জীবনের দু’টি বড় পরীক্ষা হচ্ছে না বলে যাঁরা গেল-গেল রব তুলছেন, তাঁরা মনে হয়, একটু অতিরিক্ত উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। স্কুলে না যেতে পারার ক্ষতি পড়ুয়াদের হয়েছে। গত দেড় বছর ধরে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ। এই ক্ষতি অপূরণীয়। কিন্তু হয়তো ১০০ বছর পরপর এইরকম ক্ষতি আমাদের মেনে নিতেই হবে। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
জনসাধারণের মতামত নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করার বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরীক্ষা বাতিল ছাড়া ‘বিকল্প’ কোনও পথও এই মুহূর্তে ছিল না। দ্বিতীয় ঢেউ বাগে এলেও দেশ এখন করোনার তৃতীয় তরঙ্গের অপেক্ষায়। এই তরঙ্গের নিশানায় ছোটরাই। যারা আমাদের দেশে এখনও টিকার আওতায় আসেনি। এবার রাজ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক মিলিয়ে ২১ লক্ষ পরীক্ষার্থী। এদের বয়স ১৮-র নিচে। এরা কেউ টিকা পায়নি। এই বিশাল পরীক্ষার্থীর সংক্রমণের ঝুঁকি কোনও দায়িত্বশীল সরকার নিতে পারে না। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও সুযোগই নেই।
জীবনের দু’টি বড় পরীক্ষা হচ্ছে না বলে যাঁরা গেল-গেল রব তুলছেন, তাঁরা মনে হয়, একটু অতিরিক্ত উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। স্কুলে না যেতে পারার ক্ষতি পড়ুয়াদের হয়েছে। গত দেড় বছর ধরে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ। এই ক্ষতি অপূরণীয়। কিন্তু হয়তো ১০০ বছর পরপর এইরকম ক্ষতি আমাদের মেনে নিতেই হবে। অতিমারী ঘন ঘন হয় না। ১০০ বছর পরই একটা অতিমারী এসেছে। আইআইটি-তে ভরতি হয়েও অনেক পড়ুয়ার ক্যাম্পাসই দেখা হল না। স্কুলের নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়া যারা মিস করল, তারা স্কুলজীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়টাকে উপভোগ করতে পারল না। নিচু ক্লাসে সব পড়ুয়ার স্বপ্ন থাকে নাইন-টেনের দাদাদের মতো হওয়ার। বহু পড়ুয়ার সেটাই হওয়া হল না। অনলাইনে ক্লাস করে নাইন-টেন কেটে গেল বাড়িতে বসেই। স্নাতকোত্তরে ভরতি হয়েও বহু পড়ুয়া এখনও পর্যন্ত ইউনিভার্সিটির অঙ্গনে পা রাখতে পারল না। এসব ক্ষতে কোনও দিনই কোনও প্রলেপ পড়বে না। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে না পারার আক্ষেপ চিরকাল থাকবে। অতিমারীর কথা চিন্তা করেই সব ক্ষতি আমাদের স্বীকার করে নিতে হচ্ছে। কারণ, বেঁচে থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তো আর কিছু হতে পারে না।
[আরও পড়ুন: ছুঁয়েছিলেন সমুদ্রের রহস্যকে! টাইটানিক ডুববে, জানতেন তিনি?]
মাধ্যমিক (Madhyamik) বা উচ্চমাধ্যমিক যারা দিতে পারল না, তাদের হায়-হায় করে লাভ নেই। মেধাবী পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে পরীক্ষা দিতে না পারা একটি বড় আফসোস। মূল্যায়ন যে পদ্ধতিতেই হোক, মেধাবীদের কাছে তা কখনওই কাম্য নয়। মেধাবী পড়ুয়ারা পরীক্ষা দিয়েই আরও ভাল ফলের লক্ষ্যে পৌঁছতে চায়। আবার যারা গড়-মেধার পড়ুয়া তারা বেশিরভাগই স্বাগত জানাচ্ছে পরীক্ষা বাতিলকে। পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোনও মূল্যায়নের পদ্ধতিতে সাধারণভাবে এরা উপকৃত হয়। বিকল্প মূল্যায়নে এরা তুলনামূলকভাবে ভাল ফল করবে। রাজ্য বোর্ডের স্কুলগুলিতে নবম-দশমে অন্তর্বর্তী প্রস্তুতিকালীন মূল্যায়ন হয় না। উঁচু ক্লাসে গিয়ে মূল্যায়ন হয় পর্যায়ক্রমে। মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে নবম থেকে দশম শ্রেণি ওঠার ফলকে মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসাবে গ্রহণ করা হতে পারে। উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের কোনও পদ্ধতি বের করার কথা ভাবা হচ্ছে। আগামী সাতদিনের মধ্যে রাজ্য সরকার তা ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছে। মূল্যায়ন যে পদ্ধতিতেই হোক, তাতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভাল যে হবে, তা ধরেই নেওয়া যায়।
তবে যেহেতু পরীক্ষা হল না, তাই সরকারের সচেষ্ট হওয়া উচিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যাপারে। যারা মাধ্যমিক পাস করে উচ্চমাধ্যমিকে (Higher Secondary) ভরতি হবে, কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পাস করে যারা উচ্চশিক্ষায় যাবে, দু’দল পড়ুয়ার ক্ষেত্রেই এবার কাউন্সেলিংয়ের কথা ভাবা যেতে পারে। এই কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে পড়ুয়াদের কার কোন বিষয়ে পড়াশোনার প্রবণতা, অর্থাৎ কে কোন বিষয় নিয়ে পড়লে উপকৃত হবে, সে-ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া হোক। যেহেতু পরীক্ষা হচ্ছে না তাই পড়ুয়াদের কাছে হাতে গরম বোঝার সুযোগ নেই কে কোন বিষয়ে মেধাবী। কাউন্সেলিংয়ের মধ্য দিয়ে বাড়ির কাছে স্থানীয় স্কুলে ভর্তির বিষয়টিও নিশ্চিত করা যেতে পারে। অতিমারী পরিস্থিতিতে পড়ুয়াদের স্কুলে স্কুলে ঘোরার অবকাশও নেই। একইভাবে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণদের ক্ষেত্রেও কাউন্সেলিং জরুরি। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে যদি সঠিক বিষয় নির্বাচন করে পছন্দের স্কুলে ভরতি সুনিশ্চিত করা যায়, তাহলে পরীক্ষা না দেওয়ার ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে যাবে। একইভাবে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে যদি উচ্চশিক্ষার ভরতি এইভাবে সুনিশ্চিত হয়, তাহলে পরীক্ষা না হওয়ার ক্ষত পূরণ হবে।
তবে সবার ক্ষেত্রে যে এই পদ্ধতিতে ন্যায্য মূল্যায়ন হবে, তা নয়। কিছু ক্ষেত্রে কোনও কোনও পড়ুয়া বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাবে। কেউ কেউ নিজের মেধার সঠিক মূল্যায়নের সুযোগ পাবে না। এটা অবশ্য পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সবসময়ই ঘটে থাকে। পরীক্ষার দিন শরীর খারাপ বা পারিবারিক কোনও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে অনেক মেধাবীর ফল খারাপ হয়ে যায়। ততটা মেধাবী নয়, এমন অনেক পড়ুয়া উচ্চশিক্ষায় ভরতির ক্ষেত্রে ব্যাকডোরের সুযোগ পায়। ভাল কলেজে ভাল বিষয়ে অনার্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাকডোরেরও ভূমিকা থাকে। যে-কোর্সে ভরতি হওয়ার মতো তার নম্বর নেই, প্রভাব খাটিয়ে সেই কোর্সেই ভরতি হয়ে যায় অনেক পড়ুয়া। এই ঘটনা যখন স্বাভাবিক সময়ে পুরোপুরি এড়ানো যায় না, তখন এই অতিমারীর পরিস্থিতিতে সেরকম কিছু ঘটনা যে ঘটবে, তা ধরে নিতে হবে। মোটের উপর কাউন্সেলিং করলে অনেকটাই ন্যায্য বিচার পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে বেশিসংখ্যক পড়ুয়ার কাছে। উচ্চমাধ্যমিক বস্তুত উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সোপান। উচ্চশিক্ষায় সঠিকভাবে প্রবেশের সুযোগ যদি করা যায়, তাহলে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না দিতে পারার ক্ষত ভবিষ্যতের জন্য তেমন গভীর হবে না।
মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সচেতনতাও একটা মাপকাঠি। গত দেড় বছর ধরে অনলাইনে যে লেখাপড়া হচ্ছে, তাতে পড়ুয়ারা কতটা উপকৃত হতে পারল, সেটা যেমন অনেকটাই নির্ভরশীল অভিভাবকের সচেতনতার উপর। যেক্ষেত্রে বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়ার বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন, সেক্ষেত্রে পড়ুয়ারা উপকৃত হচ্ছে বেশি। মূল্যায়নও বহু ক্ষেত্রে সঠিক হচ্ছে। এমন অনেক ঘটনা এই সময়কালে শুনেছি যে, অনলাইনে পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাড়িতে পরীক্ষকের ভূমিকা পালন করছেন মা-বাবারা। যেক্ষেত্রে বাবা-মা ততটা সচেতন নন, সেক্ষেত্রে অনলাইন পরীক্ষায় পড়ুয়ারাও অনেক অন্যায় পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। তবে অনলাইন শিক্ষায় অন্যায় পদ্ধতি রোধ করার প্রযুক্তিগত সুবিধা রয়েছে। আবার পরীক্ষার প্রশ্ন এমনভাবে করা যায় যে, অনলাইনেও বই খুলে লেখার সুযোগ থাকে না। এবারই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের অনলাইন পরীক্ষার পর বহু পরীক্ষার্থীর প্রতিক্রিয়ায় শুনেছি, এমনভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, বাড়িতে বসে পরীক্ষা দিলেও বই খুলে দেখার সময়ই পাওয়া যায়নি।
যাই হোক, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক অনলাইনেও হচ্ছে না। মূল্যায়নের যে-পদ্ধতি বেরবে, সেখানে বাড়িতে বসে অনলাইনে পরীক্ষার কোনও সুযোগ থাকবে না। ধরে নেওয়া যেতে পারে, মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে কারও কোনও ক্ষোভ থাকবে না। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে যদি মূল্যায়ন-পরবর্তী পড়ুয়াদের ভরতির ক্ষেত্রে একটা ন্যায্য বা সমতা সুনিশ্চিত করা যায়, তাহলে পরীক্ষা না হওয়ার ক্ষত বহুলাংশে মেরামত হয়ে যাবে। সরকার দু’ক্ষেত্রেই কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টি বিবেচনা করুক। করোনা-বিধি মেনেই এটা করা সম্ভব। অনলাইনেও কাউন্সেলিং হতে পারে। পড়ুয়াদের সংখ্যাটা একটা সমস্যা। সেক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকৃতভাবে কাউন্সেলিংয়ের কথা ভাবা হোক।