রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: যা আমরা দেখছি, মনুষ্যমনের তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। মহাজাগতিক কীর্তিকলাপ আর কত সহ্য করবে মন? তাকেও তো নিজেকে প্রবোধ দিতে হবে, আঁকড়ে ধরতে হবে জাগতিক কোনও কিছু। তাই আমরা লিওনেল মেসি (Lionel Messi) নামক গ্রহান্তরের ফুটবলারের সঙ্গে তুলনা করি ওই লোকটার। যে গোল করে পেনাল্টি কিংবা কাউন্টার অ্যাটাক থেকে। কী করা যাবে, লিওনেল মেসির মতো খেলার কথা তো স্বপ্নেও ভাবা যায় না। শরীর—মন বিদ্রোহী ডাক দেয়, ছুঁড়ে ফেলে সব আবেদন।
লেখক মার্কিন কবি রাওয়ান রিকার্ডো ফিলিপস। লিওনেল মেসির অগণিত গুণমুগ্ধদের একজন। লেখাটা বেশ কয়েক বছর আগের। আজ থেকে বছর সাত—আট আগে হলে প্রকাশ্য না করলেও এ সমস্ত লেখাপত্রে নিশ্চিত একান্তে স্মিত হাসতেন আর্জেন্টাইন মহানায়ক। কিন্তু আজ আর এ সব সন্তুষ্টির দমকা হাওয়ায় হৃদয় দুলিয়ে দেয় কি? নাহ্। কী লাভ এ সব পড়ে? ‘কাউন্টার কিংবা পেনাল্টি’ থেকে গোল করা জাগতিক লোকটার ক্যাবিনেটে তো একটা ঝকঝকে ইউরো ট্রফি আছে, আছে একটা নেশনস লিগ। আর তিনি ঈশ্বর হয়েও ‘দরিদ্র’, ফুটবল—দেবতা হয়েও ‘নিঃস্ব।’ নীল—সাদা জার্সিতে ট্রফি কোথায়, ট্রফি? তার উপর দুঃখের ‘দোসর’ আবার ওই মারাকানা!
[আরও পড়ুন: ‘অন্যতম সেরা ক্যাচ’, ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটারের অনবদ্য ফিল্ডিংয়ের ভিডিও ভাইরাল]
রবিবাসরীয় কোপা ফাইনাল—যুদ্ধের আয়তক্ষেত্র। গত একাত্তর বছর ধরে ব্রাজিলিয়ানদের জীবনে চলমান অভিশাপ হয়ে থেকেছে মারাকানা। রাতের ঘুম ভাঙিয়ে বারবার মনে পড়িয়েছে ’৫০ বিশ্বকাপ ফাইনাল, উরুগুয়ের কাছে ধ্বংস হওয়ার রক্তাক্ত ইতিহাস। লিওনেল মেসিরও কি তাই নয়? তিনিও কি রাতে ঘুমোলে দেখতে পান না সাত বছর আগের এক মারাকানা রাত, হিগুয়েনের মিস, গোটজের গোল? ছিয়াশির বিশ্বকাপে বিশ্বজয়ীর রাজমুকুট পরা দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাকে ছোঁয়ার স্বর্ণসুযোগ ছিল সে দিন, সাত বছর আগের ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফাইনালে। চিরতরে ধুয়েমুছে সাফ করে দিতে পারতেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে, মনুষ্য—মননে বিস্মৃত করে দিতে পারতেন সমস্ত সিআর কীর্তিকে, সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যেত রোনাল্ডোর সঙ্গে তাঁর সব তুলনা। কিন্তু হয়নি কিছু। অথচ সে দিনের জার্মানি ফাইনালে সবচেয়ে বেশি গোলে শট তিনি নিয়েছিলেন, সবচেয়ে বেশি সু়যোগ সৃষ্টি করেছিলেন। মাঠে বাকি একুশজনের কেউ যার অর্ধেকও করে দেখাতে পারেননি। তবু কেউ মনে রাখেনি। কেউ মনে রাখে না। শুধু মনে রাখে, বিশ্বকাপের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা তাঁর রক্তশূন্য মুখ আর ‘হেরো’ টিমের প্রতিভূ হয়ে ‘গোল্ডেন বল’ নিতে যাওয়া অনিচ্ছুক অবয়ব।
মাঝে সাতটা বছর, একাধিক ব্যালন ডি’অর, দু’টো কোপা ফাইনাল, দু’বার অবসরে যাওয়ার উদগ্র বাসনা এবং শেষ পর্যন্ত আবার মারাকানা! প্রবাদে বলে, ইতিহাস নাকি ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু প্রাক্ কোপা ফাইনালে মনে হচ্ছে, ইতিহাস সব সময় খামোখা ফিরে আসে না। ইতিহাস সময় সময় ফিরে আসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে। পারফর্মারকে ফেলে দেয় সেই একই মঞ্চে, যেখান থেকে সে রক্তাক্ত হয়ে ফিরেছিল। পারলে ঘটাও পুনর্জন্ম, পারলে ব্রাজিলকে তার নিজের ভূমিতে হারিয়ে তোলো দেশের হয়ে প্রথম ট্রফি। পৌরুষ দেখানোর এর চেয়ে মস্ত সুযোগ আর কী আছে? ফুটবল—দৈবের কী অদ্ভুত খেয়াল দেখুন। কোপা আমেরিকা এ বার ব্রাজিলে হওয়ার কথাই ছিল না। করোনা প্রকোপে আর্জেন্টিনা সহ নানা দেশ, নানা পথ ঘুরে ব্রাজিল এবং শেষে সেই মারাকানা!
[আরও পড়ুন: কতটা গুরুতর মেসির পায়ের চোট? খেলতে পারবেন Copa America ফাইনালে?]
এবং দুর্ভাগ্য মারাকানার! করোনা আক্রান্ত দর্শকশূন্য ঐতিহাসিক স্টেডিয়াম চাক্ষুষ দেখতে পাবে না, কী জ্বলন্ত খিদে নিয়ে এবারের কোপা খেলতে এসেছেন লিও। চৌত্রিশেও তাঁকে চব্বিশের দেখাচ্ছে, বিপক্ষের বুটের লাথিও থামাতে পারছে না, পা থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত হ্যাঁচকা টানে আটকাতে পারছে না সেমিফাইনালে তাঁর নিখুঁত পেনাল্টি। বরং ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁর শেষ মুহূর্তের দৈব—ফ্রিকিক দেখে মিডিয়া লিখতে বাধ্য হচ্ছে, এ তো নিছক গোল নয়, গোলের রাজপোশাক পরা অনিন্দ্যসুন্দর ভাস্কর্য। টিমের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল (৪), সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট (৫), সবচেয়ে দাপুটে পারফরম্যান্স, সবচেয়ে বেশি ম্যান অব দ্য ম্যাচ। রবিবাসরীয় ব্রাজিল—ফাইনালে আর একটা গোল করলে পেলের আন্তর্জাতিক গোলের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবেন (৭৭), দু’টো করলে পিছনে ফেলবেন পেলেকে। মনে রাখতে হবে, মেসি এই সবই করছেন, যখন তাঁর কোনও ক্লাব নেই!
চিরকাল বলা হয়েছে, মেসি আগে ক্লাবের, পরে দেশের। কিন্তু আর বলা যাবে না। চলতি কোপায় বার্সেলোনার সঙ্গে চুক্তি না করে, ‘ফ্রি এজেন্ট’ হয়ে ঘোরা ফুটবল ঈশ্বর প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, লিওনেল মেসি এখন দেশের, শুধু দেশের, একমাত্র আর্জেন্টিনার! আর মনে হয় না, মারাকানা ফাইনাল পর্যন্ত বার্সেলানার চুক্তি, পিএসজি কর্তাদের ফোনের প্রতি এই মেসি দৃকপাত করবেন বলে। বরং এই মেসি পারেন ছ’টা ব্যালন ডি’র, বার্সার হয়ে অগণিত ট্রফি অক্লেশে বিলিয়ে দিতে। মাত্র এক শর্তে।লহ ফিরায়ে সব ট্রফি, দাও মোরে কোপা কাপ!