shono
Advertisement

‘নগদ’ শব্দটার অর্থই বদলে যাবে?

রিজার্ভ ব্যাংক ‘বৈদ্যুতিন মুদ্রা’ চালু করতে চলেছে।
Posted: 06:37 PM Feb 03, 2022Updated: 06:37 PM Feb 03, 2022

রিজার্ভ ব্যাংক ‘বৈদ্যুতিন মুদ্রা’ চালু করতে চলেছে। এই ‘বৈদ্যুতিন মুদ্রা’ তৈরি হবে ‘ব্লক চেন’ প্রযুক্তির সাহায্যে। ‘ব্লক চেন’ প্রযুক্তির সুবিধা হল আপনার টাকাপয়সার আয়-ব্যয়ের হিসাব একই সঙ্গে বহু কম্পিউটারে মজুত করা থাকবে। ফলে, কেউ সহজে আপনার ব্যাংকের টাকাপয়সায় হাত দিতে পারবে না। মুশকিল, ভারতের অনেক মানুষই বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে আয়-ব্যয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত নন সেভাবে। লিখছেন  দীপংকর দাসগুপ্ত 

Advertisement

 

পূর্ববর্তী সমস্ত বছরের মতোই কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার অল্পক্ষণের মধ্যেই তার সূক্ষ্ম বিচার করা কঠিন। আর, এই কাজে হাত না লাগানোই ভাল। কারণ, আগামী এক বছরের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি ২ ঘণ্টার বাজেট-বক্তৃতা শুনে অনুমান করা সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। তাই ২০২২-’২৩-এর বাজেট নিয়ে খুব বেশি বক্তব্য আমি রাখার চেষ্টা করব না। বাজেটের খাতাপত্র পুরোপুরি না ঘেঁটে তার অন্তর্নিহিত তথ্যাবলি পরিষ্কার করে বোঝা যায় না। সেই কাজটি সময়সাপেক্ষ। অতএব, অল্প দু’-চার কথার বেশি আমি এই প্রসঙ্গে আলোচনা করব না।

সাধারণ মানুষ বাজেটের খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবেন না। অর্থাৎ, বাজেটের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কী যোগাযোগ সে নিয়ে অধিকাংশ মানুষেরই তেমন কোনও অনুসন্ধিৎসা নেই। আপিসে মাইনে পাওয়া মানুষজন একটাই কথা জানতে চান। এই বাজেটে তাঁরা কী পেলেন? আর, ‘পাওয়া’-র অর্থ একটাই– কর বাড়ল, না, কমল? ‘স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন’ কি একটু বাড়ল? স্বাস্থ্য বিমার খাতিরে আয় করে ছাড়ের কী হল? ইত্যাদি ইত্যাদি। ভারতে বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী কি নিম্নগামী তাতে বিশেষ কিছু এসে-যায় না। আর, ঠিক এই প্রশ্নের উত্তর হল ২০২২-’২৩-এর বাজেটে এই সমস্ত খাতে প্রায় কোনও পরিবর্তনই হয়নি। যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে তা হল, আয়ের খাতে রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ভুল করে থাকলে সেই ভুল সংশোধন করার জন্য দু’-বছর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। সরকারের বক্তব্য, এর ফলে করদাতা কর ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা নেবেন না। অর্থাৎ, তিনি নিজেকে সংশোধন করার জন্য অনেক সময় পাবেন এবং একটি নতুন রিটার্ন জমা দিলেই সমস্যার সমাধান হবে।

[আরও পড়ুন: বিনয়-বাদল-দীনেশ আসলে যোদ্ধা বাঙালির গল্প, সিনেমা নয়, বাস্তবে কেমন ছিল তাঁদের লড়াই?]

এখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে, করদাতা ইচ্ছাকৃতভাবেই কর ফাঁকি দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ যদি সত্যিই ভ্রমবশত ভুল রিটার্ন জমা দেন, তিনি কেমন করে বুঝবেন যে তাঁর সেই ভুল সংশোধন করা প্রয়োজন? যেটুকু বোঝা গেল, আয়কর বিভাগ থেকে প্রত্যেকের আয়-ব্যয়ের সমস্ত হিসাব পাওয়া যাবে। সেই হিসাব দেখলেই করদাতা বুঝতে পারবেন তাঁর কী কর্তব্য। কাজেই যত্ন করে নিজেই নিজের আয়ের হিসাব রাখা যথেষ্ট নয় বলে মনে হয়। এতে রিটার্ন জমা দেওয়ার সুবিধা বাড়ল না কমল কিছুদিন না-গেলে বোঝা যাবে না। যদি সরকারের কাছে সমস্ত তথ্যই থাকে, তবে সরকার তো নিজেই কর হিসাব করে আদায় করে নিতে পারে। করদাতার রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রয়োজন কী?

অপর যে বড় খবরটি পাওয়া গেল তা হল, এই বছরের মধ্যেই নগদ টাকা ছাপানোর কাজ কমতে শুরু করবে। ‘নগদ’ শব্দটার অর্থই বদলে যাবে, কারণ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ‘বৈদ্যুতিন মুদ্রা’ চালু করতে চলেছে। এই ‘বৈদ্যুতিন মুদ্রা’ তৈরি হবে ‘ব্লক চেন’ প্রযুক্তির সাহায্যে। ‘ব্লক চেন’ প্রযুক্তির সুবিধা হল আপনার টাকাপয়সার আয়-ব্যয়ের হিসাব একই সঙ্গে বহু কম্পিউটারে মজুত করা থাকবে। ফলে, কেউ সহজে আপনার ব্যাঙ্কের টাকাপয়সায় হাত দিতে পারবে না।

অনেক কম্পিউটারের নজরদারির ব্যাপারটা নিয়ে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সম্পাদকীয় পাতায় কিছুকাল আগে লিখেছিলাম, ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রসঙ্গে। ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে নজরদারি কোনও সরকারি কম্পিউটার থেকে হয় না। সারা পৃথিবী জুড়ে বেসরকারি কম্পিউটারের সাহায্যে লক্ষ রাখা হয়। কেবল সরকার নিজেই যদি বৈদ্যুতিন মুদ্রা তৈরি করে, তবে নজরদারিও তো বোধহয় সরকার নিজেই করবে। তাই আবারও দেখতে হবে ব্যাপারটা কেমন করে চলবে। সাম্প্রতিক কালে অনেকেই ব্যাংকের টাকা খুইয়েছেন বৈদ্যুতিন আয়-ব্যয়ের কারণে আর হ্যাকারদের দয়ায়। এর উপর নগদ টাকাও যদি বৈদ্যুতিন আকার ধারণ করে তবে ঝুঁকি বাড়বে না কমবে বলা মুশকিল। উপরন্তু, এখনও পর্যন্ত ভারতের অনেক মানুষই বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে আয়-ব্যয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত নন। তাঁরা কেউ বয়স্ক মানুষ, কেউ অল্পবয়স্ক কিন্তু মোবাইল ফোনে সিনেমা দেখার বেশি এগতে পারেন নি। কাজেই এটা হয়তো কিছু সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

অন্যদিকে ক্রিপ্টোকারেন্সিও চালু থাকবে। এই নিয়ে একটি নতুন ধরনের সম্পদের কথা আজ শোনা গেল- ‘বৈদ্যুতিন সম্পদ’। আর, ‘বৈদ্যুতিন সম্পদ’ বলতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ছাড়া আর তো কিছু চেনাও যাচ্ছে না। এই বৈদ্যুতিন সম্পদ যদি কাউকে দান করা হয় তবে যিনি সেই সম্পদ পাবেন তাঁকে ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে। যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যাপারটা সরকার প্রসন্ন চোখে দেখছে না। যদিও সরকার নিজের তৈরি টাকাকে বৈদ্যুতিন আকার দিতে চলেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সরকার বিশ্বাস করে না, কারণ হয়তো দুর্নীতি বাড়তে পারে বলে সরকারের আশঙ্কা। সেই আশঙ্কা রিজার্ভ ব্যাংকের বৈদ্যুতিন মুদ্রার ক্ষেত্রে নেই এমনটাই তাহলে বলা হল। ব্লক চেনের দায়িত্ব কাদের হাতে দেওয়া হবে? তারাও কি বেসরকারি সংস্থা?

এই বাজেট শুনে উপরোক্ত ব্যাপারগুলোই আমার সবচেয়ে আলোচ্য বলে মনে হয়েছে। এর বাইরে যে কথাবার্তা হয়েছে তার সঙ্গে অতীতের বাজেটের তাত্ত্বিক তফাত কিছু আছে বলে মনে হয় না। পরিকাঠামো বাড়ানো, যেমন ২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি, ড্রোনের সাহায্যে কৃষি জমির তদারকি করা, ডাকঘরের ব্যাঙ্কের সঙ্গে সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের যোগাযোগ স্থাপন করা, বেসরকারি বিনিয়োগ জাগিয়ে তুলতে সরকারি বিনিয়োগের ব্যবস্থা, সৌরশক্তির প্রসার (২০৩০ সালের মধ্যে ২৮০ গিগাবাইট) এবং আরও নানা ছোট বড় খরচাপাতি। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্পে ৬০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থানের আশা পাওয়া গেল। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার জন্য সরকার ১২টি নতুন টিভি চ্যানেল তৈরি হবে।

গত বছরের বাজেটে রাজকোষ ঘাটতি ৬.৮ শতাংশ হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। অনুমান করা হচ্ছে যে, এই ঘাটতি হয়েছে ৬.৯ শতাংশ। এটা সুখবর, তবে সংশোধিত বাজেটে প্রকৃত সংখ্যা কী ছিল সেটা নিয়মমাফিক ২ বছরের আগে জানা যাবে না। এখানে সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করার অর্থ হয় না। তবে অল্প দু’-একটি সংখ্যার উল্লেখ করছি। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভরতুকি বেড়েছে ১৬ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। এর কারণ এমন হতে পারে যে, ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এখন থেকে ভারত অনেক বেশি আত্মনির্ভর হবে। মারণাস্ত্র তৈরি করব আমরা নিজেরাই, আমদানি না করে। এদিকে, সারের জন্য ভরতুকি কমেছে ৩৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, খাদ্যের জন্য ৭৯ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা এবং খনিজ তেলের জন্য ৭০৪ কোটি টাকা। এই শেষ তিনটি সংখ্যা থেকে অনুমান করা যায় যে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি কমার সম্ভাবনা কম। লক্ষণীয় যে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাজেটে কোনও আলোচনাই ছিল না, যেখানে এই মুহূর্তে মূল্যবৃদ্ধির চাপে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।

শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি খরচ বাড়বে ১৬ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। শিক্ষাক্ষেত্রে মোট খরচ হবে ১ লক্ষ ৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা যেটা আমার হিসাবে দঁাড়াবে অনুমিত জাতীয় উৎপাদনের ০.৪ শতাংশ। বৈদ্যুতিনায়িত অর্থনীতিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই খরচা কী যথেষ্ট? স্বাস্থ্যক্ষেত্রে খরচা আরও কম, ৮৬ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। এরকম আরও সংখ্যা বিশ্লেষণ করা সম্ভব। কিন্তু এই মুহূর্তে এইখানেই ইতি টানা-ই ভাল। সূক্ষ্ম বিচারের জন্য আরও একটু সময় দরকার হয়।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইএসআই,
কলকাতার ভূতপূর্ব অধ্যাপক
d.dasgupta@gmail.com

[আরও পড়ুন: ‘কত লজ্জা বাঙ্গালির কপালে আছে?’ লিখেছিলেন নেতাজি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement