shono
Advertisement

স্বল্প পোশাকের তরুণীদের খুন করে ‘বিকিনি কিলার’, এ কাহিনি হার মানায় সিনেমাকেও

বারবার জেল থেকে পালাতেও সিদ্ধহস্ত ছিল চার্লস শোভরাজ।
Posted: 05:33 PM Apr 01, 2022Updated: 05:33 PM Apr 01, 2022

বিশ্বদীপ দে: সিরিয়াল কিলার (Serial Killer)। ইদানীং সিনেমা থেকে ওয়েব সিরিজেও ছড়িয়ে পড়েছে খুনের নেশায় বুঁদ থাকা রুদ্ধশ্বাস সব অপরাধীদের সালতামামি। কতই না তাদের রকমফের। কিন্তু তাদের সকলকে এককথায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারত যে, গত শতাব্দীর সাতের দশক থেকেই তাকে ঘিরে ছড়িয়েছে নানা মিথ। এই মুহূর্তে নেপালের জেলে বন্দি আশি ছুঁই ছুঁই চার্লস শোভরাজ (Charles Sobhraj) এই সিরিয়াল কিলার ইউনিভার্সের এক চরম বিস্ময়! বহু ক্ষেত্রেই তার শিকার বিকিনি পরা মেয়েরা। যা তাকে এনে দিয়েছিল ‘বিকিনি কিলারে’র তকমা। এই লেখায় একবার ছুঁয়ে দেখা যাক সেই দুঁদে অপরাধীকে। কেন ঝকঝকে স্মার্ট চেহারার শান্ত মানুষটার চোখে আচমকাই ঝিকিয়ে উঠত হিংস্রতার সবুজ রং? কেন তার রক্তের ভিতরে দুর্নিবার অপরাধের গোপন ইচ্ছে?

Advertisement

আসলে বহু অপরাধীর মতোই চার্লস শোভরাজের মনের ভিতরে একরাশ অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছিল তার বিপন্ন শৈশব। ভিয়েতনামের সবথেকে বড় শহর সাইগন, যার বর্তমান নাম হো চি মিন সিটি, সেখানে জন্ম চার্লসের। তার বাবা ভারতীয়, মা ভিয়েতনামের নাগরিক। কিন্তু তাঁরা একসঙ্গে থাকলেও তাঁদের বিয়ে হয়নি। এবং ভদ্রলোক চার্লসকে নিজের ছেলে বলেও স্বীকৃতি দিতে চাননি। এর মধ্যেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দু’জনের। চার্লসের মা বিয়ে করেন ফ্রান্সের এক সেনানায়ককে। তিনি অবশ্য চার্লসকে দত্তক নিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে বিচ্ছিন্নতার বীজ সেঁধিয়ে গিয়েছে তার রক্তের মধ্যে।

ধীরে ধীরে নিজের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকে চার্লস। হয়তো ততদিনে তার মনের মধ্যে অপরাধমনস্কতার মাছি ভনভন করতে শুরু করে দিয়েছে। স্কুলের বোর্ডিং থেকেও দুবার পালিয়েছিল সে। ফ্রান্স থেকে সাইগনে ফিরে যাওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। তা হয়ে ওঠেনি। বরং ধীরে ধীরে ডাকাতি, ড্রাগ কিংবা হিরের চোরাচালানের এক কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিল সে।

[আরও পড়ুন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসলীলা চালাতে পারত ‘বাদুড় বোমা’! কেন সফল হয়নি এই গোপন মারণাস্ত্র?]

১৯ বছর বয়সে প্রথম জেল খেটেছিল চার্লস। কিন্তু প্যারিসের সেই জেলে ডাকাতির অভিযোগে বিদ্ধ তরুণের ব্যবহার মুগ্ধ করেছিল জেলকর্তাদের। আসলে এটাই ছিল চার্লসের কৌশল। ব্য়বহার তার এমন, যেন মধু ঢালা! ফলে উলটো দিকের লোকটা সহজেই তাকে বিশ্বাস করে ফেলত। পরবর্তী এই সুযোগেই সে চালিয়েছে অবাধ হত্যালীলা। একের পর এক জেল থেকে পালিয়েছে।

চার্লস শোভরাজকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ওয়েব সিরিজ

সারা জীবনে অসংখ্য খুন করেছে চার্লস। সাত থেকে আটের দশকে ১২ থেকে ২৪টি খুনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আগেই বলা হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার শিকার হিপি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তরুণ প্রজন্ম। গোয়েন্দাদের হিসেব বলছে, সিয়াটলের এক তরুণীই ছিল চার্লসের প্রথম শিকার। খুন করে যাকে থাইল্যান্ডের এক সমুদ্রখাঁড়িতে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে। এরপর ক্রমেই নেপাল, থাইল্যান্ড ও ভারতে একের পর এক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে থাকে চার্লস শোভরাজের নাম।

[আরও পড়ুন: ফের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিদেশ সফরে দিলীপ ঘোষ, গেলেন নেদারল্যান্ডস]

শোভরাজ কথা বলতে পারত নানা ভাষায়। তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল এক তীব্র চৌম্বক আকর্ষণ। বিশেষ করে মেয়েরা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ত তার ব্যবহারে। আসলে শিকার ধরার কৌশল ছিল তার রক্তের ভিতরে। প্রথমে সে তাদের সঙ্গে এমন ভাবে মিশে যেত, সন্দেহের কোনও চিহ্ন পর্যন্ত থাকত না। তারপর এক মোক্ষম মুহূর্তে আচমকাই… ওষুধে বেহুঁশ করার পর সর্বস্ব লুট করে, বহু ক্ষেত্রেই খুন করে মসৃণ ভাবে সেখান থেকে কেটে পড়ত চার্লস। এই মসৃণ ভঙ্গির জন্য়ই তার আরেক নাম ‘দ্য সারপেন্ট’। অর্থাৎ সাপ। গত বছর মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ওয়েব সিরিজে চার্লসের ভূমিকায় অভিনয় করা তাহার রহিম সে সম্পর্কে বলেছিলেন, ”সাপই তো। আপাত ভাবে মনে হবে নড়াচড়া করছে না। কিন্তু সে ভয়ংকর। যখন গোখরো ছোবল মারে তখন চকিতে মারে।” চার্লস কেবল অচেনা মানুষদেরই মারত না। তার যে ছোটখাটো দল, সেখান থেকে কেউ সরে যেতে চাইলেও তাদের মরতে হত।

গত শতাব্দীর আটের দশক। ১৯৮৬ সাল। ততদিনে তিনজনকে ওষুধ খাইয়ে খুনের চেষ্টার অপরাধে চার্লস বছর দশেক কাটিয়ে ফেলেছে বিহারের তিহাড় জেলে। এই সময় সে জেলের রক্ষীদের জন্য পার্টি দেয়! জেলে দশ বছর পূর্তির পার্টি। ততদিনে তার মিষ্টি মিষ্টি কথা বশ হয়ে গিয়েছে তারা। ব্যাস। খাবারে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেহুঁশ করে জেল থেকে পালাল সে। রীতিমতো হইহই পড়ে গেল চারদিকে। যেন সিনেমার কোনও ধুরন্ধর খলনায়ক লোকটা। কখন সে কোথায় কীভাবে জাল পাতবে বোঝা মুশকিল।

জেল থেকে বারবার পালাতে দেখা গিয়েছে ধুরন্ধর চার্লস শোভরাজকে। সারা জীবনে প্রায় ৩৫ বছর জেলেই কাটিয়েছে সে। তবু সুযোগ পেলেই পালিয়েছে মুহূর্তে। আফগানিস্তান, গ্রিস নানা দেশের জেল থেকেই মুহূর্তে ধাঁ হয়ে গিয়েছে চার্লস। একবার তো অ্যাপেনডিক্সের ব্যথার অজুহাতে হাসপাতালে ভরতি হয়ে তারপর সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে। ভাবলে সত্যিই মনে হয় যেন এককালের সেলিম-জাভেদের তৈরি সব ছবির মতো চিত্রনাট্য!

চার্লসের জীবন নতুন মোড় নেয় ১৯৯৭ সালে। কারাবাসের মেয়াদ শেষ করে ৫২ বছর বয়সি শোভরাজ ভারত থেকে ফিরে যায় ফ্রান্সে। সেই সময় রীতিমতো তারকা জীবন কাটাতেই দেখা গিয়েছিল তাকে। সাংবাদিকদের ভিড় লেগেই থাকত তার বাড়িতে। রীতিমতো গাঁটের কড়ি খরচ করে তবে মিলত সাক্ষাৎকার।

কিন্তু কয়েক বছর পরে আচমকাই ‘কাহানি মে টুইস্ট’। নেপালের কাঠমান্ডু থেকে ফের গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। নেপালে ১৯৭৫ সালে নেপালে দুই বিদেশি নাগরিককে খুনের অপরাধে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে তাকে বাগে পেয়ে চালান করে দেওয়া হয় গরাদের পিছনে। এখনও সেখানেই বন্দি ‘তারকা’ সিরিয়াল কিলার। ইতিমধ্যেই তার বাইপাস সার্জারি হয়েছে। অশক্ত শরীরে জেলকুঠুরির অন্ধকারেই কাটছে তার দিন।

কিন্তু কেন? ফ্রান্সের নিরাপদ জীবন ছেড়ে খামোখা নেপালে যেতে গেলেন কেন তিনি? শোভরাজ অবশ্য কারণ দেখিয়েছে। সে নাকি পরিশ্রুত জলের ব্যবসার কাজে সেখানে গিয়েছিল। কখনও বলেছে, নাকি কী একটা ডকুমেন্টারির কাজ ছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, আসলে আলোকবৃত্ত থেকে দূরে থাকতে ভাল লাগছিল না তার। সেই কোন অল্পবয়স থেকে তার নাম বারবার উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে। তাই আরও একবার সকলকে চমকে দিতেই নেপালে চলে এসেছিল চরম আত্মরতিতে ভুগতে থাকা চার্লস। হয়তো এখনও মনে মনে জেল থেকে পালানোর ছক কষে আরও একবার নিজের নামটা ভাসিয়ে তুলতে চায় সে। লোকটার নাম যখন চার্লস শোভরাজ, সেই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

নিহিতা বিশ্বাস

ও হ্য়াঁ, আরেকটা তথ্য। নেপালের জেলে থাকাকালীন নিজের আইনজীবীর মেয়ের সঙ্গেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে চার্লস। নিহিতা বিশ্বাস নামের সেই তরুণীকে নাকি চার্লস বিয়েও করেছে। যদিও জেল কর্তৃপক্ষ এটাকে গুজব বলেই উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিয়ে হোক আর না হোক, নিহিতা অকপটে জানিয়েছে, ”লোকটা আগে কী করেছে তা জানি না। কিন্তু লোকটা খুব ভাল। সে নিতান্তই নিরীহ।”

বোঝাই যাচ্ছে, বয়স যতই বাড়ুক, চার্লস কিন্তু তার চৌম্বক ক্ষমতায় এতটুকু মরচে পড়তে দেয়নি!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement