সনাতন হিন্দু ধর্মে নাকি ‘গার্হস্থ্য হিংসা’ বলে কিছু নেই। এদিকে, ভারতীয় মহিলাদের ৫২ শতাংশ ও পুরুষদের ৪২ শতাংশ সরাসরি মহিলাদের বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসাকে ‘জায়েজ’ বলে মনে করে। অর্থাৎ, হিংসা আছে। কেবল লিভ-ইন হলেই তা প্রকাশ্য, আর বিয়ে হলেই গুস্তাখি মাফ! লিখছেন অর্ণব সাহা
আপনি সাবালক, যথেষ্ট ভাল রোজগার করেন? প্রেমজ সম্পর্কে আছেন অথচ এক্ষুনি বিয়ে করতে চান না? লিভ-ইন রিলেশনশিপে (Live-in relationship) থাকতে চান? ফ্ল্যাট খোঁজার আগে জেলা কর্তৃপক্ষর কাছে নিজেদের সম্পর্কের রেজিস্ট্রেশন করান। না করলে দুই থেকে ছ’মাসের জেল অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। আপনাদের মধ্যে কোনও একজনের বয়স ২১ বছরের কম? ছেলে-মেয়ে দুই তরফের বাবা-মায়ের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে আসুন। সেই অনুমতিপত্র লোকাল থানায় জমা করুন। আপনার এই লিভ-ইন রিলেশনে থাকার মেয়াদ ৩০ দিন অতিক্রম করেছে? এখনও আইনি সম্মতি নেননি? দুটো রাস্তা খোলা। হয় বিয়ে করুন, অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা দিন অথবা কারাবাস করুন। আর যদি এই লিভ-ইন রিলেশনশিপ থেকে কোনও একজন পার্টনার বেরিয়ে যেতে চান, অপরজন খোরপোশের দাবি জানাতে পারেন। অনাদায়ে অন্যপক্ষের জন্য আরও কড়া কোনও শাস্তি অপেক্ষা করে আছে।
কী ভাবছেন? একুশে আইনের দেশে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন? না। এটা উত্তরাখণ্ড (Uttarakhand)। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতে প্রথম এই রাজ্যের বিধানসভায় ধ্বনিভোটে পাস হয়েছে ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড বিল’। কয়েক হাজার পাতার এই বিলটি পেশ করার আগে বিরোধী দলের বিধায়কদের সামনে রাখা হয়নি, বিরোধীরা সিলেক্ট কমিটিতে এই বিলের একাধিক অংশ নিয়ে কথা বলতে চাইলেও কোনও আলাপ-আলোচনার সুযোগই দেওয়া হয়নি। কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই বিল পাস করিয়ে নিয়েছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি। বিজেপি বিধায়করা এই বিল পাশ হওয়ার পর সমস্বরে বিধানসভায় ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তুলেছেন। তবে কি এই বিলই দেশে রামরাজ্যের সূচনা ঘটাল?
[আরও পড়ুন: আবু ধাবি সফরে মোদি, প্রধানমন্ত্রীর ‘বিকশিত ভারতের’ কথা শুনবেন হাজার হাজার প্রবাসী]
রামরাজ্য সত্যিই এসে গেল কি না, জানা নেই। কিন্তু এই বিল পেশ করার মধ্য দিয়ে উত্তরাখণ্ড বিধানসভা এই প্রথম রাষ্ট্রের হাতে যে কোনও অবৈবাহিক যৌন বা প্রেমজ সম্পর্ককে শাস্তিদানের অধিকার তুলে দিল। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছুই নেই। বিজেপির নেপথ্যে থাকা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দীর্ঘকাল ধরেই ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের এই দাবি জানিয়ে এসেছে। তাদের ছাত্র সংগঠন ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ’ বহুদিনব্যাপী ‘লিভ-ইন রিলেশনশিপ’ নামক এই ‘বিজাতীয় অসুখ’-কে সমূলে উৎপাটনের পক্ষে। এমনকী, তারা পূর্ববর্তী ইউপিএ সরকারের ‘গার্হস্থ হিংসা আইন’-এরও বিরুদ্ধে ছিল, কারণ, তাদের মতে সনাতন হিন্দু ধর্মে ‘গার্হস্থ হিংসা’ বলে কিছুর অস্তিত্বই নেই। এই ধরনের হিংসা নাকি একমাত্র ঘটে থাকে পাশ্চাত্য থেকে শেখা অবৈবাহিক একত্রবাসের মতো বিজাতীয় সম্পর্কের জুটির ক্ষেত্রেই।
কিছুদিন আগেই এক বিজেপি সাংসদ লিভ-ইন রিলেশনশিপ নিষিদ্ধকরণ ও যে কোনও বিবাহে উভয় পক্ষের পিতা-মাতার অনুমতি বাধ্যতামূলক করার পক্ষে আইন আনার কথা বলেছিলেন। উইনিফর্ম সিভিল কোডে পুরো বিষয়টাই রাখা হয়েছে মেয়েদের সুরক্ষার সাপেক্ষে সুন্দর সুন্দর কথা বলে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোনটা অগ্রাধিকার পাবে? সুরক্ষা, ব্যক্তিস্বাধীনতা নাকি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ?
[আরও পড়ুন: অযোধ্যাগামী আস্থা স্পেশাল ট্রেনে এলোপাথাড়ি পাথরবৃষ্টি! তদন্তে রেল পুলিশ]
সংঘের তাত্ত্বিক গুরু সদাশিব গোলওয়ালকরের অবশ্য এই ব্যাপারে কোনও দ্বিধা ছিল না। তিনি তঁার ‘বাঞ্চ অফ থট্স’ বইয়ে স্পষ্টই বলেছেন, স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক নৈতিকতা জিনিসটাই ‘অ-ভারতীয়’ ও ‘পাশ্চাত্যধর্মী’। শুধু তা-ই নয়, তিনি বলেছেন– ‘অবাধ সুযোগের সমতাবিধান এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা জিনিসটার ট্র্যাজিক পরিণতি হতে বাধ্য।’ অর্থাৎ ‘সনাতন ভারতীয় আইন ও শাসনতন্ত্র’ নামক খাপ পঞ্চায়েতই একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনধারা। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এরকমও দাবি করে যে, ভারতের বিবাহিত মেয়েরা লিভ-ইন জাতীয় সম্পর্কের মেয়েদের চেয়ে ঢের বেশি সুখী।
অর্থাৎ, তাদের ভাবনায় ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব এজেন্সি নামক ব্যাপারটারই কোনও অস্তিত্ব নেই। যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে, পারিবারিক অসম্মতির ফলে বা নিজস্ব জাতি-বর্ণ-গোষ্ঠীর বাইরে বিবাহের ফলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন একক ব্যক্তি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, অনেক বেশি গার্হস্থ হিংসার সম্মুখীন হয়। সংঘ যে ‘সার্ভে’ প্রকাশ করেছে, তা আসলে দেশের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যকামী নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে সাংবিধানিক মূল্যবোধের উপরে জবরদস্তি চাপিয়ে দিতে চায়। চতুর্থ জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় মহিলাদের ৫২ শতাংশ ও পুরুষদের ৪২ শতাংশ সরাসরি মহিলাদের বিরুদ্ধে পারিবারিক হিংসাকে জায়েজ বলে মনে করে। সংখ্যাধিক্যের মতামতকেই যদি গুরুত্ব দিতে হয়, তবে তো ব্যক্তির স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর বলে কোনও বস্তুই থাকবে না। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘জনগণ’ নামক গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে চলা জড়পিণ্ডকে এতটা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বিগত দশ বছরের মোদি জমানায়। এই নির্মনন জনসমষ্টি রাষ্ট্র, পরিবার, জাতি-বর্ণ, পারিবারিক গুরু এবং ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মূল্যবোধে অন্ধ বিশ্বাস ও আস্থা রাখে। এই নির্বোধ ভিড়ই গো-রক্ষার নামে সংখ্যালঘুকে পিটিয়ে মারে, এই ভিড়ের হাতেই ভ্যালেন্টাইন’স দিবসের দিন রোমিও স্কোয়াডের হাতে লাঞ্ছিত হয় প্রণয়ীযুগল, আবার এই ভিড়ই হিন্দু
নারীর সম্ভ্রম রক্ষার ছুতোয় লাভ-জেহাদের অজুহাতে মুসলিম পুরুষকে পেটায়। এই ভিড়ের মূল্যবোধই অসমের নগঁাও জেলায় একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে সারারাত
ধরে হেনস্তা করে, গুয়াহাটির পাব থেকে বেশি রাত করে বেরনো খোলামেলা পোশাকের মেয়েটির মাথা নেড়া করে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়। এমনকী, বিজেপির একজন মহিলা বিধায়ক এই লিঙ্গসন্ত্রাসকে সমর্থনও করেছিলেন।
২০১৯ সালে সমলিঙ্গের সম্পর্ক বিষয়ে ধারা ৩৭৭ অবলুপ্ত করার পক্ষে ঐতিহাসিক রায় দিতে গিয়ে দিল্লি হাই কোর্ট বলেছিল– ‘জনপ্রিয় নৈতিকতা অথবা জনতার অসম্মতি কোনওটাই সংবিধান-বর্ণিত ব্যক্তিস্বাধীনতার ২১ নম্বর ধারাকে অগ্রাহ্য করার পক্ষে যথেষ্ট জোরালো কারণ নয়… একমাত্র সাংবিধানিক নৈতিকতাই পাবলিক নীতিবোধের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে পারে, যতই সেই নীতিবোধ সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে থাকুক না কেন!’ কিন্তু দিল্লি হাই কোর্টের সেদিনের রায় শেষ অবধি সুপ্রিম কোর্টে অগ্রাহ্য হয়। এখন উত্তরাখণ্ড থেকে ইউসিসি-র যে-যাত্রা সূচিত হল, তা সর্বজনীন নাগরিক বিধিকে যদি ওই হিন্দু রক্ষণশীল জনপ্রিয়তার নিগড়েই বেঁধে রাখে– তবে, সমলিঙ্গের সম্পর্ক বা বিবাহ প্রথমেই নাকচ হবে, কারণ তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে ‘এলজিবিটিকিউ’ সম্প্রদায়। এই উত্তরাখণ্ড সরকারেরই অনুকরণে একাধিক বিজেপি-শাসিত রাজ্য তাদের বিধানসভায় ‘ধর্মান্তরকরণ-বিরোধী অর্ডিন্যান্স’ পাস করিয়ে নিয়েছে, যার দ্বারা একটি সাবালিকা হিন্দু মেয়ে স্বেচ্ছায় মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করতে গেলে আইনি বাধার সম্মুখীন হবে।
ইউসিসি-র মূল লক্ষ্যবস্তু– হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের বিরোধী যে কোনও সামাজিক আচরণকে একটাই আধিপত্যমূলক ছাতার তলায় নিয়ে আসা। আপাতত আদিবাসীদের এই বিলের বাইরে রাখা হয়েছে। সেটাও কত দিন থাকবে জানা নেই। সংবিধান প্রণয়নের ঠিক আগে বাবাসাহেব আম্বেদকর সতর্ক করেছিলেন– ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা কোনও স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত মতামত ধরে চলবে না… বুঝতে হবে ভারতীয় জনতার কাছে এখনও সাংবিধানিক মূল্যবোধ জিনিসটা সম্পূর্ণ বোধগম্য নয়… ভারতের মাটিতে গণতন্ত্র জিনিসটা কখনও কখনও অগণতান্ত্রিকভাবেই প্রয়োগ করতে হতে পারে।’ ইউনিফর্ম সিভিল কোডের নামে ব্যক্তির স্বাধীনতায় যে ভয়ানক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে নাগরিক হিসাবে আমরা সচেতন হব কি?