গোবিন্দ রায়: এ যেন আরেক ‘আবার প্রলয়’। নৌকায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে সদ্য বিবাহিত এক কিশোরী। মাথা ভর্তি সিঁদুর থাকলেও দেখে নাবালিকা-ই মনে হবে। বয়স দশ, বড়জোর বারো কি তেরো। পাশে বরের সাজে এক যুবক। সঙ্গে তাঁর আরও কয়েকজন বন্ধু। নৌকা চলেছে শহরের দিকে। সেখানে ঘাটে রাখা গাড়িতে নাবালিকাকে পাচার করা হবে ভিন রাজ্যে। সম্প্রতি সুন্দরবনের (Sundarban) নারী পাচারের এমনই ঘটনা নিয়ে তৈরি থ্রিলার ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। নারী পাচার চক্রের পর্দাফাঁস করাতে স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসার অনিমেষ দত্ত থাকলেও হাই কোর্টে (Calcutta High Court) দায়ের হওয়া মামলায় দেখা মেলেনি কোনও অনিমেষের। তাই বাধ্য হয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে ও তাঁর একমাত্র কন্যাকে উদ্ধারের আর্তি নিয়ে বাবাকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে আদালতের।
জঙ্গল ঘেরা সুন্দরবন। কোল ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে রায়মঙ্গল নদী। একদিকে বাংলাদেশ, অন্যদিকে উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের হেমনগর থানা এলাকা। বিপদে-আপদে যোগাযোগে ভরসা জলপথই। সেই জলপথ বেয়ে শহর লাগোয়া এলাকায় ‘অপহৃত’ নাবালিকাকে নিয়ে এসে পাচার করে দিচ্ছে ভয়ংকর এক চক্র। কখনও প্রেমের জালে ফেলে, কখনও আবার একেবারে বিয়ে করে! তেমনই আরও একটা গল্পই যেন এই মামলার উপজীব্য। এখানে ভালোবাসার টানে প্রেমিকের হাত ধরে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিল সুন্দরবনের এমনই এক নাবালিকা। সে জানতও না যার হাত ধরে ঘর ছাড়ল, সে আসলে ভালোবাসার অভিনয় করছে মাত্র। তার পিছনে রয়েছে সুপরিকল্পিত এক চক্রের মাথারা। মামলায় উঠে আসা তথ্য বলছে, সুন্দরবন থেকে সোজা পন্ডিচেরি নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওই নাবালিকাকে। বাকিটা পুলিশেরও অজানা।
[আরও পড়ুন: চেন্নাইয়ের আইওসি প্লান্টে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, মৃত ১]
বুধবার হাই কোর্টের শীতের অবকাশকালীন বেঞ্চের বিচারপতি জয় সেনগুপ্তর এজলাসে নাবালিকার বাবার আইনজীবী অনুপম ভট্টাচার্য ও দিলীপকুমার মণ্ডল জানান, হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের হেমনগর থানা এলাকার যোগেশগঞ্জের বাসিন্দা ওই নাবালিকা পর পর দুবার অপহৃত হয়। চলতি বছরের গত ২০ জুলাই সে অপহরণ হওয়ার পর পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হোমে পাঠিয়ে দেয়। ফিরলে কিছুদিন বাড়ি থাকার পর সেই একই ঘটনা ঘটে, চলতি মাসের ১৪ তারিখ আবারও অপহৃত হয় ওই নাবালিকা। এবার একেবারেই নাগালের বাইরে। ঘটনায় কাঠগড়ায় যোগেশগঞ্জের তৃণমূলের বুথ সভাপতি অচিন্ত্য মণ্ডলের ছেলে কল্যাণ মণ্ডল। যা নিয়েই পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে মামলা দায়ের হয় হাই কোর্টে।
আদালতে নাবালিকার পরিবারের অভিযোগ, শুধু যে নাবালিকাকে অপহরণ করা হয়েছে সেই অভিযোগই নয়। থানা থেকে এই অভিযোগ তুলে নেওয়ার প্রতিনিয়ত আসছে হুমকি। মামলা না তুলে নিলে মেয়ের বাবাকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোরও হুমকি দেওয়া হয়েছে। মেয়ে তো বটেই, গোটা পরিবারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো নানা হুমকির অভিযোগে কথা জানান নাবালিকার বাবা। যদিও আদালতে রাজ্যের যুক্তি, পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। নিয়ম মেনে পুলিশ নাবালিকা উদ্ধারের জন্য সব রকম ব্যবস্থা নিয়েছে বলেও জানান বসিরহাট পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার জবি থমাসকে।
[আরও পড়ুন: ‘দেশবাসীকে আঘাত করে এমন ভুল যেন না হয়’, কাশ্মীরে দাঁড়িয়ে সেনাকে বার্তা রাজনাথের]
যদিও মামলার সাপেক্ষে পুলিশের ভূমিকায় প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত। ১৩ বছরের একটা নাবালিকা অপহরণের ঘটনায় কেন পকসো ধারায় পুলিশ মামলা রুজু করেনি, কেনই বা এপর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পুলিশের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারপতি। একটা নাবালিকা গ্রাম থেকে অপহরণ হয়ে যাচ্ছে এক্ষেত্রে স্থানীয় শিশু সুরক্ষা কমিশন, বিডিও-র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি। তাহলে নাবালিকার বিয়ে রুখতে প্রশাসনের কোনও ভূমিকা কী? আগামী ৩ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানিতে এনিয়ে পুলিশকে হলফনামা আকারে আদালতে রিপোর্ট দিতে হবে। আদালতে সরকারি কৌঁসুলি শৈলেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জানান, নাবালিকাকে ফিরিয়ে আনতে পুলিশ পদক্ষেপ নিয়েছে। যেহেতু মামলা প্রাথমিক পর্যায়ে তাই পকসো ধারায় মামলা রুজু করা হয়নি।