দেশে অসাম্য বাড়ছে, ধনীরা যত ধনী হচ্ছে, তত কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন বাড়ছে। বাজেটে কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন নিয়ে পদক্ষেপ থাকবে---প্রত্যাশা ছিল। তবে কিছু ঘটেনি। উলটে চাপ বেড়েছে মধ্যবিত্তর উপরে। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
‘কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন’ শব্দটি আজকাল বিশেষ শোনা যায় না। এককালে খুব পরিচিত ছিল। বাংলায় কথাটির অর্থ ‘চমক-জাগানো উপভোগ’। নিজের জাঁকজমক দেখানোর জন্য ধনীরা এই ‘চমক-জাগানো উপভোগ’ করে থাকেন। মার্কিন অর্থনীতিবিদ থরস্টিন ভেবলেন ধারণাটির জন্ম দিয়েছিলেন। চোখ-ধাঁধানো জিনিসপত্রে বিপুল ব্যয় করে ‘চমক-জাগানো উপভোগ’ আজকাল জলভাত। একটা সময়ে এই ধরনের উপভোগকে অর্থনীতির পক্ষে খুব ক্ষতিকর ধরা হত। কয়েক দিন আগে মুকেশ আম্বানি তাঁর ছেলের বিয়েতে যে জাঁকজমক দেখালেন, তা ‘কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন’-এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কর বসিয়ে এই ‘কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন’-এ রাশ টানা জরুরি কি না, সেই বিতর্ক মাঝে মাঝেই হয়। দেশে অসাম্য যত বাড়ছে, ধনীরা যত ধনী হচ্ছে, তত এই ‘কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন’ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লোকসভা ভোটের আগে বিষয়টি প্রচারেও এসেছিল। তৃতীয় মোদি সরকারের প্রথম বাজেটে ‘কনস্পিকুয়াস কনজাম্পশন’ কমাতে কোনও পদক্ষেপ থাকবে বলে অনেকে প্রত্যাশা করেছিলেন। সেরকম কিছু ঘটেনি।
[আরও পড়ুন: নিউ গড়িয়া থেকে রুবি পর্যন্ত বাড়ছে মেট্রো পরিষেবা, যাত্রীদের জন্য সুখবর]
বাজেটে আয় বাড়ানোর জন্য সরকারের নিশানায় সেই মধ্যবিত্তই। আয়করের নতুন বিকল্পে যে-ছাড়ের বন্দোবস্ত হয়েছে, তা যৎসামান্য। স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা করা এবং স্ল্যাবে কিছুটা পরিবর্তন যেটুকু সাশ্রয় করবে, তা মূল্যস্ফীতির খেসারত দিতেই চলে যাবে। কিন্তু আয়করের ছাড়ের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে যেভাবে ‘মূলধনী লাভ’ তথা ‘ক্যাপিটাল গেনস ট্যাক্স’ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা মধ্যবিত্তর কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কারের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ধারাবাহিকভাবে শেয়ার বাজারে লগ্নিকে উৎসাহিত করে আসছে। সেই শেয়ার বাজারের মূলধনী লাভের উপর চাপানো কর দুম করে এতটা বেড়ে যাবে, তা কেউ কল্পনাতেই আনতে পারেননি। শেয়ার, ঋণপত্র, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদির দামবৃদ্ধি থেকে প্রাপ্ত যে-লাভ, তাকে ‘মূলধনী লাভ’ বলে। বেশিরভাগ দেশেই এই মূলধনী লাভকে ‘আয়’ হিসাবে ধরা হয় না। কিন্তু যেহেতু এই লাভ সম্পদের মালিকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, তাই এটাকে করযোগ্য ধরা হয়। মূলধনী লাভের উপর কর বসানো উচিত কি উচিত নয়, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধে্য বিতর্ক রয়েছে।
মনে রাখতে হবে, শেয়ার বাজার থেকে লাভ মধ্যবিত্তর আয়ের একটি বড় উৎস। আজকাল মধ্যবিত্ত ব্যাঙ্কের মেয়াদি আমানত বা পোস্ট অফিসের স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে টাকা রাখে না। ব্যাঙ্কে আমানত করতে গেলে ব্যাঙ্ককর্মীরাই মিউচুয়াল ফান্ড বা ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে শেয়ারে লগ্নি করার বিষয়ে প্ররোচনা দেন। এই প্ররোচনায় পা দিয়ে মধ্যবিত্তর বড় অংশই এখন শেয়ার বাজারে লগ্নিকারীরা। মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ প্রজন্ম শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নির ক্ষেত্রে আরও দড়। শেয়ার বাজারের সেই ক্ষুদ্র লগ্নিকারী তথা দেশের বিশাল সংখ্যক মধ্যবিত্তর মূলধনী লাভের উপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে যেভাবে কর বৃদ্ধি করা হল বাজেটে, তা আয়করের সামান্য রেহাইয়ের স্বস্তিকে মুহূর্তে বিলীন করেছে।
‘ক্যাপিটাল গেনস ট্যাক্স’ বৃদ্ধি করে মধ্যবিত্তকে কেন এইভাবে আঘাত করা হল, তার সদুত্তর সরকারের থেকে মেলেনি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন দাবি করেছেন, ‘ক্যাপিটাল গেনস ট্যাক্স’ কাঠামোর সরলীকরণ হয়েছে। কোনও কর বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেনি। শর্টটার্মে তথা স্বল্প মেয়াদে ‘ক্যাপিটাল গেনস ট্যাক্স’ ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ড একবছরের মধে্য লেনদেন করলে তাকে ‘শর্ট টার্ম’ বলে। ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে ঘরে বসে যঁারা শেয়ার কেনাবেচা করে আয় করেন, তঁারাই কিন্তু ‘শর্ট টার্ম ক্যাপিটাল গেনস ট্যাক্স’-এর প্রধান প্রদানকারী। এঁদের অনেকের জীবিকার উৎসও ‘শর্ট টার্ম ক্যাপিটাল গেনস’। এঁদের সবার ক্ষেত্রে ট্যাক্স বাড়ল ৫%।
[আরও পড়ুন: রেশন দুর্নীতি মামলায় ফের সক্রিয় ইডি, কলকাতা-সহ ১০ জায়গায় তল্লাশি]
নিঃসন্দেহে এটি বড় ধাক্কা। লং টার্মে ট্যাক্স বেড়েছে ২.৫%। সেটাও ভাল ধাক্কা। লং টার্মে মধ্যবিত্তের বড় ক্ষতি হয়েছে জমি-বাড়ি বিক্রির সময় ইনডেক্সেশন ব্যবস্থাটি উঠে যাওয়ায়। মূল্যস্ফীতির সূচক দিয়ে জমি-বাড়ির বর্তমান বিক্রয়মূল্য কেনার সময়কার দামে নিয়ে আসার জন্য ইনডেক্সেশন করা হত। ইনডেক্সেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০০১-এর পর যেসব মধ্যবিত্ত জমি-বাড়িতে লগ্নি করেছেন, তঁারা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সম্পত্তিটি বেচে যে লাভ হবে, তার উপর করের পরিমাণটা অনেক বেশি হয়ে যাবে। লং টার্মে জমি-বাড়ির উপর করের হার ২০% থেকে কমিয়ে ১২.৫% করা হলেও মুনাফার করযোগ্য অংশটি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে জমি-বাড়িতে ইতিমধে্য যঁারা বিপুল লগ্নি করে রেখেছেন, তঁাদের মাথায় হাত।
দেশ জুড়ে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক মূলত শহরের মধ্যবিত্ত। বাজেটের জন্য মোদি কেন সেই মধ্যবিত্তকেই বেছে নিলেন, তা নিয়ে চর্চা চলছে রাজনৈতিক মহলে। ছ’-মাস পর ফের বাজেট পেশ করবেন নির্মলা সীতারমন। মাঝে মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা ও দিল্লিতে বিধানসভা ভোট হয়ে যাবে। ওই ভোটের ফল দেখে মধ্যবিত্তর উপর জারি করা এই কোপ লঘু হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য বেসরকারি সংস্থাকে ভরতুকি দেওয়ার কথা রয়েছে। বেসরকারি সংস্থাকে ভরতুকি দিয়ে আদৌ কর্মী নিয়োগে বাধ্য করা যায় কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। কর্মসংস্থান বাড়ুক না-বাড়ুক, কর্পোরেটের পকেট ভরার ব্যবস্থা রয়েছে যথেষ্ট। লোক না নিয়েই বহু সংস্থা সরকারের কাছে ভুয়া বিল দিয়ে ভরতুকি ও উৎসাহ ভাতার টাকা তুলে নেবে। এই খাতে দু’-লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন নির্মলা। সিংহভাগ টাকাই কর্পোরেটের মালিকদের পকেটে ঢুকতে চলেছে বলে অাশঙ্কা।
[আরও পড়ুন: ফের দুর্ঘটনার কবলে রেল, লাইনচ্যুত হাওড়া-মুম্বই এক্সপ্রেসের ১৮টি বগি, মৃত অন্তত ২]
সফল হোক না হোক, কর্মসংস্থান নিয়ে তা-ও প্রকল্প রয়েছে, কিন্তু অসাম্য দূর করার জন্য কেন কোনও পদক্ষেপ বাজেটে নেই, তা নিয়েই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আয় বাড়ানোর জন্য মধ্যবিত্তর ‘ক্যাপিটাল গেনস ট্যাক্স’-এ এত কর বাড়িয়ে দেওয়া হল, অথচ আদানি-আম্বানিদের সম্পদের উপর কর চাপানো বা উত্তরাধিকার কর ফিরিয়ে আনার মতো কোনও প্রস্তাব বাজেটে রাখা হল না। কর্পোরেট ট্যাক্সেও হাত দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ এটা খুব স্পষ্ট যে, ভোটে ধাক্কা খেয়েও বিজেপি বিত্তবানদের কোনওভাবে বিরক্ত করতে চায় না। যেটুকু চাপ বা আক্রমণ, তা শুধু মধ্যবিত্তকেই।