বিশ্বদীপ দে: ১৬ বছর। সময়ের হিসেবে খুব দীর্ঘ কিছু না হলেও এইটুকু সময়ের ব্যবধানেই অনেক কিছুই তো বদলে যায়। সে মানুষ হোক কিংবা দেশ। এই মুহূর্তে এক মারণ ভাইরাসের ভয়াল গ্রাসে গোটা বিশ্ব। করোনার (Coronavirus) দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় অসহায় পরিস্থিতির সামনে আমরা। এত দ্রুত হারে সংক্রমণ বেড়েছে যে, অক্সিজেন থেকে হাসপাতালের বেড, সবেতেই ঘাটতির হাহাকার। আর এই পরিস্থিতিতে ভারতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বহু দেশ। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানির মতো প্রথম বিশ্বের দেশ তো বটেই, সবাইকে অবাক করে চিন কিংবা পাকিস্তানও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই সেই সব প্রস্তাবে সাড়াও দিয়ে দিয়েছে মোদি সরকার (Modi Government)। যার ফলস্বরূপ দেশে পৌঁছতে শুরুও করে দিয়েছে নানা দেশের সাহায্য। আর তার ফলে এক ধাক্কায় ভেঙে গিয়েছে ১৬ বছর ধরে চলতে থাকা এক প্রতিজ্ঞা।
কী সেই প্রতিজ্ঞা? তা জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে। মনে পড়বে সেই সময় গোটা দেশ তথা বিশ্ব কেমন করে শিউরে উঠেছিল সুনামির (Tsunami) ভয়াবহতায়। এখনও পর্যন্ত একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সেই সুনামিতে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মায়ানমারের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভারতও। রাতারাতি চলে গিয়েছিল ১২ হাজারেরও বেশি প্রাণ। নিখোঁজের সংখ্যাগুলি জুড়লে তা ছাপিয়ে যায় ১৬ হাজারকেও। ঘরবাড়ি হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়েছিলেন সাড়ে ৬ লক্ষেরও বেশি মানুষ। এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বহু দেশই। ঠিক তার আগের কয়েক বছরেও এমনটাই দেখা গিয়েছিল। সে ১৯৯১ সালের উত্তরকাশীর ভূমিকম্প হোক কিংবা ১৯৯৩ সালের লাতুর বা ২০০১ সালের গুজরাট ভূমিকম্প অথবা ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গের ঘূর্ণিঝড়। এমনকী, ২০০৪ সালেই বিহার বন্যাতেও ত্রাণ এসেছিল অন্য দেশ থেকে।
[আরও পড়ুন: করোনা পরিস্থিতিতে স্থগিত হোক মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক, শিক্ষামন্ত্রীকে আবেদন পরীক্ষার্থীদের]
কিন্তু এবার ঘটে গেল ব্যতিক্রম। সবাইকে অবাক করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং (Manmohan Singh) বলে দিলেন, ‘‘আমাদের ধারণা, আমরা এই পরিস্থিতিকে নিজেরাই সামলে নিতে পারব। যদি প্রয়োজন পড়ে তখন নিশ্চয়ই সাহায্য নেওয়া হবে।’’ চিরকালই স্বল্পবাক হিসেবে পরিচিত মানুষটির মৃদু কণ্ঠস্বরের সেই ঘোষণা কিন্তু ‘ঐতিহাসিক’ হয়ে উঠেছিল মুহূর্তে। স্বাধীনতার পর থেকেই দরিদ্র দেশের তকমা মুছতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভারত যেন সেই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আর সাহায্যের দরকার নেই আমাদের।
কিন্তু দেড় দশক যেতে না যেতেই ভেঙে গেল সেই প্রতিজ্ঞা। অথচ ২০০৫ সালে কাশ্মীর ভূমিকম্প, ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের বন্যা কিংবা ২০১৪ সালে কাশ্মীরের বন্যায় বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ নিতে অস্বীকার করেছে ভারত। নিজেরাই সামলে নিয়েছে বিপর্যয়ের ধাক্কা। অনেকেরই মনে আছে মাত্র বছর আড়াই আগের কথা। ২০১৮ সালে বন্যায় বিধ্বস্ত কেরলের জন্য ৭০০ কোটি টাকার ত্রাণ দিতে ইচ্ছুক ছিল সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। কিন্তু বাধ সাধে কেন্দ্রের মোদি সরকার। জানিয়ে দেয়, কোনও ত্রাণের প্রয়োজন হবে না। নিজেদের শক্তিতেই সামলে নেওয়া যাবে সমস্ত বিপদকে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই সময় কেরল সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের সংঘাতের আবহ তৈরি হলেও সিদ্ধান্তে কোনও বদল ঘটেনি। যা বদলে গেল এবার। ২০২১ সালের এপ্রিলে এসে।
[আরও পড়ুন: কেন্দ্র ও রাজ্যে ভ্যাকসিনের পৃথক দাম কেন? মোদি সরকারকে বিঁধল সুপ্রিম কোর্ট]
যদিও ইঙ্গিত ছিল। করোনার ধাক্কা সামলাতে পিএম-কেয়ার্স তহবিল গড়ে তোলার সময়ই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে কোনও দেশের সংস্থা কিংবা নাগরিকরাও অনুদান দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে। কিন্তু তারপর ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার পথে এগনো ভারত বরং টিকার ডোজ পাঠাতে শুরু করেছিল বিভিন্ন দেশে। ভাবা যায়নি এভাবে ছবিটা পালটে যাবে। হু হু করে বাড়তে থাকা সংক্রমণের ভ্রুকূটির সামনে দাঁড়িয়ে তাই নীতি বদলে ফেলা ছাড়া বোধহয় উপায়ও ছিল না।
নয়াদিল্লি অবশ্য একে ‘নীতির বদল’ তকমা দিতে রাজি নয়। কেন্দ্রের সাফ কথা, ভারত কারও কাছে সাহায্য চায়নি। এগুলি কিনে নেওয়ারই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এক সূত্রের বক্তব্য, যদি কোনও অন্য দেশের সরকার কিংবা কোনও বেসরকারি সংস্থা যদি উপহার হিসেবে অনুদান দিতে চায় তবে ভারত তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই গ্রহণ করা হবে। প্রসঙ্গত, ভারত এই সাহায্যগুলি সরাসরি নেবে না। এমনকী পিএম-কেয়ার্স তহবিলেও নয়। বরং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটি’-র মাধ্যমে তা গ্রহণ করা হবে।
পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া দুই ‘বন্ধু’কে নিয়ে। চিন ও পাকিস্তান। ইমরানের দেশ নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। তবে বেজিংয়ের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে ভারত। শিগগিরি সেখান থেকে এসে পৌঁছবে ২৫ হাজার অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। অবশ্য ভারত জানিয়ে দিয়েছে, এটা ঠিক ‘সাহায্য’ নয়। চিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দিতে চাইছে বলেই তা নেওয়া হচ্ছে, এমনটাই মত নয়াদিল্লির।
তবে গত ১৬ বছরে ভারত এই যে প্রথম নিজেদের নীতি পরিবর্তন করল তা নয়। এর আগে ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের বন্যা ও ২০১৪ সালে ওড়িশায় ঘূর্ণিঝড় হুদহুদের প্রকোপে সৃষ্টি হওয়া দুর্যোগের সময়ে বিদেশি ত্রাণে ‘না’ বলেনি ভারত। কিন্তু সেই সব সাহায্য আসলে এতই ছোট স্কেলে যে সেগুলিকে ব্যতিক্রম ধরেই নেওয়া যায়। এবারের বিপদ যে অনেক বড়। মাথার উপরে ক্রমেই ঘন হচ্ছে মৃত্যুমেঘ। গত মার্চের শেষ থেকেই নজরে পড়েছিল করোনা গ্রাফ একটু একটু ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে রাতারাতি পুরো ছবিটাই হয়ে উঠেছে রীতিমতো আতঙ্কের। অক্সিজেনের অভাবে চোখের নিমেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে মানুষ। হাসপাতালে বেড না পেয়ে অ্যাম্বুল্যান্সেই ঠায় বসে অসহায় রোগী। মারা গিয়েও বুঝি শান্তি নেই। শ্মশান হোক বা গোরস্থান, কোথাও যেন ঠাঁই নেই। তৈরি করতে হচ্ছে অস্থায়ী শ্মশান কিংবা কবরখানা। জ্বলে উঠছে সারি সারি চিতা। অক্সিজেনের ঘাটতি থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধের আকাল এমনকী টিকার জন্য প্রয়োজনী কাঁচামালও ‘বাড়ন্ত’।
এই কালান্তক বিপদের সময়ে তাই পুরনো নীতি ধরে বসে থাকা কার্যতই অর্থহীন। ভুললে চলবে না আমেরিকার মতো দেশকেও অতিমারীর শুরুর দিনে ভারতের থেকে কোটি কোটি হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ট্যাবলেট রপ্তানি করতে হয়েছিল। এমন ‘অতিকায়’ বিপদের সম্মুখীন হয়ে যে ভারতের পক্ষেও বিদেশি ত্রাণ উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না তা বোধহয় অনিবার্যই হয়ে উঠেছিল।