বেবুন থেকে শিম্পাঞ্জি প্রত্যেকে নিজেদের মাংস খায়। মানুষও ব্যতিক্রম নয়। নিয়ানডারথালদের স্বজাতির মাংস খাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এই শতাব্দীতে নরমাংস খাওয়ার অপরাধে একজন ধৃত বলেছে, স্বাদে নাকি নরমাংস শুয়োরের মাংসের মতো খেতে। কিন্তু কেন এমন আচরণ করে মানুষ? লিখছেন সুমন প্রতিহার।
আটশো বছর আগে মিশরের নীল নদের তীরে তীব্র খরা দেখা দেয়। খিদের জ্বালায় জীবিত মানুষরা তখন বৃদ্ধ ও শিশুদের মাংস খেতে বাধ্য হয়। কথিত, ‘ধর্মযুদ্ধ’-র সময় যোদ্ধারা এভাবে সহ-মানুষের মাংস বাধ্য হয়েছিল খেতে। মানুষের মাংস-ভক্ষণে আদিম মানুষরা কতখানি স্বচ্ছন্দ ছিল, সে-ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলার উপায় নেই। শুধুমাত্র খিদের তাগিদে মানুষের মাংস খাওয়া হত, না কি বিশ্বাস ও সামাজিক রীতির বাধ্যবাধকতায়?
২০০৬ সালে একজন ভারতীয় চিত্র-সাংবাদিক অঘোরী-মতে বিশ্বাসী এক সাধুকে মৃতদেহ খেতে দেখেন। চারিদিকে হইচই পড়ে যায়। ডোমদের থেকে আরও জানা যায়, অঘোরীরা প্রায়শই শ্মশান থেকে মৃতদেহ তুলে নিয়ে যায়। ২০১৭ সালে ‘সিএনএন’-এর যুক্ত ইরানীয়-আমেরিকান লেখক রেজা আসলান অঘোরীদের পাল্লায় পড়ে মৃত মানুষের মস্তিষ্কের খানিকটা খেয়ে ফেলেছিলেন। সে-ঘটনার ভিডিও সম্প্রসারণও হয়। মায়ান সভ্যতার সদস্যরা আবার যুদ্ধবন্দিদের দেবতার উদ্দেশ্যে ‘বলি’ দিত। যদিও মায়ানদের মানব মৃতদেহ খাওয়ার প্রমাণ নেই। আজটেকরাও যুদ্ধবন্দিদের সাজিয়ে-গুছিয়ে দেবতাকে অর্পণ করত, আর পরে সেই মাংস নিজেরাও খেত। মানুষের বিবর্তনে মানুষের মাংস কতটা প্রয়োজনীয় ছিল সেটা ঠাহর করতে হলে ফিরতে হবে আদিম সময়ের গহ্বরে।
নিয়ানডারথাল গুহামানবরা বরাবরই নিপুণ শিকারি। কাঠের বর্শার অভ্রান্ত আঘাতে খরগোশ, হরিণ থেকে অতিকায় গণ্ডার, হাতি কাবু করেছে হেলায়। তাদের মধ্যে আত্মজনের মাংস খাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। আশ্চর্য হতে হয়, যখন জানা যায়, খাওয়ার শেষে হাড়গোড় ফেলেছিল অন্যান্য প্রাণীদের হাড়গোড়ের সঙ্গেই। গবেষক আলবান ডিফ্লুরকে সঙ্গী করে প্রত্ন-নৃতত্ত্ববিদ টিম ডি. হোয়াইট ঢোকেন ফ্রান্সের মুঁলা গের্সি গুহায়। ছড়িয়ে থাকা প্রাণী-হাড়ের মধ্যে পেলেন ৭৮টি হাড়, যা মোট ৬ জন আদিম মানুষের। কামড়ের ও অঁাচড়ের দাগ দেখে অনুমান করেন, মানুষের মাংস খাওয়া হয়েছিল। গুহায় আগুন জ্বালিয়ে মাংস ঝলসে নেওয়ার প্রমাণও মিলেছে। অত্যন্ত সাবধানী হয়েই টিম হোয়াইট বলছেন– নিয়ানডারথাল প্রজাতির প্রতে্যকেই নিজেদের মাংস খেত এমনটা কখনওই নয়, তবে কেউ-কেউ তো অবশ্যই খেত।
জেমস কোল, ব্রাইটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আধুনিক পূর্ণবয়স্ক মানব দেহের পুষ্টিমূল্য নির্ধারণ করেন। তঁার মতে, প্রায় একজন ৬৬ কেজির পূর্ণবয়স্ক মানুষ খেয়ে ফেলতে পারলে ১ লক্ষ ৪৪ হাজার কিলো ক্যালোরি পাওয়া যাবে। একটি বড় তুষারহাতি থেকে ৩৬ লক্ষ কিলো ক্যালোরি পাওয়া যায় অনায়াসে, একটি ঘোড়া থেকে ২ লক্ষ কিলো ক্যালোরি পাওয়া সম্ভব। নিদেনপক্ষে হরিণ হলেও ১ লক্ষ ৬০ হাজার কিলো ক্যালোরি পাওয়া সম্ভব। ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করে কোল বলেন, প্রাণী হিসাবে মানুষের মাংসের পুষ্টিগুণ ও ফ্যাট অন্য প্রাণীর তুলনায় বেশ কম। মাংসের পরিমাণও কম হয়। তাহলে মানুষ নিজেদের মাংস খেত কেন? পেট ভরানো বা পুষ্টিমূল্যের জন্য নিশ্চয় হত না।
নরমাংস ভক্ষণের জন্য ২০০৪ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন আরমিন মেউয়ুস। জেলে সোৎসাহে তিনি একজন সাংবাদিককে বলেছিলেন– মানুষের মাংস খেতে নাকি শুয়োরের মাংসের মতোই। তবে খানিক তেতো, ও কষা। তবে, একটি মতের উপরে নির্ভর করে স্বাদ নির্ধারণ বোকামি। উইলিয়াম বুয়েহলার সিব্রুক, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাংবাদিক, ক্যানিবলিজম নিয়ে লেখাপত্তরের জন্য বিখ্যাত। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জুনিয়র ডাক্তারকে পটিয়ে দুর্ঘটনায় সদ্য মৃত মানুষের থাইয়ের বেশ কিছুটা মাংস বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর কষিয়ে রান্না করে জমিয়ে খেয়ে বলেছিলেন– স্বাদ চনমনে বাছুরের মতো, শুয়োরের মতো কখনওই নয়। বলে না-দিলে নাকি কেউ বুঝতেই পারবে না– বাছুর না মানুষ।
ফ্রিজ হারমান ও কার্ল গ্রসম্যান জাতে জার্মান। এঁদের আরও একটা মিল রয়েছে। দু’জনেই খোলা বাজারে মানুষের মাংস কাচের শিশিতে ভরে শুয়োরের মাংস বলে বেমালুম চালিয়ে দিয়েছেন। তৎকালীন কিছু হতভাগ্য জার্মান ও পোল্যান্ডবাসী তা খেয়েও ছিলেন। এই ঘটনার ভিত্তিতে, মানুষের মাংসের স্বাদ, অনেকটাই শুয়োরের মতো, সে সিদ্ধান্ত হিসাবে ধরেই নেওয়া যায়। আবার প্রফেসর পল পেট্টিট বলছেন, মানুষই শুধু মানুষের মাংস খায় এমনটা ভাবা ঠিক নয়। বেবুন থেকে শিম্পাঞ্জি প্রত্যেকে স্বজাতির মাংস খায়। তঁার অভিমত, মানুষের নরমাংস খাওয়ার বিষয়টা ক্ষুধায় নয়, বরং অজ্ঞাত সামাজিক রীতির তাগিদে। কিছু গবেষকের মতে, এই স্বভাব হয়তো কিছুটা অবিন্যস্ত ও খেয়ালি অবচেতনে লুকিয়ে রয়েছে।
আদিম মানুষ কি মৃতদেহ সমাধিস্থ করার সময় অজ্ঞাত কোনও কারণে মাংস খেত? না কি মৃতদেহের সন্ধান পেলেই খাওয়া শুরু হতো সেখানেই। গৌঘ গুহায় পাওয়া গিয়েছিল এমন কিছু মানব অস্থি, যা থেকে নরমাংস খাবার বিচিত্র ধরনের আন্দাজ পাওয়া যায়। লন্ডন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মানব বিবর্তনের অধ্যাপক প্রফেসর ক্রিস স্ট্রিংগার হাড়ের উপর অদ্ভুত অঁাকিবুঁকি খুঁটিয়ে দেখে বলেছিলেন, তড়িঘড়িতে কিন্তু মাংস কামড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলা হয়নি। বরং ধীরে-সুস্থে ছাড়ানো হয়েছিল। সবশেষে হাড় ফাটিয়ে মজ্জা চুষে নেওয়া হয়। কিন্তু কেন? তা যৌথ অবচেতনের প্রতিক্রিয়া ও গহন সামাজিক প্রণোদনার উপরই শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হয়।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, কেশপুর কলেজ
pratihar_vu@rrediffmail.com