সম্বিত বসু: শেষমেশ বহু প্রতীক্ষিত পুজো এসেই গেল! খেয়ালবশে বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, পাড়ার প্যান্ডেলের কাজ শেষ পর্যায়ে, কাপড় বাঁধা চলছে। বাড়ির মাথায় মাথায় শরতের মেঘ। হাওয়া নারকেল গাছ ধরে দুলছে। এ কথা সত্যি যে, কাশফুল এ বছর নীলচে হয়ে যায়নি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠস্বরও ফিনফিনে হয়ে পড়েনি। পাখিও দিব্যি প্রাক্-পুরাণিক সুরেই ডেকেছে। টেলিভিশন, স্মার্টফোন, খবরের কাগজ পুজোর নতুন বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ। দৃশ্যত কোনও বদল নেই, কেবল মানুষের মুখ তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। আর কাগজ খুললেই একের পর এক মৃত্যু সংবাদ। অবিচুয়ারি লেখকদের এরকম ব্যস্ততা কি আগে কখনও চোখে পড়েছে?
এই পুজোর মধ্যে বিষাদের অনন্ত বীজ নিহিত। হাজার হইহল্লা, বিজ্ঞাপন, ঢাকের তাল বা পুজোর গানে যা কোনওভাবেই ঢাকা পড়বে না। পড়বে না, তার কারণ স্বজনবিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের অফুরন্ত এক মিছিল চলছে, বিন্দুমাত্র স্তিমিত হয়নি গত কয়েক মাসে। এই পরিস্থিতিতেও পুজোর বিপুল আনন্দ-আয়োজনকে, উপঢৌকনকে, এমনকী, শরৎকালকেও নিরর্থক মনে হয়। প্রতিদিনই কাছের মানুষরা আক্রান্ত হচ্ছেন, কেউ বা আইসিইউ-তে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। কেউ লড়ে জিতছেন। হেরে যাচ্ছেন কেউ কেউ। আমি সেই হেরে যাওয়া দলের মধ্যে পড়ি। ২২ সেপ্টেম্বর, আমার বাবা হেরে গিয়েছেন। আইসিইউ-তে একটানা ১২ দিনের লড়াইয়ের পর।
[আরও পড়ুন: আকাশে-বাতাসে দেবীর আগমনির সুর, মায়ের আশীর্বাদেই কি বিদায় নেবে করোনা?]
কারও ব্যক্তিগত ক্ষতির জন্য উৎসবের আলো বিন্দুমাত্র কম হবে, এমনটা হয়তো আশা করা যায় না। কিন্তু এই ব্যক্তিগত ক্ষতি কেবলমাত্র আমার একার, তা-ও বা ভাবি কী করে। তা তো আরও চেনাজানা অনেকেরও। যে-সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এবং সমস্যা এই যে, আরও বেশি সংখ্যক বিচ্ছেদ-সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে পুজোর জনস্রোতে। ভাইরাস যেখানে বিন্দুমাত্র দম্য নয়, তখনও সবকিছু স্বাভাবিক রাখার যে-প্রাণপণ চেষ্টা, তাই কি ‘নিউ নর্মাল’? এই জোর করা স্বাভাবিকত্বের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছি না কিছুতেই। শরৎকালের এই ফুরফুরে হাওয়া শীতকালের ঠান্ডা সন্দেহের ছদ্মবেশে এসে পড়েছে যেন। এই পুজোয় যে রাতভর জনঅরণ্য হেঁটে যাবে বাড়ির পাশ দিয়ে, তাদের কেউই আমার অংশ নয়।
গত কয়েক মাসে বারবারই ‘কোভিড-যুদ্ধ’ শব্দবন্ধটা উঠে এসেছে। এই যুদ্ধ কি বন্ধ হয়েছে আদৌ? বেরিয়ে গিয়েছে বহুপ্রতিশ্রুত ভ্যাকসিন? না কি ধরে নেওয়া যায়, বাঙালির সবচেয়ে বড় পুজো একরকমের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল? এই উৎসবমুখর, জমজমাট মানুষের ভিড় দেখে বারেবারেই কি খবরের কাগজের কোভিড পরিসংখ্যানের তালিকা মনে পড়ে যাবে না? ‘কোভিড ১৯’ এই বিরতির ধার ধারে না, উৎসবকে পরোয়া করে না। বরং, উৎসব সংক্রমণের অনুঘটক হয়ে দাঁড়াবে কি না, সে আশঙ্কাই বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, মহালয়ার পর সংক্রমণ হু হু করে বাড়তে থেকেছে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, পুজো-পরবর্তী সময়ের জন্য বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রস্তুতি থাকবে, বুঝলাম, কিন্তু এই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে এই বছরের পুজো কি সামান্য আয়োজনে মিটিয়ে নিলে চলত না? জাঁকজমকের খুব দরকার ছিল কি?
[আরও পড়ুন: শুধু ধর্ষণ নয়, হাথরাস কাণ্ড বর্ণাশ্রমের নয়া উত্থান]
কিছুদিন আগেও জমায়েত নিষিদ্ধ ছিল। ‘শারীরিক দূরত্ব’-র কথা বলা হচ্ছিল ঢালাও করে। মাস্ক পরে থাকার কথাও। এসব কি ছোট-বড় পুজোমণ্ডপে মেনে চলা হবে? বড় মণ্ডপগুলোয় না হয় স্বেচ্ছাসেবকরা থাকবেন, কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে পড়া জনস্রোতে ‘শারীরিক দূরত্ব’ বজায় থাকবে তো? মাস্ক ঠিকঠাক পরে থাকবেন তো সবাই? ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’- এ বছরও আধুনিক প্রবাদবাক্যটি যে এই পর্যায়ে বজায় থাকবে, ভাবিনি। নামকরা একটি জুতোর বিপণির ছবি ‘ভাইরাল’ হয়েছে। সেই গিজগিজে ভিড়ের দিকে তাকালে চোখে পড়বে ছোটদেরও মুখ। অনেকে এই ছবি দেখে শিউরে উঠেছেন। অনেকে বলেছেন, ‘পুজো তো, ও কিছু হবে না!’
বিসর্জনের সময়কার একটা স্লোগান মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ‘আসছে বছর আবার হবে।’ আসছে বছরে বিশ্বাস রাখুন। এ বছরে না হয় আনন্দে একটু লাগাম পরানো থাকল।