ঋতুচক্রের স্বাভাবিকতা মেনে নিতে অক্ষম সমাজ। সে ‘দোষ’-এই এক কিশোরী ছাত্রীকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বসে পরীক্ষা দিতে হল!

ঋতুস্রাব আদতে যে কোনও মহিলার ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ঘটনা। কিন্তু আদিকাল থেকেই তা সামাজিক ‘ট্যাবু’ হিসাবে পরিগণিত। একটা সময় পর্যন্ত এ বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা না থাকায় বেশ কিছু ভ্রান্ত মতামত চালু ছিল। কিন্তু বর্তমান সময় বিষয়টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা থাকলেও, ঋতুস্রাব নিয়ে সমাজের একাংশের আচরণ রীতিমতো বিরক্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক। ঋতুমতী কিশোরী-মহিলাটিকে বাদ দিলে বাকি সকলের চোখে এ যেন কোনও ঘৃণার বিষয়।
বাস্তবে ঋতুস্রাব ঘোর সামাজিক বিষয়ও বটে। বিষয়টি নিয়ে সুস্থ আলোচনা অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু তা নিয়ে আলোচনার সিংহভাগ, নারীবিদ্বেষী। সম্প্রতি এমনই এক ঘটনার সাক্ষী থাকল দেশ। ঋতুমতী হওয়ার ‘দোষ’-এ তামিলনাড়ুর অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বসে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হল। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে এই ঘটনা তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের। স্কুল প্রিন্সিপালের নির্দেশে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বসে বিজ্ঞান পরীক্ষা দেয় ওই কিশোরী। একদিন নয়, একাধিক দিন। ভাইরাল হয়েছে ক্লাসের বাইরে বসে ছাত্রীর পরীক্ষা দেওয়ার ভিডিও। গত জানুয়ারি মাসে উত্তরপ্রদেশে একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। তার ভুল– পরীক্ষার মাঝে আচমকা ঋতুচক্র শুরু হওয়ায় শিক্ষকদের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিন চেয়েছিল ওই কিশোরী। স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন ছাত্রীর বাবা। প্রমাণিত, এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরেই ঋতুস্রাব নিয়ে হালেও নানা ধরনের কুসংস্কার বহাল। অথচ এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
বহিরঙ্গে পরিবর্তনপন্থী হলেও অনেকেই অন্তরে লালন করে সংকীর্ণতা। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ক্লেদ অনেকের মনকে অসুস্থ করে রেখেছে। সেই মন বৈজ্ঞানিক সত্যকেও দেখেও দেখতে পায় না। লিঙ্গবৈষম্য, মানবিক সংকট এবং নেতিবাচক ঐতিহ্য ঋতুস্রাবকে বঞ্চনা ও কলঙ্কে পরিণত করতে পারে, মৌলিক মানবাধিকারও ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
ভারতে কিছু প্রতিষ্ঠান ঋতুকালীন সবেতন ছুটির ব্যবস্থা করেছে ঠিকই। কিন্তু তা শতাংশের হিসাবে এতই নগণ্য যে, উল্লেখের উপযুক্ত নয়। এখনও ভারতে বয়ঃসন্ধিকালে অভিভাবকেরা নিরাপদ যৌনজীবন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করে না পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে। ফলে অনেকের কাছে ইন্টারনেট বা সামাজিক মাধ্যম হয়ে ওঠে তথ্য পাওয়ার উপায়। তবে সে সমস্ত তথ্য সবসময় যথেষ্ট তো নয়-ই, মাঝেমধ্যে ভুলও থাকে সেখানে। যার ফলে কিশোরীরা স্বাস্থ্যসংকটেও পড়ে। ‘প্যাডম্যান’ ছবিতে ভারতের ঘরে ঘরে এই কুসংস্কারের কথা, অচ্ছুৎ নারীযাপনের কথা জানান দিলেও আদতে দেখা যাচ্ছে, সমাজের মোড়লদের ঘুম ভাঙেনি।