shono
Advertisement

সম্পাদকীয়: প্রাণ আগে, না প্লেন আগে?

কাবুল বিমানবন্দরে অসহায় মানুষের দৌড় দেখে হতবাক বিশ্ব।
Posted: 06:02 PM Aug 20, 2021Updated: 10:13 PM Aug 20, 2021

হামিদ কারজাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে দৈত্যাকার এরোপ্লেন গুড়গুড়ে বাচ্চার মতো হামা টানছে। ভীত আফগানের দল সেই প্লেনের আগে, পিছে, পাশে ছুটছে। তারা প্রাণের ভয়ে, নিরাপত্তার স্বার্থে তালিবান-অধিকৃত আফগানিস্তান থেকে পালাতে চায়। কেউ উঠে পড়ছে প্লেনের চাকায়, কেউ প্লেনের ডানায়। কতখানি অনিশ্চয়তা, অনাস্থা, অবিশ্বাস থাকলে মানুষ এমন পড়িমরি করে জায়গা নিশ্চিত করতে চায়? রানওয়ের মিচকে মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে এরা যাবেটা কোথায়? ‘গোয়িঙ ফার?’ লিখছেন ভাস্কর লেট

Advertisement

 

আফগানিস্তান বলতে আমরা সচরাচর কাবুলিওয়ালা বুঝি। আর, ‘কাবুলিওয়ালা’ বলতে বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তপন সিনহা। ‘খোখী, তোমি সসুরবাড়ি কখুনু যাবে না!’ এই অসংলগ্ন বাংলা বাক্যের খাঁচায় বিপুলদেহী কাবুলির চিরন্তন পিতৃহৃদয় আমরা খলবল করতে দেখেছি। কাবুলির মুখে ‘হামি সসুরকে মারবে’ শুনে রবীন্দ্রনাথের মিনির মতোই ‘শ্বশুর-নামক কোনো-এক অপরিচিত জীবের দুরবস্থা’ কল্পনা করে বিস্তর আমোদ পেয়েছি।

কিন্তু এর বাইরে? কথিত যে, কাবুলিওয়ালারা চড়া সুদে টাকা খাটায়। যাদের সেই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে, তারা যেচে-পড়ে আফগানিস্তান সম্বন্ধে বিনম্র কৌতূহল দেখিয়েছে বলে কখনও শুনিনি। আর, এরও বাইরে রয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলী-র অদ্বিতীয় ধ্রুপদী রসসাহিত্য ‘দেশে বিদেশে’। এই মুহূর্তে ঘন ঘন যে-বইটির অনুষঙ্গ টানা হচ্ছে। তা, আমরাও সঙ্গত দিলাম, খুলে বসলাম ‘দেশে বিদেশে’। নিন্দুকরা বলছে, এখন পরিস্থিতির চাপে নাকি খালেদ হোসেইনি-র ‘দ্য কাইট রানার’-এর বিক্রি বেড়েছে। হবেও বা। ‘দেশে বিদেশে’-র কপাল নিশ্চয়ই অত প্রশস্ত নয়। চট করে বিনি পয়সায় ‘পিডিএফ’ যে পাওয়া যায়
পুরো বইটার!

[আরও পড়ুন: Taliban-এর হাতেই যখন ক্ষমতা এল, তখন ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ খেলার কী দরকার ছিল আমেরিকার]

চাঁদনি থেকে ন’-সিকে দিয়ে শার্ট কিনে হাওড়া থেকে ‘ইউরোপীয়ন থার্ড’ বলে পরিচিত রেল-কামরায় উঠতে না উঠতে এক ফিরিঙ্গির প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সেই অভিজ্ঞতার ভজনা গেয়েই বইটি ঘোমটা খুলেছে। আসলে, এই দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। ফলে নিয়ম-কানুন বিজাতীয়। চাইলেই সব কামরায় দেশিরা গা এলিয়ে বসতে পারত না। ফিরিঙ্গি তাই হেঁকে সাবধান করল, ‘এটা ইউরোপীয়দের জন্য।’ মানে, ওহে কেটে পড়ো। আলী সাহেব অবশ্য দমলেন না। ‘ গাঁক’ করে বললেন, ‘ইউরোপীয়ন তো কেউ নেই, চল তোমাতে আমাতে ফাঁকা গাড়িটা কাজে লাগাই।’

আশ্চর্য, ‘গাঁক গাঁক’ করে বললেই বুঝি ফিরিঙ্গিরা বুঝে যায়? ব্যাটারা এত বাধ্য? না, তেমনটা নয়। এখানে ভাষাতত্ত্বের গূঢ় রহস্য আছে। আলী সাহেব তুলনাত্মক ভাষাতত্ত্বের কোনও বইয়ে পড়েছিলেন যে, বাংলা শব্দের শেষে (অন্ত্যদেশে) ‘অনুস্বার যোগ করিলে সংস্কৃত হয়।’ আর, ইংরেজি শব্দের গোড়ায় (প্রাগ্‌দেশে) জোর দিয়ে ‘কথা বলিলে সায়েবী ইংরেজী হয়।’ খারাপ রান্নায় যেমন তেড়ে লঙ্কা ঠেসে দিলে মুখরক্ষা অনিবার্য, তেমনই ইংরেজি বর্ণের প্রথম সিলেবলে তাগড়া অ্যাকসেন্ট দিলে অশুদ্ধ ইংরেজির চরিত্র-দোষ এবং ব্যাকরণিক ফাঁড়া কেটে যায়। একেই বলে ‘গাঁক গাঁক করে ইংরেজী বলা।’ ফিরিঙ্গিটি বাস্তবে তালতলার লোক। কাজেই এমন ইংরেজিতে সে খুশি হল। যা হোক, ট্রেন ছাড়ল। ফিরিঙ্গি জিজ্ঞেস করল, ‘এত মনমরা হলে কেন? গোয়িঙ ফার?’

‘দেশে বিদেশে’ আদতে ট্রাভেলগ। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান ভ্রমণের ভিত্তিতে লেখা। ১৯৪৮ সালের মার্চ থেকে তা ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকায়। এখন ২০২১। কিন্তু এই ‘গোয়িঙ ফার’ যেন একলহমায় সময়ের সব শিকল-গম্বুজ ভেঙে আমাদের ওই রেলগাড়িতে সৈয়দ মুজতবা আলীর সফরসঙ্গী করে তোলে।

‘গোয়িঙ ফার’ ভীষণ কেতার ইংরেজি। বুদ্ধিদীপ্ত, পরিশীলিত মননের সিলমোহর বহন করে। সেজন্য ‘হোয়্যার আর ইউ গোয়িঙ?’ এবং ‘গোয়িঙ ফার?’- শুনতে এক মনে হলেও প্রয়োগে ও অর্থে আলাদা। ‘গোয়িঙ ফার’ বলার মধ্যে একটা খোলামেলা ব্যাপার আছে। যাকে জিজ্ঞেস করা হল, সে চাইলে এর উত্তর দিতে পারে। আবার, না চাইলে, উত্তর এড়িয়েও যেতে পারে। ‘গোয়িঙ ফার?’ ইয়েস। ‘গোয়িঙ ফার?’ নো। যেমন খুশি বলো। বাধ্যবাধকতার আঁশ লেগে নেই। অথচ ‘হোয়্যার আর ইউ গোয়িঙ?’ বললে ফাঁকি দেওয়ার জো নেই।

কয়েক দিন আগে হামিদ কারজাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে একটি দৈত্যাকার ফ্লাইটের আশপাশে থিকথিকে মানুষের ভিড় দেখলাম। তারা প্রত্যেকে আফগানিস্তানের নাগরিক। প্রাণের ভয়ে ও নিরাপত্তার খাতিরে তালিবান-অধিকৃত আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যেতে চায়। এরোপ্লেনটি গুড়গুড়ে বাচ্চার মতো যেন রানওয়ে ধরে হামা টানছে। এবং ওই ভীত মানুষগুলো (কোনও নারীকে আমি অন্তত দেখিনি) প্লেনের আগে, পিছে, পাশে ছুটছে। যেতে নাহি দিব। ফ্লাইটের ডানার উপর উঠে পড়ছে অনেকে। কেউ কেউ জানালা খোলার চেষ্টা করছে। ভিতরে ঢুকবে বলে। কেউ বা এরোপ্লেনের চাকার উপরে উঠে থেবড়ে বসতে চাইছে। একবারও ভাবছে না, হয়তো ত্রাসে এবং চরম মরিয়া হয়ে ওঠার জন্যই এই স্বাভাবিক বোধশক্তি তাদের অবলুপ্ত হয়েছে যে, ফ্লাইট আকাশপথে উড়তে শুরু করলে চাকাগুলো ভিতরে গুটিয়ে যাবে, তখন কী হবে?

কুড়ি বছরের উপর শিয়ালদহ শাখায় লোকাল ট্রেন ঠেঙিয়েছি। হাড়ে হাড়ে জানি, যাওয়ার তাড়া এবং প্রাণের ভয়ের মধ্যে কেমন সূক্ষ্ম সমীকরণ চলে প্রতি মুহূর্তে। প্রাইম টাইমের ডায়মন্ডহারবার লোকাল দেখেছি। ক্যানিং লোকাল দেখেছি। বনগাঁ ও বারাসত লোকালও দেখেছি। কোনও মতে একপায়ে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছে মানুষজন এই দৃশ্য যেমন দেখেছি, তেমনই ভারসাম্য রাখতে না পেরে চলন্ত ট্রেন থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে মহিলা, তা-ও দেখেছি। একবার এক ভদ্রলোক ভিড়ে ঠাসা রানিং ট্রেনে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন নির্মমভাবে। মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। উনি একব্যাগ আম নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। অমন যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থায় ভদ্রলোক ক’টা আম ছিটকে পড়ল ট্রেনলাইনে তার হিসাব কষতে বসেছিলেন। আমরা স্তম্ভিত! বাক্যহারা! হৃৎপিণ্ড গলায় আটকে গিয়েছে মনে হচ্ছিল। তারপর একটা গুঞ্জন উঠল, এত তাড়া নিয়ে যাওয়ার কী আছে? প্রাণ আগে, না, ট্রেন আগে? তাছাড়া, কোথায় এমন যাবে? ‘গোয়িঙ ফার?’

সেদিন আফগানি এয়ারপোর্টে দিশাহারা লোকগুলোকে দেখেও আমি মনে মনে বলছিলাম- প্রাণ আগে, না, প্লেন আগে? এভাবে প্লেনে চাপা যায়? একটা তরিকা তো আছে না কি? এরোপ্লেন কি তাহলে বনগাঁ লোকাল হয়ে গেল? বন্‌ধের পরের দিন খবরের কাগজে একসময় বাঁধাধরা ছবি ছিল: জনমানবহীন রাস্তাঘাট, খাঁ খাঁ কলকাতা। পরে দেখেছি, সরকারি বাসে চাপার জন্য মানুষের আকুলিবিকুলি। বাদুড় হার মানবে যেভাবে মানুষ এককুচি পাদানিতে ঝুলতে ঝুলতে যেত। আঞ্চলিক রাজনৈতিক তরজায় যদি যেতে অনাগ্রহ থাকে, তাহলে দেশভাগের ফোটোগ্রাফ আছে। ট্রেনের কামরার মাথায় মাথায় যেভাবে লোটাকম্বল গুটিয়ে থমথমে আতঙ্কে বোবা হয়ে আছে ভিটে-হারানো মানুষের দল, ত্বকে পদ্মকাঁটা জেগে ওঠে। সব তো গিয়েছে। সামান্য, এই প্রাণটুকু আছে। তারই মীমাংসা করতে মানুষ পালাচ্ছে। যন্ত্রণায় এবং যন্ত্রণা লুকিয়ে। রক্তের মূল্যে এবং রক্তের মূল্য রাখতে। স্বাধীনতার সময়কালে এসপার-ওসপার যত ট্রেন চলাচল করেছিল, সেসব ট্রেন মানুষের পালানোর তাগিদ যত না বহন করেছিল, তার চেয়ে বেশি ধারণ করেছিল লাশ। লালিত করেছিল মৃতের দীর্ঘশ্বাস, আয়াত, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ধ্বনিতরঙ্গ। ’৪৭-উত্তর শরণার্থী শিবিরগুলিতে যে উলঙ্গ বেদনার নৃত্য আমরা দেখেছি আলোকচিত্রমালায়, তারই একটুকরো যেন বা সেদিন অভিনীত হতে দেখলাম আফগান মাটিতে, হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে।

আমেরিকা (America) চলে গিয়েছে। তবু কিছু প্রতিশ্রুতি, বা বলা ভাল দায়িত্বের ভ্রূণ, মাইন-এর মতো পোঁতা তো আছে। আচমকা তার উপর পা পড়লেই ফেটে যাবে। ফলে, জাল গুটিয়েও নেওয়া যাচ্ছে না। মাছ বঁড়শিতে লেগে থাকা টোপটুকু খায়। মরণফাঁদ এড়িয়ে চলে। কোন মাছ আর জালে পড়তে ভালবাসে? তাই হয়তো আফগানিস্তানে মাছ হওয়াই ভাল, মানুষের চেয়ে। কেননা, মানুষ হলে জালে গিয়ে লাফিয়ে পড়তে হবে। ওই যে হিড়িম্বা রাক্ষসীর মতো দুর্দান্ত বপুর বিমান, তার ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। আমরা ফোটোগ্রাফে দেখেছি, এরোপ্লেনের গর্ভগৃহে আশ্রয় ও স্বস্তি পাওয়ার জন্য কীভাবে মানুষ একে-অন্যকে ল্যাং মেরে সিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। এরপর যতবার ফ্লাইটে উঠব, দৃশ্যটা হয়তো আমাদের অনেককে তাড়া করে ফিরবে।

তাড়া? কতখানি তাড়া থাকলে এরোপ্লেনের পাশে পাশে দৌড়নো যায়? কতখানি ত্বরা থাকলে চলন্ত বিমানের ডানার উপর বসে পড়তে চায় ভূতগ্রস্ত মনুর সন্তানেরা? কতখানি অনিশ্চয়, অনাস্থা, অভক্তি, অবিশ্বাস থাকলে মানুষ এমন পড়িমরি করে জায়গা পাকা করতে চায়? বঁাচার বাসনার পারদ কতখানি ঊর্ধ্বগামী হলে মানুষ এরোপ্লেনের রাজকীয় স্টেটাসের ব্যানার একটানে ছিঁড়ে ফেলে সেটাকে দৈনন্দিনের বনগাঁ কি ক্যানিং লোকাল করে তুলতে চায়? যারা এখানে সন্দেহের পার্থেনিয়াম বুনতে চাইছে, তাদের বলি, লোকাল ট্রেনের যাত্রীরাও মানুষ। এরোপ্লেনের যাত্রীরাও মানুষ। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদের ওজন করছি না। যেটা বুঝতে চেষ্টা করছি তা হল, যারা সেদিন ফ্লাইটে উঠতে পারল, তারা কতদূর যাবে? ‘গোয়িঙ ফার?’ যারা সেদিন ফ্লাইটে উঠতে পারল না, তারা কতদূর যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে পোষণ করেছিল? ‘গোয়িঙ ফার?’

পিছুটান এবং আফগানিস্তান সমার্থক। ক্ষমতাদখল, হাতবদল, ক্ষমতার হস্তান্তরের ইতিহাস দেশটাকে খণ্ডহরে পর্যবসিত করেছে। কখনও রুশ তো কখনও আমেরিকা। এক টিপ করে নস্যি নিচ্ছে যে-যার মতো। আর, প্রগাঢ় ‘হ্যাঁচ্ছো ’ দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলেছে। কোনও বিদেশি শক্তি আফগানিস্তানে টিকতে পারে না, ইতিহাস বলে। কিন্তু দেশি শক্তিই-বা কতটা পেরেছে স্বাবলম্বী ও সুজলাং-সুফলাং দেশ গড়ে তুলতে? ধর্ম, শরিয়ত, লাইট মেশিনগান। ঘুরে-ফিরে এই তো ত্র্যহস্পর্শ। এই তো ত্রৈরাশিক, এই তো ভগ্নাংশ। উন্নয়ন বা শিক্ষা নয়, দেশি ও বিদেশি হুকুমতের মধ্যে এগুলোই তো তফাত করে দেয়। আবার, দেশি ও বিদেশি শাসনের চেনা স্বরলিপিও কি এগুলোই নয়? আড়াই চালে ক্রমাগত লাফিয়ে লাফিয়ে আফগানিস্তান পঙ্গু ঘোড়ার মতো হয়ে উঠছে। কাঠের পা দিতেই হবে চলার জন্য। দেবে কে? বিদেশি শক্তি, না, দেশি স্বাভিমান?

এই ভাবনা নিয়ে রিসার্চের গোল্লা পাকানো চলবে। আমরা বরং অবসরে ক্ষণিক ফিরে যাই মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’-র পাতায়। ৯৪ বছর আগের আফগানিস্তান যে এখন আর নেই, থাকতে পারে না, নস্টালজিয়ার সাগর সাঁতরে বাঙালিকে তা মেনে নিতেই হবে। ‘দেশে বিদেশে’ সাক্ষী, আহমদ আলী বলেছিলেন, ‘পাঠানরা বড্ড আড্ডাবাজ। গল্পগুজব না করে সে এক মাইল পথও চলতে পারে না।’ কাউকে না পেলে দরকারে মুচির পাশে গিয়ে বসে পড়বে। বলবে, ‘দাও তো ভায়া, আমার পয়জারে গোটা কয়েক পেরেক ঠুকে।’ এসব বস্তুত অজুহাত। অবান্তর অছিলা। মুচির সঙ্গে খানিক আড্ডা দেবে বলেই জুতো নিয়ে এত হেস্তনেস্ত করার ব্যারাম জেগেছে। বলা বাহুল্য, এই পাঠানের এখন দেখা মেলা ভার। এয়ারপোর্টে প্লেন ধরার জন্য যেভাবে মানুষজন ছুটছে তাতে নিজের প্রাণ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি ধেয়ান আছে বলে তো মনে হল না। আর, এই অবস্থায় সেটাই স্বাভাবিক। বেঁচে থাকাই জীবনের সিংহভাগ আশার চারাগাছ বাঁচিয়ে রাখে।

তাহলে এবার কাবুল ও কাবুলিওয়ালা নিয়ে অহৈতুকী রোমান্স ছেড়ে আমরা কাজের প্রশ্নে অবতীর্ণ হই। প্রাণ আগে, না, প্লেন আগে? প্লেনে জায়গা না পেলে প্রাণের নিশ্চয়তা নেই। আর, প্রাণের মায়া আছে বলেই তো প্লেন ধরার জন্য এত দক্ষযজ্ঞ। ‘ডিম, না, মুরগি’- কে কার ধাত্রী- এই প্রাচীন ধন্দ-সমাসের ধোঁয়াশার মধ্যেই দেখলাম সেই বিকট বিমান অবশেষে রানওয়ের মিচকে মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে গগনে উড়ল। যারা পারল না যেতে, তারা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। যারা চলে গেল, তারা কোথায় গেল? ‘গোয়িঙ ফার?’

এই থাকা ও যাওয়ার টানামানিতে কয়েকটা প্রাণ আবার নীরব শিউলির মতো এরোপ্লেনের বাইরের শরীর থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ল। ক্যামেরার আকাশভেদী সম্প্রসারণে আমরা দেখলাম, কীভাবে শান্ত বাতাস কেটে জ্যান্ত মানুষগুলো মাটিতে ঠিকরে এসে ঠোক্কর খেতে চলেছে। জীবন থেকে পালিয়ে না-হয় বাঁচা যায় না। কিন্তু মৃতু্যর পরেও-বা আকস্মিকের খেলায় উদ্‌ভ্রান্ত এই মনমরা আফগানরা কোথায় যাবে? ‘গোয়িঙ ফার?’

[আরও পড়ুন: Pegasus snooping row: বহুজাতিক স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছি কি আমরা?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement