shono
Advertisement
Derek O'brien's

সংসদকে গুরুত্বহীন করে দিতে চাইছে বিজেপি, ডেরেকের বইতে সেই 'আঁখো দেখা হাল'

এক রাজনীতিক এবং পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে লেখক সংসদীয় ব্যবস্থার সংকটগুলি ধরতে চেয়েছেন।
Posted: 02:06 PM Apr 26, 2024Updated: 02:06 PM Apr 26, 2024

রাজ্যসভার সাংসদ তথা দলের উচ্চকক্ষের নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন গত দশ বছর ধরে সংসদীয় ব্যবস্থাকে খাটো করার খুঁটিনাটি অপকর্ম প্রত্যক্ষ করছেন। প্রতিবারই নতুন কৌশলে সংসদের অধিবেশনগুলিকে গুরুত্বহীন করে দিতে চাইছে বিজেপি সরকার। ‘হু কেয়ারস অ্যাবাউট পার্লামেন্ট’ তুলে ধরেছে সেই বিপজ্জনক প্রবণতা ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কার জায়গাগুলি। লিখছেন অর্পিতা চৌধুরী 

Advertisement

এক দশকের অবনমন ও আক্ষেপ। এই বইয়ে ধরা আছে এমনই টুকরো টুকরো ছবি। সংসদের অতীত গরিমা ইদানীং সত্যিই অস্তাচলে কি না, তার বিচার করবেন পাঠক। কিন্তু সংসদের এক প্রতিনিধি হিসাবে আইনসভার ভিতরে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করে যে-কোলাজ এঁকেছেন ডেরেক ও’ব্রায়েন, তা সময়োচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে বদলে যাচ্ছে সংসদের কাজকর্মের ধারা, এই বদল আইনসভার প্রাণশক্তিকে কতটা নিষ্প্রভ করছে, অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনামূলক আলোচনায় লেখক একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি সিংহভাগ দেশবাসীর এখনও সম্মান অটুট। বর্তমান শাসকের হাতে সংসদীয় ব্যবস্থার লাঞ্ছনা তঁাদের শঙ্কিত করে। সেই দলে আছেন স্বয়ং লেখকও।

‘হু কেয়ারস অ্যাবাউট পার্লামেন্ট’ তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের সাম্প্রতিকতম বই। এটি শুধু তঁার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাসের উপরে দঁাড়িয়ে লেখা নয়, বরং সাংসদের ভূমিকায় থেকে আইনসভার ভিতরে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জার্নি তুলে ধরার চেষ্টা। কল্পনা বা অনুমাননির্ভর প্রোপাগান্ডা নয়, এই বই বাস্তবিকই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ দলিল। বইয়ে বর্তমান বিজেপি জমানায় সংসদের বদলে যাওয়া ছবি। এবং যে-ছবি উদ্বেগের।

 

[আরও পড়ুন: প্রিয়াঙ্কার বিরুদ্ধে লড়তে নারাজ! রায়বরেলি থেকে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব ফেরালেন বরুণ গান্ধী

নরেন্দ্র মোদির ‘রামরাজ্য’ ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলির কী হাল করেছে, সচেতন নাগরিকরা এখন মোটামুটি সবাই বোঝেন। স্বাধীনতা-উত্তর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, রীতিনীতি, কাঠামোকে পরিকল্পনা-মাফিক দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। এই আগ্রাসন থেকে বাদ নেই গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ আইনসভাও। আমাদের দেশের সংবিধান যে-প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব স্বীকার করে, মোদির রামরাজ্যে বেছে-বেছে সেগুলিকেই আগে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার ‘টার্গেট’ নেওয়া হয়েছে যেন। এটি বিজেপির গোপন রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাও বটে। যে-সংসদ স্বাধীন ভারতের গরিমার অন্যতম স্মারক, সবার আগে তাকেই গুরুত্বহীন করে দিতে চায় মোদি সরকার। ইদানীং, বিজেপির কোনও কোনও নেতা যে জনান্তিকে সংবিধান বদলের উচ্চাশা ব্যক্ত করে ফেলছেন, তা-ও এই ভাবনারই পরবর্তী ধাপ।

তৃণমূল কংগ্রেসের তিনবারের রাজ্যসভার সাংসদ তথা দলের উচ্চকক্ষের নেতা ডেরেক গত দশ বছর ধরে সংসদীয় ব্যবস্থাকে খাটো করার খুঁটিনাটি অপকর্মগুলি প্রত্যক্ষ করছেন। প্রায় প্রতিবারই নতুন নতুন কৌশলে সংসদের অধিবেশনগুলিকে গুরুত্বহীন করে দিতে চাইছে বিজেপি সরকার। নিশ্চিতভাবে এই পদক্ষেপ বর্তমান শাসকের পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই অংশ। ‘হু কেয়ারস অ্যাবাউট পার্লামেন্ট’ তুলে ধরেছে সেই বিপজ্জনক প্রবণতা ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কার জায়গাগুলি। সংসদে বিরোধী স্বর দমন করার চেষ্টাই শুধু নয়, বিরোধী সদস্যদের গণ-বহিষ্কার চলছে এবং সমান্তরালভাবে বিরোধীশূন্য কক্ষে স্পর্শকাতর বিলগুলি আলোচনা ছাড়া একতরফা পাস হয়ে যাচ্ছে। আলোচনার পরিসর সংকোচনের কয়েকটি তথ্য উল্লেখ করতেই হয়। ১৭তম লোকসভায় (২০১৯ থেকে ২০২৪) সংসদে ১১৫টি বিল উত্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে ৮৫টি বিলের ক্ষেত্রে পূর্ব-আলোচনার সুযোগই দেওয়া হয়নি। দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে অন্তত ১০টি বিলের মধ্যে ৯টির ক্ষেত্রেই বিল পাসের সময় হয় কোনও আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়নি, অথবা আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে।

 

[আরও পড়ুন: দ্বিতীয় দফায় সবচেয়ে ধনী প্রার্থীর সম্পত্তি ৬২২ কোটি, কত টাকা নিয়ে লড়াইয়ে ‘দরিদ্রতম’?

তুল্যমূল্য আরেকটি পরিসংখ্যান। কোনও বিল পাস করার আগে তার খুঁটিনাটি নানা দিক পর্যালোচনা বা স্ক্রুটিনির জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর প্রথা। একটি নমুনায় বোঝা যাবে বর্তমানের হাল। ১৪তম লোকসভায় ৬০ শতাংশ বিল স্ক্রুটিনির জন্য পাঠানো হয়েছিল। ১৫তম লোকসভায় স্ক্রুটিনি হয়েছিল ৭১ শতাংশ বিলের। এরপর মোদির প্রথমবারের শাসনে ১৬তম লোকসভায় এই হার কমে হয় ২৬ শতাংশ। আর চলতি ১৭তম লোকসভা তো কার্যত রেকর্ড করেছে! ১০টি বিলের মধ্যে মাত্র একটিকেই স্ক্রুটিনির জন্য পাঠানো হয়েছে। উদাহরণ অনেক। বিতর্ক-আলোচনার দরজা বন্ধ করতে সংসদের নিয়মিত কাজকর্ম– যেমন স্পেশাল মেনশন, কলিং অ্যাটেনশন, রুল ২৬৭ ব্যবহার– কমেছে সবই। ২০১৭-য় পুরো সংসদকে অন্ধকারে রেখে রেল বাজেট পেশের ৯৩ বছরের রীতিতে রাতারাতি দঁাড়ি টানা হয়েছে। সাংসদদের মতামতের তোয়াক্কা করেনি মোদি সরকার।

২০২০-তে বিরোধী মত উপেক্ষা করে, সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি উড়িয়ে গা-জোয়ারি বিল পাস করায় মোদি সরকার। পরে কী হয়েছে সবার জানা। কৃষকদের আন্দোলনের চাপে নতিস্বীকার করে শেষপর্যন্ত কৃষি আইন বাতিল করতে হয়েছে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসক দলের অনীহা প্রসঙ্গে লেখক উল্লেখ করেছেন অ-বিজেপি রাজ্যগুলিতে বারবার সরকার ফেলার চক্রান্ত ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙে একদলীয় রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টার কথা। সার্বিকভাবে এই যদি হয় কেন্দ্রের শাসক দলের মনোভাব, তখন সংসদীয় ব্যবস্থার সংকট নিয়ে অাশঙ্কার যথেষ্ট কারণ থাকে। লেখক নিজেও অতীত আর বর্তমানের তুলনামূলক আলোচনায় মনে করিয়েছেন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি বর্তমান শাসকের যে অনাস্থা, তা নতুন সংসদ ভবনের জৌলুস দিয়ে ঢাকা যাবে না। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ঘেরাটোপে নতুন মডেলের সংসদভবন তৈরির কৃতিত্ব প্রচার এবং সংসদীয় সংস্কৃতিকে কবরে পাঠানোর চেষ্টা; এই দুই বিপরীতমুখী প্রবণতাই পাশাপাশি।

 

[আরও পড়ুন: মহিলা অসন্তোষের অভিযোগে প্রচারে যেতে ‘বাধা’! কল্যাণ-কাণ্ড নিয়ে মুখ খুললেন কাঞ্চন]

এই বইয়ে মূলত এক রাজনীতিক এবং পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে লেখক সংসদীয় ব্যবস্থার সংকটগুলি ধরতে চেয়েছেন, ফলে তঁার ভাষ্য অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হয়েছে। সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের বই ‘হু কেয়ারস অ্যাবাউট পার্লামেন্ট’ শুধু এই সময়ের দলিল নয়, ভবিষ্যৎ ইতিহাস চর্চারও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে রইল। রাজনীতি-সচেতন, অনুসন্ধিৎসু পাঠক ও গবেষকদের জন্য এটি চমৎকার উপহার। এজন্য লেখক সর্বতোভাবে ধন্যবাদার্হ।

বইয়ের একদম শেষে অন্যরকম চমক রেখেছেন লেখক। অংশটি বিশেষভাবে ছাত্রছাত্রী ও আইনসভা নিয়ে উৎসাহীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয়। কুইজের ফরম্যাটে ভারতের সংসদ নিয়ে প্রশ্নোত্তর। পরিশিষ্টের এই নতুনত্ব প্রসঙ্গে ডেরেকের সংক্ষিপ্ত সংযোজন: একজন কুইজ মাস্টার সবসময় কুইজ মাস্টারই থাকেন। ঠিকই। বাংলা প্রবাদই আছে: ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।


(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
হু কেয়ারস অ্যাবাউট পার্লামেন্ট: স্পিকিং আপ টু প্রোটেক্ট ইন্ডিয়া’স গ্রেট ইনস্টিটিউশন
রূপা পাবলিকেশন্‌স ৩৯৫্‌

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement