shono
Advertisement

মেঘ দে পানি দে

কৃষিতে কর্মসংস্থান কমলে ভোগ্যপণ্যের গ্রামীণ বাজারে ধাক্কা নেমে আসে।
Posted: 12:45 PM Jun 20, 2023Updated: 12:45 PM Jun 20, 2023

জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বৃষ্টিপাত কমার কারণে কোনওভাবে কৃষি উৎপাদন মার খেলে দেশে আর্থিক বিপর্যয় নামে। কৃষিতে কর্মসংস্থান কমলে ভোগ‌্যপণ্যের গ্রামীণ বাজারে ধাক্কা নেমে আসে। বৃষ্টিপাতের তারতম‌্য থেকে অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করতে পারে একমাত্র সেচসেবিত এলাকার পরিমাণ বৃদ্ধি। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

 

ত পাঁচ দশক ধরে আফ্রিকার দেশগুলির আর্থিক বিপর্যয়ের মূলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়া। একই সমস‌্যার সম্মুখীন হতে চলেছে ভারতের মতো এশিয়ার কয়েকটি দেশও। জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বর্ষাকালে যে বৃষ্টি হয়, তা সারা বছরের বৃষ্টিপাতের ৭৫ শতাংশের বেশি। এই বর্ষার বৃষ্টির ক্ষেত্রে নানারকম পরিবর্তন ঘটছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে এই পরিবর্তন লক্ষ‌ করা যাচ্ছে। যেমন, গত কয়েক দশক ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, জুন মাসে রাজ্যে বর্ষা আসার দিনটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে না। নানা কারণে জুনে সেভাবে বৃষ্টিপাত লক্ষ‌ই করা যাচ্ছে না। জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৃষ্টিপাতের এই পরিবর্তন সমগ্র অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে।

১৮৭১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ বছরের সংগৃহীত একটি তথ‌্যভাণ্ডার (বিনিশ কাঠুরিয়া ও বালাজি রাজাগোপালন, ইপিডব্লিউ, সংখ‌্যা ৫৮) থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতে সারা বছরে গড়ে ১০৮৫.৯ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এর মধ্যে জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৃষ্টি হয় ৮৪৮.২ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ, মোট বৃষ্টির ৭৮ শতাংশ। ফলে জুন থেকে সেপ্টেম্বর তথা বর্ষাকালে দেশের কোনও অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের তারতম‌্য ঘটলেই গোটা দেশের মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণে বড় প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ভারতে, তথা গুজরাট, হরিয়ানা, দিল্লি, পাঞ্জাব এবং চণ্ডীগড়ে সারা বছরে যা বৃষ্টিপাত হয়, তার ৮৯.৬ শতাংশই হয় বর্ষাকালে। বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টি না পেলে দেশের এই অংশে কার্যত খরা হয়। আবার পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ‌্যগুলিতে জুন থেকে সেপ্টেম্বরে সারা বছরের মোট বৃষ্টির ৬৮.৭ শতাংশ হয়। ফলে জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আমাদের রাজ‌্য-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃষ্টির কিছুটা ঘাটতি মানেই খরা নয়। কারণ, বছরের বাকি সময় আমরা মোট বৃষ্টির ৩০ শতাংশ পাই। সেই সময় এই ঘাটতি পূরণ হয়ে যেতে পারে।

তামিলনাড়ু, কেরল, পুদুচেরি, অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল এলাকা, কর্নাটকের উপকূল এলাকা- এই অঞ্চলে জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সারা বছরের মোট বৃষ্টির ৫৭ শতাংশ হয়। ফলে দেশের উপকূলীয় এই অঞ্চলগুলিও বর্ষার বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু সার্বিকভাবে যেহেতু গোটা দেশের ৭৮ শতাংশ বৃষ্টি জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই হয়, তাই এই সময়টায় বৃষ্টি কম হলে তা দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। ‘এল নিনো’-র কারণে এই জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ভারতে বৃষ্টিপাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের উপর বায়ুস্তর উষ্ণ হয়ে ওঠাকেই ‘এল নিনো’ বলে। এই ‘এল নিনো’-র জেরে ভারতের পশ্চিম অংশে বৃষ্টিপাত অনেকটা কমে যায়। প্রশান্ত মহাসাগরের উপর বায়ুস্তর ঠান্ডা হলে তাকে ‘লা নিনা’ বলে। এর প্রভাব ঠিক উল্টোটা হয়। অর্থাৎ, ‘লা নিনা’-র জেরে ভারতের কিছু অঞ্চলে জুন থেকে সেপ্টেম্বরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়।

ইপিডব্লিউ-তে কাঠুরিয়া ও রাজাগোপালনের দেওয়া তথ‌্য থেকে আমরা আরও পাই, ১৯৮০ থেকে ২০১৬-র মধ্যে রাজ্যে বর্ষার সময় ১০ শতাংশের বেশি বা কম বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৩ ও ২০০৭ সালে। সব মিলিয়ে ৩৬ বছরে অন্তত ১৭ বছর বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক হয়নি। এর মধ্যে কখনও ‘এল নিনো’-র প্রভাব কাজ করেছে। কখনও ‘লা নিনা’-র প্রভাব কাজ করেছে। ৩৬ বছরের রেকর্ডে ২৩ বছরই বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক নয় গুজরাট, হরিয়ানা, দিল্লি, পাঞ্জাব, চণ্ডীগড় এবং রাজস্থানে। অথচ, এই অঞ্চলে সারা বছরের বৃষ্টির প্রায় ৯০ শতাংশই হয় এই বর্ষাকালে। বর্ষাকালে এই অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে কৃষি উৎপাদন বাড়ে। মধ‌্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, গোয়া, তেলেঙ্গানা এবং উত্তর কর্নাটকে ৩৬ বছরের মধে‌্য ১৯ বার বৃষ্টিপাতে বড়সড় তারতম‌্য ঘটেছে। এই অঞ্চলে দেখা গিয়েছে ৩০ শতাংশ বৃষ্টিপাত বাড়লে কৃষি উৎপাদন অন্তত ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সামগ্রিকভাবে গোটা দেশের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরের তথ‌্য থেকে দেখা যায়, বৃষ্টিপাত যখন ২০ শতাংশ কমে যায়, অর্থাৎ খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন কৃষি উৎপাদন ১২.৩ শতাংশ কমে। আবার বৃষ্টিপাত বর্ষার সময় ২০ শতাংশ বাড়লে কৃষি উৎপাদন ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

[আরও পড়ুন: চিন না পাকিস্তান, প্রধান শত্রু কে? কী গল্প বলছে প্যাংগং-ডাল]

আসলে ভারতে কৃষি উৎপাদন প্রধানত বর্ষার বৃষ্টির উপরেই নির্ভরশীল। অঞ্চলভেদে এর কিছুটা প্রভেদ থাকলেও দেশে এখনও সেচসেবিত অঞ্চলের পরিমাণ খুবই কম। মোট কৃষিযোগ‌্য জমির অনুপাতে সেচসেবিত অঞ্চল কতটুকু, সেই বিচার করলে দেখা যাবে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতে এর পরিমাণ সবচেয়ে কম। এই অঞ্চলে মোট যত জমিতে চাষ হয়, তার মাত্র ২৪.১২ শতাংশ সেচসেবিত। আবার পাঞ্জাব, হরিয়ানা-সহ উত্তর-পশ্চিম ভারতে মোট কৃষিযোগ‌্য জমির মধ্যে সেচসেবিত হল ৭১.৯৪ শতাংশ। যে অঞ্চলের বৃষ্টিপাত প্রধানত বর্ষাকালে সীমাবদ্ধ, সেখানে সেচের প্রয়োজন সর্বাধিক।

ভারতে এখন কৃষি উৎপাদনের অবদান জিডিপি-র তথা দেশের অভ‌্যন্তরীণ বার্ষিক উৎপাদনের ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। জিডিপি-তে কৃষির অবদান ১৯৯১ সালের আর্থিক সংস্কারের পর থেকে ক্রমশ কমতে থাকলেও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এখনও দেশ অনেকটাই নির্ভরশীল কৃষির উপর। এখন দেশের কর্মক্ষম মানুষের ৪২ শতাংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত। ফলে জুন থেকে সেপ্টেম্বরে বৃষ্টিপাত কমার কারণে কোনওভাবে কৃষি উৎপাদন মার খেলে দেশে একটা আর্থিক বিপর্যয় ঘটে। জিডিপি বিশেষ না কমলেও গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব তৈরি হয়। আমাদের দেশে ভোগ‌্যপণে‌্যর বাজারের ৫০ শতাংশ গ্রামে। কৃষিতে কর্মসংস্থান কমলে ভোগ‌্যপণ্যের গ্রামীণ বাজারে ধাক্কা নেমে আসে। ভোগ‌্যপণ্যের বিক্রি যদি কমে, তার আঁচ গিয়ে শিল্পক্ষেত্রেও পৌঁছয়। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমলে শহরের অর্থনীতিও ধাক্কা খায়। উৎপাদন কমলে কৃষিপণে‌্যর দাম বাড়িয়ে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। সেটাও সার্বিক অর্থনীতির একটি ধাক্কা। এ বছরই যেমন আশঙ্কা করা হচ্ছে, ‘এল নিনো’-র প্রভাবে জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অংশে বৃষ্টি কম হবে। ফলে চাল, ডাল-সহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের উৎপাদন কমবে। যার অনিবার্য পরিণতি মূল‌্যবৃদ্ধি।

বৃষ্টিপাতের তারতম‌্য থেকে অর্থনীতিকে সুরক্ষিত করতে পারে একমাত্র সেচসেবিত এলাকার পরিমাণ বৃদ্ধি। যদি দেশের কৃষিযোগ‌্য সব জমিই সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়, তাহলে ‘এল নিনো’ বা ‘লা নিনা’ নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ থাকবে না। এখন দেশে ১ কোটি ২০ লক্ষ হেক্টর জমি সেচসেবিত। এটা বাড়িয়ে ১ কোটি ৪০ লক্ষ হেক্টর করার লক্ষ‌্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। কিন্তু, তার পরেও অর্ধেক জমি থাকবে বর্ষা নির্ভর। সেটা কীভাবে কমানো সম্ভব, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবনাচিন্তা করা উচিত।

(bapi.pratidin@gmail.com)

[আরও পড়ুন: মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না মেকি বাস্তবতা, প্রয়োজন কীসের?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement