shono
Advertisement

পেয়ারায় লক্ষ্মীলাভ, ‘গরিবের আপেল’ চাষ করে আয় হাজার-হাজার টাকা

পেয়ারা চাষের উপযুক্ত আবহাওয়া কেমন?
Posted: 01:59 PM Jan 17, 2024Updated: 01:59 PM Jan 17, 2024

পেয়ারা পশ্চিমবঙ্গের তথা সমগ্র ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। একে ‘গরিবের আপেল’ বলা হয়ে থাকে। এটা ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস সমৃদ্ধ, এবং এতে বিপুল পরিমাণে স্কার্ভি-রোগ প্রতিরোধী ভিটামিন-সি বর্তমান। পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে পেকটিন থাকায় এটি জ্যাম, জেলি তৈরিতে অদ্বিতীয়। পেয়ারা চাষ বেশ লাভজনক। বিঘাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ের সুযোগ রয়েছে এই ফল চাষে। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাত্র তন্ময় মণ্ডল ও ওসমান আলি।

Advertisement

প্রয়োজনীয় আবহাওয়া
পেয়ারা ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে সারা বছর চাষ হয়ে থাকে। শীতকালে রাতে তাপমাত্রা ১০-১২ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড হলে ভাল মানের পেয়ারা পাওয়া যায়। এটি উচ্চ তাপমাত্রা এবং খরা সহ্য করতে পারে। কিন্তু তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। এর বৃদ্ধির জন্য বার্ষিক ১০০ সেমি বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। ফল ধরার সময় বৃষ্টি হলে ফলের উৎপাদন এবং গুণমান ব্যাহত হয়।

প্রয়োজনীয় মাটি
পেয়ারা ভারী কাদা মাটি ছাড়া সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়। এটা হালকা বেলে দোআঁশ থেকে কাদা দোআঁশ মাটিতে চাষ ভাল হয়। অগভীর জমি, দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা জল পেয়ারা চাষের পক্ষে ক্ষতি করে। মাটির পিএইচ ৬.৫ থেকে ৭.৫ হলে সর্বাপেক্ষা ভাল।

বংশবিস্তার
বিভিন্ন প্রকারের কলম করে ভাল জাতের গাছের বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। যেমন গুটি কলম, জোড় কলম, চোখ কলম ইত্যাদি। এর মধ্যে গুটি কলম পদ্ধতিটি সহজ এবং বহুল প্রচলিত। সাধারণত ১ বছরের চারা রোপণের জন্য ব্যবহৃত হয়।

গুটি কলম
কলম করার জন্য দেড়-দুই বছর বয়সি গাছের ডাল নির্বাচন করতে হবে। এর বেশি বয়সি গাছের পেনসিলের মতো মোটা ডালেও গুটি কলম করা যায়। গুটি কলম করার জন্য প্রথমেই মাটির পেস্ট তৈরি করতে হবে। জৈব সারমিশ্রিত ৩ ভাগ এঁটেল মাটি ও ১ ভাগ পচা গোবর বা পচা পাতা একত্রে জল দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। প্রথমে মাতৃগাছে পেনসিলের মতো মোটা একটি ডাল বেছে নিতে হবে। মাতৃগাছের নির্বাচিত ডালের আগা থেকে ৪০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা একটি গিঁটের নিচে কলমটি করতে হবে। ডালের মধ্যে একটি গিঁটের নিচে তিন-চার সেন্টিমিটার মাপে ডালের ছাল ধারালো ছুরি দিয়ে গোল করে কাটতে হবে। বাকল ওঠানোর পর কাঠে লেগে থাকা সবুজ রঙের আবরণটি ছুরির উলটো দিক দিয়ে চেঁছে নিতে হবে। মাটির পেস্টটি ডালের কাটা অংশে দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। যেন বাকল তোলা পুরো জায়গায় ঠিকমতো মাটির পেস্টটি বসে। এর ৬-৮ সপ্তাহ পরে ওখানে প্রচুর পরিমাণে শিকড় বার হয়। ওই অংশ পরে কেটে নিতে হবে ও পলিথিন শিট খুলে ছায়াতে রাখতে হবে। এরপর বর্ষাকালে জমিতে লাগানো হয়ে থাকে। চারা লাগানোর সময় গ্রীষ্মকালে বা বর্ষার শুরুতে। চারা বসানোর দূরত্ব ১৮ ফুট × ১৮ ফুট; ১৫ ফুট × ১৫ ফুট; ১২ ফুট × ১২ ফুট।

[আরও পড়ুন: জ্যোতি বসু সেন্টারের শিলান্যাসে অনিশ্চিত নীতীশ-বিজয়ন]

বসানোর পদ্ধতি
প্রতিটা গর্তে ১০-১৫ কেজি ভালভাবে পচানো গোবর সার, নাইট্রোজেন, সিঙ্গেল সুপার ফসফেট ও মিউরেট অফ পটাশ ৫০ গ্রাম করে দিতে হবে। বর্ষার আগে প্রতিটি গর্তের মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে চারা রোপণ করতে হবে। চারা বসানোর গভীরতা ২ ফুট চওড়া, ২ ফুট গভীর ও ২ ফুট লম্বা গর্তে চারা বসাতে হবে।

জমি তৈরি
সাধারণত গ্রীষ্মকালে জমি তৈরি করা হয়। জমি গভীর ভাবে চাষ দিয়ে, মই দিয়ে সমতল করে আগাছা মুক্ত করতে হবে। চারা রোপণের পূর্বে ১৮ ফুট দূরত্বে ২×২ ×২ ঘন ফুট গর্ত তৈরি করতে হবে।

শাখা বিন্যাস ও শাখা ছাঁটাই
শাখা বিন্যাস গাছের নতুন পর্যায়ে করা হয়। পুরাতন ডাল পালা, রোগ পোকা আক্রান্ত শাখা এবং অতিরিক্ত ডালপালা কেটে দিতে হবে।

আচ্ছাদন করা
শুকনো পাতা বা খড় দিয়ে মাটি আচ্ছাদন দেওয়া হয়। এছাড়াও কালো পলিথিন শিট বা জৈব পদার্থ দিয়ে করা হয়। এটি মাটির আর্দ্রতা সংরক্ষণ করে এবং ফলের গুণগত মান উন্নত করে। আচ্ছাদন বছরে দুইবার করা হয়।

বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক
শীতকালীন ফসলের ভালো মানের জন্য ভালো দাম পাওয়া যায়। সুতরাং চাষি ভালো দাম পাওয়ার জন্য বর্ষার সময় ফুল ঝরিয়ে দেয়। বসন্তে গাছে পূর্ণ ধরার জন্য ম্যালিক হ্যাইড্রাজাইড বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক প্রয়োগ করতে হবে। পরিণত পেয়ারা গাছে (৫-৬ বছর) রাসায়নিক সারের পরিমাণ, নাইট্রোজেন : ফসফরাস : পটাশ @ ২৬০:৩২০:২৬০ গ্রাম/বছর/গাছ। গর্ত তৈরির সময় খামার সার ১০-১৫ কেজি + নাইট্রোজেন : ফসফরাস : পটাশ @ ৫০ : ৫০ : ৫০ গ্রাম। সার গাছের চারিদিকে প্রয়োগ করা হয়। সার প্রয়োগের পর জল সেচ জরুরি।

উদ্ভাবনী পদ্ধতির অনুশীলন
ডাল নোয়ান পদ্ধতি: এই বিশেষ পদ্ধতিতে গাছের শাখা প্রশাখাগুলিকে বাঁকিয়ে মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। তারপর ডালটিকে সুতলির সাহায্যে গাছের কাণ্ডের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। গাছের সবকটি ডালকে এইভাবে টেনে বেঁধে দেওয়ার পরে ঠিক ছাতার মতো দেখতে লাগে। গাছের বয়স ১.৫ থেকে ২ বছর হলেই এই পদ্ধতি শুরু করা যাবে এবং আরও ৫-৬ বছর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। সাধারণত বছরে দুইবার এই পদ্ধতিতে পেয়ারার ফুল ও ফল নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন মাস পর্যন্ত একমাস ডাল টানা বা বাঁকানো হয়। আবার হেমন্তকালে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে ডাল টানা হয়। ডাল টানা বা নোয়ানোর ১০-১৫ দিন সার ও জল দেওয়া দরকার। ডাল বাঁকানোর সময় শাখাটির অগ্রভাগ প্রায় ১ ফুট মত পাতা, ফুল, ফল রেখে বাকি পাতা, ফুল, ফল ও নতুন ডাল কেটে ফেলা হয়। এইভাবে সব শাখা প্রশাখাগুলিকে তৈরি করে নেওয়া হয়। গ্রীষ্মকালে ডাল বাঁকানোর ১০-১২ দিন পর নতুন ডাল বেরোতে শুরু করে। নতুন ডাল ১ সেমি মতো হলে বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। আবার, হেমন্তকালে ডাল বাঁকানো হলে ডাল টানার ২০-২৫ দিন পরে নতুন ডাল বেরোতে শুরু করে। সাধারণত ডাল টানার / নোয়ানোর ৪৫-৬০ দিন পরে ফল ধরতে শুরু করে। এটা লক্ষ্য করা গেছে যে ডাল বাঁকানো বা টানার পর যদি বৃষ্টি আসে বা আর্দ্র আবহাওয়ায় ৩-৪ দিন থাকে তাহলে নতুন ডালের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে যার ফলে ফুলহীন অঙ্গজ বৃদ্ধি ঘটে। আরও দেখা গেছে যে নতুন ডালে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ জোড়া পাতার কোলে ফুল আসে। নতুন ডালে ফুল আসার আগে চার জোড়া পাতার বেশি হলে আর ফুল আসে না অর্থাৎ, ডাল বাঁকানোর ৪-৬ সপ্তাহ অবধি বৃষ্টি বা অতি আর্দ্র আবহাওয়া ক্ষতিকারক। এইভাবে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ডাল বাঁকানো হলে ফল পাকতে শুরু করে অক্টোবর-জানুয়ারি মাসের মধ্যে। আবার হেমন্তকালে ডাল বাঁকালে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে ফল পাকে। এই সময়ের ফল মিষ্টি হয় এবং অন্যান্য গুণাগুণ সব বেশি থাকে৷ ফলের আকৃতি, রঙ সুন্দর হওয়ায় এই সময় পেয়ারার বাজারদর খুব ভাল থাকে। চার থেকে পাঁচ বছর এই পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। তারপর থেকে ফলন কমতে থাকে ও সহজে ডাল নোয়ানো যায় না। গাছ লাগানোর ৬-৭ বছর পরে দুই সারি গাছের মধ্যে নতুন গাছ লাগানো হয়। এর এক বছর পরে পুরনো গাছগুলিকে কেটে ফেলা হয়।

[আরও পড়ুন: বাংলার মুকুটে নতুন পালক! দেশের সেরা হাসপাতালের তালিকায় রাজ্যের তিন

ফসল তোলা

ফল পাকার লক্ষণ: পেয়ারা সারা বছর তোলা হয়। কিন্তু ফল তোলার সঠিক সময় হল বর্ষা (আগস্ট), শীত (নভেম্বর-ডিসেম্বর) এবং বসন্ত (এপ্রিল-মার্চ)‌। ফলের রঙ সবুজ থেকে হালকা হলুদ ফল তোলার উপযুক্ত সাধারণত ফুল আসার ৪-৫ মাস পর হয়। পেয়ারা সাধারণত হাত দিয়ে তোলা হয়।

ফল সংগ্রহ: বীজ থেকে তৈরি গাছে ফল আসতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ বছর। অন্যদিকে, কলম করা গাছে দু-তিন বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। ফল পাকার সময় ফলের রঙ সবুজ থেকে ধীরে ধীরে হলদেতে পরিণত হয়। পাকা ফল গাছে রাখা সম্ভব হয় না। তার কারণ বিভিন্ন প্রকারের পাখি ও বাদুড় অনেক ফল নষ্ট করে দেয়। তাই ফল পাকার ঠিকা দু একদিন আগেই ফল তোলা প্রয়োজন। দূরে চালান দেওয়ার জন্যও একটু কাঁচা অবস্থাতেই পেড়ে চালান দেওয়া ভাল। এ রাজ্যে একটি ৩-৪ বৎসরের পেয়ারা গাছে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিচর্যা করতে পারলে ৪০-৫০ কেজি ফলন পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য এই ফলন বিভিন্ন জাতের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে৷

ফসল কাটার পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
বাছাই করা: পেয়ারা মূলত আকার, ওজন ও রঙের উপর নির্ভর করে বাছাই করা হয়।

প্যাকেজিং
ফল সাধারণত সহজলভ্য স্থানীয় ঝুড়িতে করে প্যাকেজিং করা হয়। কিন্তু দূরবর্তী বাজারের জন্য, কাঠের বা ফাইবারের বাক্সে সঙ্গে ধানের খড়, শুকনো ঘাস বা কাগজ ব্যবহার করা হয়। প্যাকেজিং বাক্সে ভাল বায়ু চলাচল ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। পেয়ারা একটি সুস্বাদু ফল তাই ফল তোলা এবং পরিবহনের সময় সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

সংরক্ষণ
ফল তোলার পর বাজারজাত করা উচিত বা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কয়েকদিনের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। দূরবর্তী বাজারে পাঠানোর জন্য সঠিক ভাবে সংরক্ষণ প্রয়োজন। ফল ৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় ৭৫-৮৫% আপেক্ষিক আর্দ্রতা ২০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এছাড়াও ঘরের তাপমাত্রায় (১৮-২৩ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায়) ১০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

ফলন
৮-১০ টন/একর (৪০-৫০ কেজি /গাছ)। এলাহাবাদ সফেদার গড় ফলন বছরে ৩৫-৪০ কেজি, বেনারসী ২৫-৩০ কেজি, চিত্তিদার ৩০-৩৬ কেজি, এল-৪৯ জাতে ৪৫-৫২ কেজি, বারুইপুর ২৫-৩০ কেজি।

লাভ
একটি ৩-৪ বছর গাছের গড় ফলন ২৫-৩০ কেজি হবে। প্রতি কেজি পেয়ারা পাইকারি বাজারে ২০-২৫ টাকা দরে বিক্রি হলে গাছপিছু আয় হবে ৫০০-৬০০ টাকা। প্রতি বিঘাতে আয় হবে ২৫,০০০-৩০,০০০ টাকা।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement