ব্যোমকেশ যেমন নিজেকে বলতেন ‘সত্যান্বেষী’, টমাস পেশাগত পরিচয় হিসাবে ‘ফন্ট ডিটেকটিভ’ লব্জটি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। তাঁর সংস্থা এবং ওয়েবসাইট এই একই নামে। কখনও হরফকেন্দ্রিক তদন্তের প্রত্যক্ষ সমাধান, কখনও বা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বিবিধ দুর্নীতির ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ ব্যক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া- পশ্চিমি বিশ্বে এই হরফ জাসুসের পরিচিতি নেহাত মন্দ নয়। কলমে সুস্নাত চৌধুরী
‘As you are aware, E is the most common letter in the English alphabet, and it predominates to so marked an extent that even in a short sentence one would expect to find it most often.’ কোনও বৈয়াকরণ নন, বক্তার নাম শার্লক হোমস। ইংরেজি হরফ ব্যবহারের এই সূত্র ধরেই ‘The Adventure of the Dancing Men’ কাহিনিতে তিনি ভেদ করেছিলেন সাংকেতিক লিপির রহস্য। হরফনির্ভর গোয়েন্দাগিরির আর-এক প্রকার নিদর্শন দেখা যায় ‘গোলকধাম রহস্য’-য়। সেখানে ফেলু মিত্তির অপরাধীর কুকীর্তি ধরে ফেলেন নকল গ্যারামন্ড টাইপের ব্যবহার থেকে। কিন্তু এই ‘হরফের হোমস’ বা ‘ফন্ট-এর ফেলুদা’ যদি বইয়ের পাতা ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে এসে পা রাখেন, তাহলে কেমন হয়?
মার্কিন মুলুকে ঠিক এমনটাই ঘটে গিয়েছে! ঘটিয়েছেন যিনি, সেই গোয়েন্দাপ্রবরের নাম টমাস ফিনি। পোর্টল্যান্ডের বাসিন্দা। এখন পঞ্চাশোত্তীর্ণ। ব্যোমকেশ যেমন নিজেকে বলতেন ‘সত্যান্বেষী’, টমাস পেশাগত পরিচয় হিসাবে ‘ফন্ট ডিটেকটিভ’ লব্জটি ব্যবহার করতেই পছন্দ করেন। তাঁর সংস্থা এবং ওয়েবসাইট রয়েছে এই একই নামে। কখনও হরফকেন্দ্রিক তদন্তের প্রত্যক্ষ সমাধান, কখনও বা আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বিবিধ দুর্নীতির ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ ব্যক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া- পশ্চিমি বিশ্বে এই হরফ জাসুসের পরিচিতি আজ নেহাত মন্দ নয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও কানাডার একাধিক আদালতও ফন্ট-সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসাবে তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হরফের কাজ শুরু করেছিলেন দু’-দশকেরও বেশি আগে। প্রথম রহস্যের সমাধান ১৯৯৯ সালে। ধরে ফেলেছিলেন একটি জাল উইল। ক্রমে ফন্ট ডিটেকটিভ হিসাবে কাজের পরিধি বড় হতে থাকে। সাম্প্রতিক চার-পাঁচ বছরে তাঁর চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনই তদন্তের চাপ পৌঁছেছে তুঙ্গে।
[আরও পড়ুন: থমকে ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্যে, সুনাক কি সেই জট খুলতে পারবেন?]
জাস্টিন টিম্বারলেকের ‘ড্যাম গার্ল’ গানের কপিরাইট লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিতর্কের নিরসন থেকে গুগ্ল, মাইক্রোসফ্ট কিংবা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের নানা সমস্যায় হরফ বিষয়ক পরামর্শ দেওয়ার কাজ করেছেন ফিনি। ২০১৬ নাগাদ শোরগোল ফেলে দেওয়া পানামা দুর্নীতির তদন্তের সময়ও তিনি বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় ছিলেন। সেই কাহিনি রহস্য-রোমাঞ্চ নভেলের চেয়ে কম রোমহর্ষক নয়! পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফ সরকারের গদি কার্যত উলটে যায় এই ঘটনার জেরেই। নওয়াজের মেয়ে মরিয়মের সই করা গুরুত্বপূর্ণ একটি নথি যে-জাল, তা প্রমাণিত হয়। ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারিখের স্বাক্ষরিত কাগজটিতে লেখা ছিল ‘ক্যালিব্রি’ ফন্টে; অথচ ক্যালিব্রি মুক্তিই পায় ২০০৭-এর ৩১ জানুয়ারি। ‘মাইক্রোসফ্ট অফিস ২০০৭’ থেকে এই হরফটির যাত্রা শুরু। কাজেই, তার আগে সই করা নথি ক্যালিব্রি ব্যবহার করে লেখা সম্ভব ছিল না। সুকৌশলে তৈরি নথিটি যে আগাগোড়া ভুয়া, পুরনো তারিখ দিয়ে বানানো, তা প্রমাণে আর বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। শেষমেশ হাজতবাস হয় নওয়াজ ও তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্যের।
ইংরেজি কিংবা ফরাসির মতো রোমান হরফ-ই মুখ্যত, তবে ফারসি হরফ নিয়ে কেসও ফিনি অতীতে সামলেছেন। কিছুটা আয়ত্ত করেছেন গ্রিক আর সিরিলীয় টাইপোগ্রাফি। দ্রাবিড়ীয় অথবা বাংলা-হিন্দির মতো যেগুলি ভারতীয় ভাষা, অতীতে তাদের লিপিকৌশল শেখার খুব সামান্য চেষ্টা করলেও সেসব হরফের উপর ভিত্তি করে ঘনিয়ে ওঠা কোনও রহস্যের জাল ভেদ করা এ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। কখনও প্রয়োজন হলে এই ধরনের ক্ষেত্রে বরং ফিয়োনা রস, মহেন্দ্র প্যাটেল কিংবা সত্য রাজপুরোহিতের মতো ইন্ডিক স্ক্রিপ্টের দক্ষ টাইপ ডিজাইনার ও অভিজ্ঞজনের মতামত নেওয়াই যে তিনি সমীচীন মনে করেন, তা-ও নির্দ্বিধায় জানাচ্ছেন ফন্ট ডিটেকটিভ। হরফের যাবতীয় পরিপ্রেক্ষিতে নিজের কুশলতার কথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করার মতো ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা স্বীকারেও তিনি অকুণ্ঠ।
তাঁর রোজগারের শুরু বেশ অল্প বয়সেই। গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি। টমাস ফিনি তখন গড়পড়তা এক ডিটিপি অপারেটর। ডেস্কটপ পাবলিশিংয়ের সেই প্রথম যুগে কম্পিউটারে নানাবিধ লেখাপত্র কম্পোজের কাজ করতেন। সে-সময়ই হরফ নিয়ে আগ্রহের সূত্রপাত। ক্রমে সেদিকেই আরও মনোনিবেশ করেন তিনি। পরে প্রিন্টিং, গ্রাফিক আর্ট ও টাইপোগ্রাফি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভও করেন। কর্মসূত্রে ‘অ্যাডোব’, ‘ফন্টল্যাব’ ইত্যাদি সংস্থায় দীর্ঘদিন যুক্ত থেকেছেন। বানিয়েছেন একাধিক রোমান টাইপফেস। হরফ সংক্রান্ত চারটি পেটেন্টও রয়েছে তাঁর নামে। যদিও সময়ের সঙ্গে ফন্ট ডিটেকটিভ হিসাবে তাঁর পরিচিতিই হয়ে উঠেছে মুখ্য।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সর্বক্ষণ ও সর্বত্রই প্রায় ছড়িয়ে রয়েছে এই বস্তুটি- হরফ। ছোট, বড়। বাঁকা, সোজা। রঙিন, কালচে। কত বিচিত্র তার রূপ, কত ব্যাপক তার ব্যবহার! অথচ ধনী-দরিদ্র সাক্ষর-নিরক্ষর নির্বিশেষে সাধারণের যাপনে প্রতিটি মুহূর্তে তার অবস্থান এতই স্বাভাবিকতায় সম্পৃক্ত যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব আমরা পৃথকভাবে অনুধাবন করি না। ভাষার লিখিত রূপকে অতিক্রম করে গিয়েও তার অস্তিত্বের বিমূর্ত জায়গাটি সবাই পারি না সচেতনভাবে চিহ্নিত করতে। অথচ তা আমাদের অবচেতনকে প্রভাবিত করে চলে নিরন্তর, স্বচ্ছ এক পর্দার আড়াল থেকে। টমাস ফিনির দৃষ্টান্ত বস্তুকেন্দ্রিক এই জগতেও হরফের সেই বিমূর্ততার গুরুত্বের কথা প্রকারান্তরে আমাদের মনে করিয়ে দেয়। সেদিকে তাকাতে বলে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
susnatoc@gmail.com