shono
Advertisement

কংগ্রেসের সঙ্গে আঞ্চলিক অ-বিজেপি দলের বোঝাপড়া কি বাড়ছে?

বিজেপি বিরোধী জোটের ভবিষ্যৎ কী?
Posted: 12:17 PM Jul 01, 2023Updated: 12:48 PM Jul 01, 2023

অতীতের তুলনায় এখন বিজেপি-বিরোধী ঐক‌্য অনেকটাই এগিয়েছে। তবে এই ঐক‌্য তখনই কার্যকর হবে যখন সমস্ত রাজ্যে অ-বিজেপি দলগুলোর মধ্যে আসন সমঝোতা হবে ও কংগ্রেস তাদের চিরায়ত উন্নাসিকতা ভাঙতে পারবে। মাথায় রাখতে হবে, রাজ‌্যস্তরে অ-বিজেপি দলগুলির বিরোধিতার দাপটে যেন কেন্দ্রে বিরোধী ঐক‌্যর কলসে স্বর ও উপস্থিতি ফাঁপা না শোনায়। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement

 

পাটনার পর এবার বেঙ্গালুরুতে বিরোধী দলের বৈঠক। শরদ পাওয়ার ঘোষণা করেছেন,
১৩-১৪ জুলাই বৈঠক হবে। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন ৮ জুলাই। এই ভোটপর্ব হয়ে যাওয়ার পরই বিরোধী বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। দিল্লিতে সর্বত্র আলোচনা বিরোধী ঐক‌্য নিয়ে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ মানসিকতা নিয়ে সব আঞ্চলিক দলের নেতারা কি ঝাঁপিয়ে পড়ছেন? কংগ্রেসের সঙ্গে আঞ্চলিক অ-বিজেপি দলের বোঝাপড়া কি বাড়ছে?

অমিত শাহ বলেছেন, বিরোধী ঐক‌্য, ঐক‌্য তো নয়, ফোটো অপারচুনিটি বা ফোটোসেশন যেন! তবে বিবৃতির ভিত্তিতে কখনও রাজনীতির প্রকৃত পরিচয় অনুধাবন করা যায় না। বাস্তবে, বিজেপির শীর্ষ-নেতৃত্বও এই বিরোধী ঐক‌্যর সম্ভাবনা বোঝার চেষ্টা করছে। মোদি-শাহর রণকৌশল: সাম-দান-দণ্ড-ভেদ। যেনতেন প্রকারে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস এবং বিরোধী নেতাদের মধ্যে বিভাজনকে আরও মজবুত করা। বিরোধী ঐক‌্য তখনই কার্যকর হবে, যখন রাজে‌্য রাজে‌্য বিভিন্ন অ-বিজেপি দলগুলোর মধ্যে আসন সমঝোতা হবে।

সেই কবে থেকে মমতা বন্দে‌্যাপাধ‌্যায় বলছেন লোকসভায় মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে যতটা সম্ভব ১:১ সমঝোতা প্রয়োজন। ‘সমঝোতা’ মানে মোদি-বিরোধী বিবৃতি প্রদানের নয়, আসন সমঝোতা প্রয়োজন। এখনও বিরোধী ঐক‌্য রচনায় এই প্রশ্নই হল প্রধান। পাটনা বৈঠকে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পরবর্তী কনক্লেভ হবে সিমলায়। যেমন, সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে সিমলায় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক অধিবেশনও হয়েছিল। কিন্তু পরে শরদ পাওয়ার সিমলার বদলে বেঙ্গালুরুর প্রস্তাব দিলেন।

[আরও পড়ুন: খলনায়ক থেকে নায়ক, মোদি স্তুতিতে আমেরিকা বুঝিয়ে দিল দেশই আগে]

২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ নিঃসন্দেহে ক্রমবর্ধমান। ’১৪ সালের মোদি ’২৪ সালের মোদি এক হতে পারেন না। ‘অ‌্যান্টি-ইনকামবেন্সি’ হল প্রকৃতির আদিসূত্র নিউটনের মাধ‌্যাকর্ষণ সূত্রের মতোই।

২০১৯ সালে অবশ‌্য মোদি জাদুকরের মতো ‘লাগ ভেলকি লাগ খেলা’ দেখান। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, পুলওয়ামা আক্রমণ, ‘জয় শ্রীরাম’- ইত‌্যাদি প্রভৃতি। ২০২৪ সালের ভোটের আগে বাজিকর নতুন কোনও ‘ম‌্যাজিক’ দেখাতে সক্ষম হবেন কি না জানা নেই। আস্তিনের নিচে তঁার লুক্কায়িত কোনও নতুন তাস আছে কি না , বা এমন কোনও ‘মন্ত্র’ যার উচ্চারণে ভোটাররা হিস্টিরিয়াক্রান্ত হবে, এখনও আমরা জানি না।

আপাতত বাস্তব পরিস্থিতি হল, দেশে আর্থিক সংকট চরমে। কর্মহীনতার সংকট। মূল‌্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি। এ যেন দুই ভারতের লড়াই। এক, নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। দুই, মোদির পাল্টা-আলেখ‌্যর ভারত, হিন্দুত্ববাদী সাভারকারের ভারত। এজন‌্য এবার পাটনায় মমতার দু’টি মন্তব‌্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, যা কম প্রচার পেয়েছে। প্রথমত, তিনি বলেছেন, আমরা বিরোধী নই। আমরাও ভারতমাতার পক্ষে, দেশাত্মবোধের পক্ষে। সত্যিই তো, রাজ্যে তৃণমূল শাসক দল, কেন্দ্রে বিরোধী দল। স্টালিন-নীতীশ-কেজরিওয়ালও তো তাই। বিভাজন তাই শাসক-বিরোধী নয়। ভারত নির্মাণ নিয়ে বিবাদ। দ্বিতীয়ত, মমতা বলেছেন, বিজেপি ইতিহাস বদলাতে চাইছে, আমরা ইতিহাস রক্ষায় আগ্রহী।

এসব বিতর্ক মতাদর্শগত, কিন্তু বাস্তবে বিরোধী জোটের ভবিষ‌্যৎ কী? বিরোধীদের এই জোট গঠন মানে নির্বাচনী আসন সমঝোতা খুব সহজে হবে?

একটা উদাহরণ দিই। বিহারে বিরোধী জোটের বৈঠকের পর অধীর চৌধুরীর বক্তব‌্য, নীতীশ কুমার ডেকেছিলেন। ও তো নেমন্তন্ন বাড়িতে খেতে যাওয়া। আগে অধীরবাবু বলেছিলেন, লক্ষ্মীপুজোর নিমন্ত্রণ।

বিহার বৈঠকে বহুদিন পর একই মঞ্চে রাহুল আর মমতা উপবিষ্ট হওয়ার পর একটি চ‌্যানেলের সঞ্চালক আমাকে প্রশ্ন করেন- এবার মমতা-রাহুলের ঐক্যে কি অধীর চৌধুরীর চাকরি যাবে? এ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম, আমার অভিমত ভিন্ন। এবার রাহুল গান্ধী কি অধীরবাবুকে নির্দেশ দেবেন রাজ্যে সিপিএম-কংগ্রেস জোট ভেঙে দিতে? কংগ্রেসের সঙ্গে কি মমতার আসন সমঝোতা হবে লোকসভা ভোটে? মনে হয় না। তবে জাতীয় স্তরে বিরোধী ঐক্যের প্রস্তুতি চলবে। আসন সমঝোতার জোট না হলেও মোর্চা গঠন হতে পারে। ‘ইউপিএ থ্রি’ না হোক, নতুন নাম ‘ইউনাইটেড পেট্রিওটিক অ‌্যালায়েন্স’ হতে পারে। প্রগতিশীল থেকে দেশাত্মবাদী। কিন্তু তাতে কী হল? অধীর চৌধুরী কর্ণাটকে কংগ্রেস জয়লাভের সঙ্গে সঙ্গে বিবৃতি দেন- বিজেপির দুর্নীতিযুক্ত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছি, এবার পশ্চিমবঙ্গে মমতার দুর্নীতিপরায়ণ সরকারকে উৎখাত করব।

যদি রাহুল গান্ধী চাইতেন, ফোন করে অধীরবাবুকে বলে দিতে পারতেন, ‘দাস্‌ ফার অ‌্যান্ড নো ফারদার’, চলো মমতার সঙ্গে। রাহুল তা বলছেন না। বলবেনও না। অধীরবাবু নিজে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করে বুঝিয়ে দিয়েছেন জাতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী ঐক‌্য হলেও রাজ‌্যস্তরে তৃণমূল বিরোধিতার প্রশ্নে কোনও আপস হবে না। অজয় মাকেনও একইভাবে কেজরিওয়াল বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাঞ্জাব ও দিল্লি কংগ্রেস নেতৃত্ব রাহুল গান্ধীকে অনুরোধ করেছে যাতে ভোটে কেজরিওয়ালের সঙ্গে সমঝোতা না-করা হয়। এজন‌্য কেন্দ্রের দিল্লি সরকার বিরোধী অর্ডিন‌্যান্সেরও বিরোধিতায় রাজি হয়নি কংগ্রেস।

সেপ্টেম্বরে মধ‌্যপ্রদেশ-ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ভাল ফল করলে তা কংগ্রেসের সর্বভারতীয় বাসনা-কামনা আরও বাড়াবে। কংগ্রেসের ‘বাইসেপ প্রদর্শন’ বৃদ্ধি পেলে অধীর চৌধুরী-অজয় মাকেনদের শক্তিও বাড়বে। দিল্লিতে দর কষাকষির জন‌্য রাহুল রাজ‌্য নেতাদের ব‌্যবহার করেন। একদা সিপিএমের সঙ্গে বোঝাপড়ার অভিযোগে মমতা সীতারাম কেশরী-প্রণব মুখোপাধ‌্যায়-সোমেন মিত্র জমানায় বিদ্রোহ করে নতুন দল গঠন করেন। সবাই তা পারেন না। পারলেও ব‌্যর্থ হন দলকে বিকশিত করতে। প্রণববাবু পারেননি, মমতা পেরেছেন। আর
যা-ই হোক, অধীর চৌধুরী মমতা বিরোধিতার জন‌্য পৃথক দল গঠন করে রাজ্যে এনডিএ-এর শরিক হবেন বলে মনে হয়?

[আরও পড়ুন: ওয়াগনার বিদ্রোহ কি পুতিনের শেষের শুরু?]

অন‌্য রাজ‌্যগুলোতেও অবস্থা তথৈবচ। স্টালিন ঘোষণা করেছেন, রাহুল গান্ধীই বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হবেন। স্টালিন বারবার এ-কথা বলেন। বিহার বৈঠকের আগে স্টালিনের এই মন্তবে‌্য নীতীশ কুমার অসন্তুষ্ট হন। নীতীশ তাঁর সঙ্গে দেখাই করতে গেলেন না। তেজস্বী যাদব একা গেলেন। কেননা, স্টালিনের মন্তব্যে কেজরিওয়াল, কেসিআর, মমতা, শরদ সকলেই ক্ষুব্ধ। নীতীশ-মমতার যুক্তি- এখনই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নিয়ে কোনও মন্তব‌্যই বাঞ্ছনীয় নয়। অনেকের সন্দেহ, স্টালিনের পিছনে আছে কংগ্রেসের আশকারা।

এরপর কীভাবে বিরোধী সমঝোতা হবে? আর মতাদর্শগত বিরোধ যেমন উদ্ধব-রাহুল, তেমনই কেরলে সিপিএম বনাম কংগ্রেস- যদিও সে আলোচনা তো না হয় আপাতত শিকেয় তুলে রাখলাম। তাই এককথায় যদি জবাব দিতে হয়, বলব, অতীতের তুলনায় এখন বিরোধী ঐক‌্য অনেকটাই এগিয়েছে। শরদ পাওয়ার, নীতীশ কুমার আর মমতার মতো পোড়খাওয়া নেতা আন্তরিকভাবে সচেষ্ট। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। ‘ক্ষুরস‌্য ধারা নিশিতা দুরত্ম‌্যয়া’। লক্ষ্যে উপনীত হতে, অনেকটা পথ এখনও পাড়ি দেওয়া বাকি।

 

(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
redhat.jayanta@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement