সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: কথায় বলে, মাথার উপর বসে বিধাতাপুরুষ সব সময়েই বলে চলেছেন, ”তথাস্তু, তথাস্তু, তথাস্তু”! তাই খুব সাবধানে ভেবে-চিন্তে কথা বলতে হয়! কে জানে, অসাবধানে বেরনো কোন কথাটার পিঠে বসে যাবে বিধাতাপুরুষের মুখনিসৃত তথাস্তু!
অনেকে এও বলেন, মনোকষ্টের একটা নিজস্ব জোর থাকে। তাই, মনের দুঃখে উচ্চারিত অভিশাপ না ফলে যায় না!
মাইসুরু রাজবংশের ক্ষেত্রে এই দুটো ব্যাপারই খুব সম্ভবত মিলে-মিশে কাজ করেছে। কাজ করেছে বিধাতাপুরুষের লীলা, নারীর চোখের জল আর প্রতিহিংসা এবং রাজনীতির জটিল আবর্ত। যার ফেরে বিগত ৪০০ বছর ধরে যেমন অসহায় হয়ে রয়েছে মাইসুরুর ওয়াদিয়ার রাজবংশ, তেমনই পরিবর্তন ঘটেছে প্রকৃতির জগতেও।
অভিশাপের এত ক্ষমতা?
কার্যত তাই! কেন, জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৬১২ সালে।
মাইসুরু রাজপ্রাসাদ
দাক্ষিণাত্যের ইতিহাস বলে, সেই সময়ে এক রাজনৈতিক পালাবদলের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল বিজয়নগর। তৎকালীন শাসক তিরুমলরাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে বিজয়নগরের শাসনের অধিকার দখল করেন রাজা ওয়াদিয়ার।
প্রজারা বরাবরই কাঠের পুতুল মাত্র। এক রাজা আসে, এক রাজা যায়- তাদের এ সব ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলার বা করার থাকে না। ফলে, তিরুমলরাজার পরিবর্তে যখন সিংহাসনে আসীন হলেন রাজা ওয়াদিয়ার, তাদের তরফে তেমন আপত্তি বা বিদ্রোহ- কিছুই দেখা গেল না।
ব্যাপারটা কেবল মেনে নিতে পারলেন না তিরুমলরাজার বিধবা পত্নী আলামেলাম্মা। মেনে নিতে পারলেন না সাধের রাজধানীতে ওয়াদিয়ারের শাসনের অধিকার। মেনে নিতে পারলেন না যে সিংহাসনে একদা আসীন হতেন তাঁর স্বামী, সেখানে এখন বসবেন ওয়াদিয়ার! মেনে নিতে পারলেন না, রাজকোষাগারের মূল্যবান রত্নালঙ্কারের উপর বর্তানো ওয়াদিয়ারের দখলদারি!
বালির গ্রাসে বর্তমানে তালাকাডু; এখানেই ধরা পড়েছিলেন আলামেলাম্মা
এখন প্রথম দুই ক্ষেত্রে আলামেলাম্মার করার কিছু ছিল না। কিন্তু, শেষ ক্ষেত্রে আলামেলাম্মা সার্থক হন। কাহিনি বলে, সমস্ত রত্নালঙ্কার পরে তিনি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যান।
কিন্তু, তাঁর পিছনে ধাওয়া করে আসে ওয়াদিয়ারের সৈন্যরা। মূল্যবান ওই রত্নালঙ্কারের অধিকার ছাড়তে ওয়াদিয়ার কিছুতেই রাজি ছিলেন না।
ও দিকে, আলামেলাম্মাও হাল ছাড়ার পাত্রী নন! যদিও খুব বেশিক্ষণ তিনি পালাতে পারেননি। কাবেরী নদীর ধারে, তালাকাডু গ্রামের মলঙ্গির কাছে এসে তিনি ধরা পড়ে যান।
সৈন্যরা কিন্তু আলামেলাম্মার কাছ থেকে সেই সব রত্নালঙ্কার উদ্ধার করতে পারেনি। কাবেরীর জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন আলামেলাম্মা। সৈন্যরা যখন তাঁকে জলে ঝাঁপ দিয়ে তুলতে আসে, তখন দেখা যায় এক অলৌকিক ঘটনা।
নদীর জলে ভাসতে ভাসতে অভিশাপ দেন আলামেলাম্মা! তিনটি অভিশাপ! প্রথমত, যে জায়গায় তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন, সেই তালাকাডু গ্রাম ঢেকে যাবে বালিতে। সে আর বাসযোগ্য থাকবে না।
মলঙ্গির এখানেই তৈরি হয় ঘূর্ণাবর্ত যা আজও রয়েছে
দ্বিতীয়ত, আলামেলাম্মার উচ্চারণ মাত্রই মলঙ্গির জলে প্রবল ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়। যার জেরে ওয়াদিয়ারের সৈন্যরা সাঁতার দিয়েও তাঁর কাছে পৌঁছতে পারেননি।
সেই ঘূর্ণাবর্তে প্রায় নিমজ্জিত দশায় শেষ অভিশাপটি উচ্চারণ করেন আলামেলাম্মা- ওয়াদিয়ার রাজবংশ নির্বংশ হবে! ওই বংশের রাজার কোনও পুত্রসন্তান জন্মাবে না!
এর পর নদীর জলে সব রত্নালঙ্কার-সহ তলিয়ে যান আলামেলাম্মা। সৈন্যদের মুখে ঘটনাটা শোনার পরে স্বাভাবিক ভাবেই শিহরিত হন রাজা ওয়াদিয়ার। আলামেলাম্মার কথামতো মলঙ্গির জলে ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি সবার চোখের সামনেই ঘটেছে! অতএব, ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য তিনি আলামেলাম্মার এক মন্দির নির্মাণ করেন। ব্যবস্থা করেন নিত্য পূজার!
আলামেলাম্মার কথাই কিন্তু সত্যি হয়। ওই ঘূর্ণাবর্ত আজও অবস্থান করছে মলঙ্গির জলে। পাশাপাশি, বালিতে ঢেকে গিয়েছে তালাকাডু। আজও, বালি সরিয়ে যখন খননকার্য চলে, উদ্ধার হয় নানা ঐতিহাসিক বস্তু বা স্থাপত্য।
ওয়াদিয়ার বংশের রাজসিংহাসন
এবং, সত্যি হয়েছে আলামেলাম্মার শেষ অভিশাপও! দেখা গিয়েছে, ওয়াদিয়ার রাজবংশের সব রাজাই নিঃসন্তান। কেউই উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারেননি। ছয় পুরুষ ধরে এই ঘটনা ঘটেই চলেছে, তার অন্যথা হয়নি। রাজবংশ রক্ষা করতে হয়েছে সন্তান দত্তক নিয়ে!
বিশ্বাস না হলে প্রত্যক্ষ করতে পারেন তালাকাডু বা মলঙ্গি গিয়ে। রাজবংশের ইতিহাসও ঘেঁটে দেখতে পারেন।
দেখবেন, ৪০০ বছর ধরে আলামেলাম্মার তিনটি অভিশাপ কেমন বিপর্যয় ডেকে এনেছে দাক্ষিণাত্যের বুকে!
The post ৪০০ বছরেও শাপমোচন হল না মাইসুরুর রাজবংশের! appeared first on Sangbad Pratidin.