পুজোকে ঘিরে রাজ্যে একটি বিশাল অঙ্কের ব্যবসা হয়৷ যে টাকা এই পুজোর বাজারে খাটছে, তা যদি পরিকল্পনা করে কোনও একটি উৎপাদক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত, তা হলে তার অবদান নিঃসন্দেহে অর্থনীতিতে অনেক সুদূরপ্রসারী হত৷ সুতীর্থ চক্রবর্তী
পুজোকে ঘিরে রাজ্যে কী কী ব্যবসা হয় সে সম্পর্কে প্রতিবছরই পুজোর আগে আকর্ষণীয় তথ্য উঠে আসে৷ এবার যেমন জানা গেল, পুজোয় কলকাতা শহরেই শুধু কয়েক কোটি টাকার বাঁশের ব্যবসা হয়৷ এখন থিম পুজোর যুগ৷ নানা মাপের সঙ্গে নানা মানের বাঁশ প্রয়োজন হয়৷ শুধু মেদিনীপুরের মোটা বাঁশ দিয়ে পুজোর সাজ হয় না৷ থিম পুজোর উদ্যোক্তাদের বাঁশ আনতে হয় অসম, ত্রিপুরা থেকে৷ বাঁশের ব্যবসার মতোই আরও একটি মজাদার ব্যবসার তথ্য এবার উঠে এসেছে৷ পুজোকে ঘিরে নাকি এখন নিরাপত্তাকর্মীদের ব্যাপক চাহিদা৷ বহু পুজো কমিটি প্রতিমার গায়ে দামি গয়না লাগাচ্ছে৷ দর্শক টানার এটি একটি নতুন চমক৷ দামি গয়না লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বাড়ছে নিরাপত্তাকর্মীদের৷ এই পুজোর ক’দিন কলকাতার নিরাপত্তা সংস্থাগুলিও নাকি কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা করে৷
কিছুদিন আগে এক বণিক সভা হিসাব দিয়েছিল পুজোকে ঘিরে রাজ্যে মোট ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়৷ টাকার অঙ্কটা খুবই বড় শোনাচ্ছে৷ জানা নেই এই বণিক সভা কোনও সমীক্ষার পর তথ্যটি হাজির করেছিল কি না৷ যদিও পুজোকে ঘিরে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবসা হয় যে পুরো হিসাবটি পাওয়া খুব কঠিন৷
পুজোকে ঘিরে সবচেয়ে বড় ব্যবসা নিঃসন্দেহে জামাকাপড়ের৷ এখন জামাকাপড়ের ব্যবসা মানেই রেডিমেড পোশাক৷ এর একটি বড় অংশ জোগান দেয় অন্য রাজ্যগুলি৷ ফলে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে পুজোয় রাজ্যবাসীর খরচ করা টাকার একটা সিংহভাগ রাজ্যের বাইরেই চলে যায়৷ ইদানীং পুজো কমিটিগুলির বাজেট বিশাল৷ কলকাতার কয়েকটি বড় বড় পুজো কোটি টাকার উপর বাজেট করে৷ অনেকেরই বাজেট ৫০-৬০ লক্ষ টাকা৷ গোটা রাজ্যে পুজোর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার৷ পুজো কমিটির বাজেট যোগ করলেই দেখা যাবে, বিরাট অঙ্কের টাকা খরচ হচ্ছে মণ্ডপ বানাতে, প্রতিমা কিনতে ও আলো লাগাতে৷ পুজো কেন্দ্রিক শিল্পে সারা বছর রাজ্যে কত মানুষ কাজ করেন তার কোনও হিসাব নেই৷ মনে হয় না সংখ্যাটা খুব বেশি হবে৷ পুজোর দু’তিন মাস আগে থেকে কিছু কাজের সুযোগ তৈরি হয়৷ আজকাল পাড়ার দোকানগুলির ব্যবসাও আর আগের মতো নেই৷ ফলে সেখানেও যে কাজের সুযোগ, তাও নয়৷ প্রতিমা বানানো, মণ্ডপ বানানো, আলো লাগানো ইত্যাদি কয়েক মাসের কাজ৷ কর্মসংস্থানের দিকটি বিচার করলে পুজোর অবদান অর্থনীতিতে বিশাল, এমনটা বলা যায় না৷
কিন্তু পুজোকে ঘিরে রাজ্যে একটি বিশাল অঙ্কের ব্যবসা হয়৷ যে টাকা এই পুজোর বাজারে খাটছে, তা যদি পরিকল্পনা করে কোনও একটি উৎপাদক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত, তা হলে তার অবদান নিঃসন্দেহে অর্থনীতিতে অনেক সুদূরপ্রসারী হত৷ এই টাকা লগ্নি করে কলকারখানা ইত্যাদি বানালে তা থেকে যেমন অনেক বেশি কর্মসংস্থান হত, তেমন সেই টাকা অর্থনীতিতে চক্রাকারে আরও বেশি পরিমাণ উৎপাদন ভবিষ্যতে সৃষ্টি করতে পারত৷ কোনও উৎসবকে ঘিরে যদি দেশের প্রচুর সম্পদের অপচয় হয়, তা হলে তা ঘুরিয়ে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলে৷ সেই কারণে পুজোর খরচ বা পুজোকে ঘিরে ব্যবসার অঙ্ক আমাদের প্রাথমিকভাবে উৎসাহ দিলেও গভীরভাবে বিচার করতে হবে যে এই পরিমাণ টাকা খরচ করে দিনের শেষে আমরা কী পেলাম৷ এই টাকার কতটা বাজে খরচের তালিকায় চলে গেল৷
পুজোকে ঘিরে জুতো-জামাকাপড়ের যে ব্যবসা তা অবশ্যই অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক৷ কিন্তু যে পরিমাণ বিদ্যুত্ খরচ হয় তার কতটা আমাদের মতো দরিদ্র দেশে অপচয়, সেই হিসাব জরুরি৷ এই পরিমাণ বিদ্যুত্ উৎপাদন করতে সরকারের কত খরচ হয় তা হিসাব করা দরকার৷ সেই খরচ বাঁচাতে পারলে তা অন্য খাতে খরচ হতে পারত৷ এইভাবে সব অপচয়গুলিকে যোগ করতে পারলে দেখা যাবে যে পুজোর ব্যবসা নিয়ে আহ্লাদ করার মতো কিছু থাকে না৷ আমাদের দেশে অবশ্য সব রাজ্যেই এইরকম নানা উৎসব রয়েছে৷ সব উৎসবেই এইরকম জাতীয় সম্পদের অপচয় রয়েছে৷ অপরিকল্পিত খরচ রয়েছে৷ দারিদ্র থাকলেও আমরা তো আসলে বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশের লোক৷
The post বারো মাসে তেরো খরচ appeared first on Sangbad Pratidin.