রাজু মুখোপাধ্যায়: সিডনি টেস্টে ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা শেষ পর্যন্ত খেলল না। টস করতে গেল জশপ্রীত বুমরাহ। তা বুমরাহকে বলতে শুনলাম যে, রোহিত বিশ্রাম নিয়েছে। আমি বলব, নিজে সরে দাঁড়িয়েছে রোহিত। দুঃসহ ফর্মের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল ও। তাই টিমের কথা ভেবে, দেশের কথা ভেবে, নিজেকে সরিয়ে নিল সিডনি
টেস্ট থেকে। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে, এ ভাবে অধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও রোহিতের সরে দাঁড়ানোর বিষয়টা বিরল মনে হবে। কিন্তু আদতে ভারতবর্ষের প্রথম টেস্ট অধিনায়কও কিন্তু একই কাজ করেছিলেন! আজ থেকে ৯২ বছর আগে, ১৯৩২ সালে! এবং কোথাও যেন ৯২ বছর পর রোহিত সেই নিঃস্বার্থ, নির্লোভ এক ত্যাগী চরিত্রকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল!রোহিত মনে পড়িয়ে দিয়ে গেল পোরবন্দরের মহারাজা রানা নটবর সিংজিকে!
আমরা জানি, ভারত প্রথম সরকারি টেস্ট খেলে ১৯৩২ সালে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আমরা এটাও জানি, লর্ডসের সেই টেস্টে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিকে নাইডু। যিনি ভারতের সর্বপ্রথম টেস্ট অধিনায়ক। কিন্তু ঘটনা হল, সিকে নাইডুর সেই টেস্টে অধিনায়কত্ব করার কথাই ছিল না। সেই সফরে ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল পোরবন্দরের মহারাজা রানা নটবর সিংজির! যিনি নিজে সরে দাঁড়িয়ে সিকে-কে অধিনায়ক নির্বাচন করে দেন! যে ইতিহাস অনেকেই আজ আর জানেন না।
আসলে তখনকার দিনে সাধারণ মানুষ নন, মহারাজারাই অধিনায়ক হতেন। বলতে পারেন, প্রচলিত প্রথা ছিল। লোকে বিশ্বাস করত, টিমের অধিনায়কত্ব মহারাজা ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। যে কারণে মহারাজা নটবর সিংজিকে অধিনায়কত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মহারাজা ছিলেন আবার অত্যন্ত ভালো মানুষ। অসম্ভব উচ্চ শিক্ষিত। মুক্তমনা। উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি খেললে ভারতীয় দল দুর্বল হয়ে পড়বে। অথচ ভারত ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। দেশ প্রথম টেস্ট খেলতে নামছে। খেলার একটু আগে মহারাজা নটবর সিংজি ঘোষণা করলেন যে, তিনি ম্যাচটা খেলবেন না। কারণ, তিনি মনে করেন তাঁর চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য প্লেয়ার রয়েছে খেলার মতো। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার মতো। মহারাজা নটবর সিংজি শুধু নিজে খেলেননি, তাই নয়। টিমের সহ-অধিনায়ক ছিলেন যিনি, সেই লিমডির মহারাজা ঘনশ্যাম সিংজিকেও বলেন যে, ‘‘তুমিও খেলবে না।’’ যা নিঃসঙ্কোচে লিমডির মহারাজা মেনে নেন। এবং তার পর সর্বসমক্ষে মহারাজা নটবর সিংজি ঘোষণা করেন যে, লর্ডস টেস্টে ভারতকে নেতৃত্ব দেবেন সিকে নাইডু! কারণ তিনিই যোগ্যতম লোক দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার।
ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। তখন দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে। সেই সময় দেশের এক মহারাজা জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থকে উপেক্ষা করছেন! ভাবতে পারেন, কতটা মহানুভব হলে এ জিনিস করা সম্ভব? ইতিহাস গড়তে চলেছিলেন মহারাজা নটবর সিংজি। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে তাঁর নামই লেখা থাকত দেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে। কিন্তু নির্বিকার ভাবে তিনি সেই সুযোগ ছেড়ে দিলেন। একজন প্রকৃত মহারাজার মতো। পরে অনেক অধিনায়কই সরে দাঁড়িয়েছেন এ ভাবে। ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডের মাইক ডেনেস সরে দাঁড়িয়েছিল লিলি-টমসনকে খেলতে পারছিল না বলে। কিন্তু কোথাও গিয়ে পোরবন্দরের মহারাজা আত্মত্যাগ বিচারে স্বতন্ত্র থেকে যাবেন। ক্রিকেট ইতিহাসে কখনও কোনও অধিনায়ক নিজের অভিষেক টেস্ট থেকে সরে দাঁড়াননি। মহারাজা নটবর সিংজিই প্রথম। মহারাজা নটবর সিংজিই শেষ। মানুষ ভুলে গেলেও ভারতের ক্রিকেট ইতিহাস তাঁকে মনে রেখে দেবে।যিনি ভারতবর্ষের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক হতে পারতেন। কিন্তু দেশের কথা ভেবে হননি!
অনুলিখন:
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়