স্মৃতিশাস্ত্র-ই ধর্মশাস্ত্র। সেই ধর্মশাস্ত্র দুর্গাপূজা তত্ত্বের কথা বলছে না, দুর্গাকেন্দ্রিক ধর্মকর্মের সামাজিক বিধিকে ‘উৎসব’ অভিধায় অভিহিত করে, সেটির নিয়মাবলি তুলে ধরছে। উৎসবের বর্ণচ্ছটা ছাড়া তার পরিস্ফূটন সম্পূর্ণ হয় না। ‘স্মার্তা’ রঘুনন্দন ভট্টাচার্য এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ষোড়শ শতকে। লিখছেন দেবাশিস পাঠক।
ষোড়শ শতাব্দী শ্রীচৈতন্যর সময়। সেই সময় নবদ্বীপে জন্ম নিয়েছিলেন স্মার্ত নৈয়ায়িক রঘুনন্দন ভট্টাচার্য। ইনি কে, কী তঁার পরিচয়– সেই কথা বিশদে লিখতে বসে সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘স্মৃতিশাস্ত্রে বাঙ্গালী’-তে (প্রথম প্রকাশ ১৯৬০) লিখছেন, ‘বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের কীর্তিস্তম্ভ তিনটি– নব্যন্যায়, নব্য স্মৃতি ও তন্ত্র। বহু কুশাগ্রবুদ্ধি নৈয়ায়িক তখন এই দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে রঘুনাথ শিরোমণি অগ্রগণ্য। বঙ্গীয় নব্য স্মৃতির সূত্রপাত খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতকেই হইয়াছিল। কিন্তু ষোড়শ শতকে রঘুনন্দনের হস্তে এই শাস্ত্র পরিপূর্ণ রূপ প্রাপ্ত হইয়াছিল।’
এখানেই পূর্ণ যতিচিহ্ন টানেননি সুরেশচন্দ্র। তিনি আরও লিখেছেন, “রঘুনন্দন বাংলাদেশের নব্য স্মৃতিতে প্রদীপ্ত ভাস্কর। এই ভাস্করের তেজে বাংলার স্মার্ত তারকাগণের প্রভা ম্লান হইয়া গিয়াছে। এখনও পর্যন্ত ‘স্মার্তাঃ’ এই ক্ষুদ্র শব্দটি দ্বারাই রঘুনন্দনকে বুঝানো হইয়া থাকে। কাব্যের ক্ষেত্রে যেমন কালিদাসকে লইয়াই কালিদাসের যুগ, বঙ্গীয় স্মৃতি সাহিত্যেও তেমন রঘুনন্দনই স্বীয় নামাঙ্কিত যুগের প্রসিদ্ধতম লেখক।”
এহেন যুগন্ধর ‘স্মার্তাঃ’ রঘুনন্দনের লেখা ‘স্মৃতিতত্ত্ব’ বইয়ের প্রথম ভাগ ‘মলমাসতত্ত্ব’। সেই বইয়ের শুরুতে ২৮টি তত্ত্বগ্রন্থের উল্লেখ আছে। সেগুলির অন্যতম– ‘দুর্গোৎসব তত্ত্ব’। স্মৃতিশাস্ত্র-ই ধর্মশাস্ত্র। সেই ধর্মশাস্ত্র দুর্গাপুজো তত্ত্বের কথা বলছে না, দুর্গাকেন্দ্রিক ধর্মকর্মের সামাজিক বিধিকে ‘উৎসব’ অভিধায় অভিহিত করে, সেটির নিয়মাবলি তুলে ধরছে। এটিই দুর্গাপূজার বিশেষত্ব। উৎসবের বর্ণচ্ছটা ছাড়া তার পরিস্ফূটন হয় না।
গণেশ চতুর্থী, কার্তিক পূর্ণিমা, কোজাগরী পূর্ণিমা, শ্রীপঞ্চমী, বসন্ত পঞ্চমী, দীপান্বিতা অমাবস্যা– দুর্গা ব্যতীত বাকি দেব-দেবীর পূজানুষ্ঠানের ‘নাম’ একটি সুনির্দিষ্ট তিথির মাহাত্ম্যেই সীমায়িত। দুর্গাপূজা তা নয় বলে, বৃহদায়তনের কারণে, সেটি দুর্গোৎসব। নির্দিষ্ট তিথির উদ্যাপনেই তা ফুরিয়ে যায় না। রঘুনন্দনের ‘দুর্গোৎসব তত্ত্ব’-য় লেখা আছে, ‘শারদীয়া মহাপূজা চত্তঃকর্মময়ীশুভা।/ তাং তিথিত্রয় মাসাদ্য বুর্থ্যাদ্ভক্ত্যা বিধানতঃ॥”
রঘুনন্দন ‘চত্তঃকর্মময়ী’ শব্দটার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘চত্তঃকর্মময়ী তানেন স্নপন পূজন বলিদান হোমরূপা।’ অর্থাৎ, স্নান, পুজো, বলিদান, হোম– এই চারটে কাজের সম্মিলনেই দুর্গাপূজা মহাপূজা কিংবা মহোৎসবে পরিণত হয়। পূজার আগে ‘মহা’ অভিধার সংযোজন সাধারণ ব্যাপার নয়। বিজ্ঞাপন, বিপণন আর মিডিয়ার অতিরঞ্জনের যুগে সব তিথি কিংবা পুণ্যাহের আগে ‘মহা’ বিশেষণটির সংযোজন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। কিন্তু, শাস্ত্র এমন নির্বিচার আতিশয্যের অনুমোদন দেয় না। বিষয়টা রঘুনন্দনের স্মৃতির আশ্রয়েই ব্যাখ্যাত হতে পারে।
রঘুনন্দনের ‘দুর্গোৎসব তত্ত্ব’-য় এই উৎসবের ছ’টি কল্প বিধান আছে। ‘কল্প’ শব্দটির দু’টি অর্থ। এক অর্থে ‘কল্প’ হল যুগ বা সময়কাল। অপর অর্থে ‘কল্প’ হল ‘বৈধ আচার’, অর্থাৎ ব্রত পালন, যা যজ্ঞানুষ্ঠানের তুলনায় ঈষৎ ন্যূন। দুর্গোৎসবের ছ’টি কল্প এরকম– ১) কৃষ্ণনবম্যাদি কল্প: এই কল্প অনুসারে ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যাবেলায় বেলগাছের ডালে দেবীর বোধন হয়। তারপর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ‘অধিবাস’-এর অর্থ ‘মাঙ্গলিক দ্রব্যের দ্বারা সংস্কার। এভাবে দেবী পূজার সূচনা ঘটে, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণানবমীতে। পরের পনেরো দিন ধরে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ২) প্রতিপদাদি কল্প: এই কল্প অনুসারে দেবীর বোধন হয় আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদে। তারপর অর্থাৎ মহালয়ার পর ন’টি রাত্রি ধরে দেবীর অর্চনা করা হয়। এই কল্পই হল নবরাত্রি ব্রত। ৩) ষষ্ঠ্যাদি কল্প: এটির সঙ্গে আমরা সর্বাধিক পরিচিত। এই কল্পানুসারে– ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন, তারপর তিনদিন, সব মিলিয়ে চার দিন ধরে দেবীর পূজা হয়। এখানে একটি কথা উল্লেখের দাবি রাখে। ‘বোধন’ শব্দটির অর্থ ‘জাগরণ’।
শারদীয়া দুর্গোৎসবে দেবীর বোধন হয়, বাসন্তী দুর্গাপূজায় বোধন হয় না। শরৎকাল দক্ষিণায়নের অন্তর্গত। সে-সময় দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই, শারদীয়া পূজায় দেবীর জাগরণের জন্য বোধনের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে, বসন্ত ঋতু উত্তরায়ণে। তখন দেব-দেবীদের দিন। জেগে থাকারই সময়। তাই বাসন্তী পূজায় বোধন অনাবশ্যক। ৪) সপ্তম্যাদি কল্প: এই কল্পের প্রধান আচার নবপত্রিকার স্নান। সমবেতভাবে নবপত্রিকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা। কিন্তু এর এক-একটি উদ্ভিদ দেবীর এক-একটি রূপের প্রতীক। কলা থেকে কচু, হলুদ থেকে ডালিম, অশোক থেকে মানকচু, জয়ন্তী থেকে বেল, আর লক্ষ্মীস্বরূপা ধান তো আছেই। এই ন’টি উদ্ভিদ অপরাজিতা, লতা আর হলুদ রঙের সুতো দিয়ে বেঁধে পুজো করা হয়। এটি আদতে কৃষিভিত্তিক সমাজে পৃথ্বীদেবীর পুজো পরম্পরা। ৫) মহাষ্টম্যাদি কল্প: এক্ষেত্রে প্রথমেই লক্ষণীয় ‘অষ্টমী’-র আগে ‘মহা’ শব্দটির অবস্থান। ষষ্ঠী বা সপ্তমীর আগে এই বিশেষণ বসেনি। অষ্টমী ‘মহাষ্টমী’, কারণ এদিনকার পুজো মহাবিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। মহাবিপত্তারক এই পূজা অনুষ্ঠান। ৬) মহানবমীকল্প: এক্ষেত্রেও ‘মহা’ জুড়েছে ‘নবমী’-র আগে। কারণ, নবমীর পুজো ‘মহাসম্পদ্দায়ক’, প্রচুর সম্পত্তি প্রদান করে।
স্কন্দ পুরাণের কাশীখণ্ড বলছে, ‘যে মাং দুর্গাং শরণ গা ন তেষাং দুর্গতি ক্কচিৎ’। অর্থাৎ দুর্গার শরণাগত ভক্তের সব দুর্গতি কেটে যায়। সেজন্যই মহাষ্টমীর পুজো। আর, শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বলা হয়েছে, ‘দারিদ্র্যদুঃখ ভয়হারিনী কা ত্বদন্যয়’। দেবীর অনুগ্রহে মহা সম্পদ লাভের বাসনাতেই মহানবমীর পূজা। সবশেষে দশমী, মুক্তিসুখে অবগাহনের দিন। ‘যা মুক্তিহেতুরবিচিন্ত্যমহাব্রত চ’ (শ্রীশ্রী চণ্ডী ৪/৯)।
সেই মুক্তিসুখে লেপ্টে থাকে শবোরৎসব। অন্ত্যজ শবর সম্প্রদায়ের পালনযোগ্য উৎসব। স্মৃতিশাস্ত্র প্রণোদিত করছে– দেবীর নিরঞ্জন হয়ে যাওয়ার পর ‘ভগলিঙ্গাভিধান’ দিয়ে, অর্থাৎ অশ্লীল শব্দ-সহযোগে, একে-অন্যকে গালিগালাজ করার জন্য। সেই সঙ্গে সারা শরীর পাতা দিয়ে ঢেকে, সারা গায়ে কাদা মেখে নাচ গান করতে। যে এরকম করবে না, যে এসবে অংশ নেবে না, তারা দেবীর ‘বিরাগভাজন’ হবে, এ-কথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। অর্থাৎ, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে তুমি যে স্তরেই বিরাজ করো, দশমীর দিন বিসর্জন শেষে, উচ্চবর্ণীয়দের ‘ডি ক্লাস’ হতেই হবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে। দীর্ঘ সময় ধরে এত কিছুর লক্ষ্য নিয়ে শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় বলেই এটা নিছক পূজা নয়, উৎসব। দুর্গাপূজা নয়, দুর্গোৎসব।
দুর্গাপুজোয় এই যে হুল্লোড়, উৎসবের আতিশয্য, বেলাগাম প্রাণোচ্ছলতার অত্যুচ্চ প্রকাশ, তা কেবল শাস্ত্রসিদ্ধ নয়। সমাজও এতে মদত জুগিয়েছে। ১৮১৯ সালের ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ জানাচ্ছে, সেবারের পুজোয় মহারাজা রামচন্দ্র রায় এবং ‘বাবু’ বোষ্টম ডস্ মল্লিকের বন্ধুরা পুজোবাড়িতে এমন সব কোকিলকণ্ঠীকে দিয়ে গান গাওয়াবেন, এবং এমন সব নৃত্য পটিয়সীর নাচ দেখাবেন, যঁাদের কলকাতা প্রেসিডেন্সি ইতিপূর্বে শোনেনি ও দেখেনি। নাচার জন্য আসছে নিকি আর নুরবক্স। পুজো শেষ হলে ‘ক্যালকাটা গেজেট’ জানাল, নিকি-নুরবক্সদের সঙ্গেই রূপচঁাদ রায়ের বাড়ির পুজোয় নৃত্য পরিবেশন করে গিয়েছে কাশ্মীরি সুন্দরী বুনু।
১৮২৬ সালের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ দুর্গোৎসব নিয়ে যে-কথা লিখল, সেটাই বোধহয় উনিশ শতকের ‘বাবু কালচার’-এর কলকাতায় দুর্গোৎসব সম্পর্কে শেষকথা। এই দুর্গোৎসব হল ‘a very heterogeneous soft of business’। হিন্দু বাঙালিদের বা়ড়িতে দেবী পূজার আয়োজন হয়, সেই আয়োজনে নৃত্য পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রিত হন অ-হিন্দু নর্তকী এবং বাজনাদাররা। আর, খ্রিস্টান সাহেবদের ডেকে আনা হয় বিফ-বিয়ার খাওয়ানোর জন্য। এরকম হইহুল্লোড় খানাপিনার ছাড়পত্র মেলে বলেই তো শরতে দুর্গা নিছক পূজিতা হন না। বরং বলা ভাল, তঁার পুজোকে কেন্দ্র করে যে-উৎসব চলে, সেটির কেন্দ্ররূপে তিনি বিরাজ করেন। রবীন্দ্রনাথ কি সাধে বলেছেন, ‘উৎসবের দিন সৌন্দর্যের দিন। এই দিনকে আমরা ফুলপাতার দ্বারা সাজাই, দীপমালার দ্বারা উজ্জ্বল করি, সংগীতের দ্বারা মধুর করিয়া তুলি।’
(মতামত নিজস্ব)
debashispathak2014@gmail.com