
[আরও পড়ুন: নাক দিয়ে ভাইরাস ঢুকে কাবু করেছে মস্তিষ্ক! করোনার আঘাতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ]
ডা. সরকার জানিয়েছেন, যেদিন থেকে মানুষ করোনাকে বিজ্ঞানের চোখে না দেখে কুসংস্কারের চোখে দেখতে শুরু করেছে সেদিন থেকে সমাজে এই ধরনের নেতিবাচক ঘটনা দেখা যাচ্ছে। মেডিকা হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া খবর, হাসপাতালের তরফে ওই মহিলাকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সেফ হোমে তাঁকে দিনের পর দিন মুফতে খাবার দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। মহিলার কাতর প্রার্থনা, “খেতে না দিন অত্যন্ত মাথার ছাদটা কেড়ে নেবেন না।”
The post স্বামী-বাপের বাড়ির কাছে ‘অচ্ছুৎ’, করোনাজয়ী মহিলার ঠাঁই শেষপর্যন্ত হাসপাতালেই appeared first on Sangbad Pratidin.