সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: সত্যি বলতে কী, এই বাজেটে আমার প্রধান আগ্রহ ছিল সোনা, জমিজমা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি ও জুয়ার প্রতি। আগ্রহটা জাগিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ‘ইকোনমিক অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল’-এর সদস্য নীলেশ শাহ। সে-কথায় পরে আসছি।
[আরও পড়ুন: করোনা আবহে কি ভোটমুখী বাজেট পেশ নির্মলার?]
বাজেটের দিকে লক্ষ্য ছিল অন্য কয়েকটা কারণেও। কোভিডের ছোবলে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সোজা করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কী দাওয়াই বাতলান- সেটা ছিল একটা আগ্রহ। দ্বিতীয় আগ্রহের কেন্দ্রে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা কৃষক বিদ্রোহ। কৃষক-ক্ষতে প্রলেপ লাগানোর মলমের খোঁজ মেলে কি না, তা দেখার ছিল। তৃতীয় আগ্রহটা রাজনৈতিক। অসম, পশ্চিমবঙ্গ, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু ও কেরল বিধানসভার ভোটের খাতিরে কোনও বিশেষ ঘোষণা আসে কি না।
আগ্রহের নিরসন কতটা হল, এখন আর তা বিস্তারে বলার দরকার নেই। সবারই জানা। কোভিড-নিয়ন্ত্রণে ৩৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছাড়াও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন প্রয়োজনে আরও খরচের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। স্বাস্থ্যখাতে ১৩৭ শতাংশ বাড়তি বরাদ্দ ‘সিন্ধুতে বিন্দুসম’ কি না, তা বিতর্কিত হলেও স্পষ্ট- সবাইকে বিনামূল্যে কোভিড-টিকার প্রতিশ্রুতির রাস্তায় সরকার হাঁটেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাজেট তৈরির সময় সরকারের মনপ্রাণজুড়ে ছিল দেশের কৃষিসমাজ। কৃষক-কল্যাণ ও কৃষি আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে সরকার অবিচল। এই মন্তব্য যে মলমের কাজ করেনি, কৃষকদের মনোভাবেই তা স্পষ্ট। বরং ক্ষোভ বাড়িয়েছে তাঁদের ঠেকাতে ও দমাতে নানাবিধ প্রশাসনিক বন্দোবস্ত। কৃষি পরিকাঠামোর উন্নয়নে পেট্রোল ও ডিজেলের উপর নতুন ‘সেস’ তাঁদের আরও বিষণ্ণ করেছে। সোমবার থেকেই প্রচার হচ্ছে, এই সেস কৃষি-খরচ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার ছক।
বাজেট পেশের দিনকয়েক আগে অর্থনীতি-চর্চায় বড় রসদের জোগান দিয়েছিল আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘অক্সফ্যাম’-এর রিপোর্ট ‘দ্য ইনইকুয়্যালিটি ভাইরাস’। রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেসের এক মন্তব্য ওই রিপোর্টের নির্যাস তুলে ধরেছে। করোনা-কালের সংকট সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমরা সবাই একই সমুদ্রে ভেসে চলেছি। কিন্তু কেউ ভাসছেন বিলাসবহুল প্রমোদতরণীতে, কেউ খড়কুটো আঁকড়ে।’ রিপোর্টে বৈষম্যের ছবিটা এইরকম, লকডাউনে ভারতীয় কোটিপতিদের সম্পদ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ, অথচ কাজ খুইয়েছেন ১২ কোটি ২০ লাখ। রোজগার কমেছে ৮৪ শতাংশ মানুষের! এই ক’মাসে দেশি ধনকুবেরদের আয় যত বেড়েছে, বাজেট-প্রস্তাবে দেখছি, তা আগামী অর্থবর্ষের মোট রাজকোষ ঘাটতির চেয়ে সামান্য কম। সর্বোচ্চ একশো ধনীর মুনাফা বেড়েছে ১৩ লাখ কোটি টাকা, ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি হবে ১৫ লাখ কোটি!
মানুষের হাতে কাজ দিতে নির্মলা জোর দিয়েছেন পরিকাঠামোয়। চার বড় রাজ্যের বিধানসভার ভোট তাতে থাবা মেরেছে। ভোট বড় বালাই! সড়ক-উন্নয়নে তামিলনাড়ুর দঁাও ১ লাখ ৩,০০০ কোটি, কেরলের ৬৫,০০০, পশ্চিমবঙ্গের ২৫,০০০। তিন বছরের জন্য অসমের প্রাপ্য ৩৪,০০০ কোটি টাকা। ভাল! নির্মাণযজ্ঞে অগুনতি পেট চলে।
তবু এই দিনে ২০,০০০ কোটির ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ প্রকল্প কেন যেন খচখচ করছে! অভাবের সংসারে এখনই এই বিলাসিতার আদৌ কি প্রয়োজন ছিল? কোভিড সামলে অর্থনীতির চিকচিক করে ওঠা ইদানীং ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের সঙ্গে তুলনীয় হচ্ছে! এই তুলনা ঝুপ করে আমাকে কৈশোরে নিয়ে গেল! বাঙালির আদি ক্রিকেট-গুরু কার্তিক বসুকে দেখতাম, তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে তৈরি ‘ভি’ উইকেটের সমান্তরাল রেখে শিক্ষার্থীদের বলতেন “অন ও অফ ড্রাইভ মারবে এই ‘ভি’-এর মধ্যে। বল ‘ভি’-এর বাইরে যাবে না। উড়বেও না। মাটি কামড়ে বাউন্ডারির দিকে ছুটবে।” প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের মত, খারাপ সময় কাটিয়ে অর্থনীতি এখন ‘ভি’ আকারে চওড়া হচ্ছে। এই ব্যাখ্যা অংশত সত্য। কিছু ক্ষেত্রে অর্থনীতি চিকচিক করছে ঠিকই, কিন্তু কিছু ক্ষেত্র এখনও অন্ধকারে।
নীলেশ শাহ-র প্রস্তাব এই পরিস্থিতিতেই আমার মনে ধরেছিল। চলতি অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি আকাশ ফুঁড়ে যাবে– সবার তা জানা। নির্মলা দেখালেন, ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকায়, যা জাতীয় আয়ের সাড়ে ৯ শতাংশ! ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে তা কিছুটা কমলেও ৬.৮ শতাংশের নিচে নামবে না। পরিমাণ হবে, ১৫ লাখ কোটির সামান্য বেশি। আয়-ব্যয়ের ফারাক কমাতে সরকারকে হয় কর বসাতে হয়, নয়তো ধার। সেই ধার শোধের উপায়ও দুটো। আরও কর, অথবা আরও ধার! এই চক্র থেকে বের হতে নীলেশ শাহর প্রস্তাবে সোনা, সরকারের উদ্বৃত্ত জমি, ‘এনিমি প্রপার্টি’ ও জুয়া বা ‘বেটিং’ প্রসঙ্গ চলে এসেছে। ভনিতাহীন ‘আউট অফ দ্য বক্স’ প্রস্তাব!
যেমন, ‘অঘোষিত মজুত সোনা ঘোষণা রদ’ প্রকল্প। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের হিসাবে ভারতে মজুত অঘোষিত সোনার ‘অ্যামনেস্টি স্কিম’ অর্ধেকও সফল হলে কয়েকশো বিলিয়ন (১ বিলিয়ন=১০০ কোটি) ডলার সরকারের ঘরে আসতে পারে। দেশের অগুনতি মন্দিরে জমা টন টন সোনার মালিক মন্দিরের ট্রাস্টিরা। কোনও উপকারে আসে না তা। সেই সোনা দেশের কাজে লাগানো গেলে সাধারণের ঘাড়ে করের বোঝা চাপাতে হয় না। কিন্তু সোনা বড়ই স্পর্শকাতর। সরকারও সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলতে অনাগ্রহী।
দ্বিতীয় প্রস্তাবটিও বিতর্কিত। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নীকরণ। চলতি বাজেটের লক্ষ্য ছিল দু’লাখ ১০,০০০ কোটি টাকা। ১০ মাসে এসেছে ২০,০০০ কোটিরও কম। এবার লক্ষ্য পৌনে দু’লাখ কোটি। তৃতীয় প্রস্তাব, সরকারের বাড়তি জমি বিক্রির। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার স্বার্থে নির্মলা প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছেন। একটা সংস্থা গড়ার প্রস্তাব রেখেছেন। অনেক দিন আগে, বাড়তি জমির দাম ধরা হয়েছিল, কম করেও ৭-৮ লাখ কোটি টাকার!
বাকি দু’টি প্রস্তাব অভিনব। ‘এনিমি প্রপার্টি’ বিক্রি ও জুয়া। বা ‘বেটিং’-এর স্বীকৃতি। পাকিস্তান ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর ভারতীয়দের সব এনিমি প্রপার্টি বেচে দিয়েছে। ভারত এখনও বেচেনি। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ আহির লোকসভায় জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানে চলে যাওয়া মানুষজন ৯,২৮০টি সম্পত্তি ফেলে গিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর ১২৬ জন চিনা সম্পত্তি রেখে ভারত ছেড়েছিলেন। এসব নিলাম হলে দাম উঠবে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি! সরকারকে অযথা পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়াতে হয় না!
শেষ প্রস্তাব জুয়া বা বেটিংয়ের স্বীকৃতি। দাবিটা অনেক দিনের। কিন্তু কে জানে কী কারণে সরকার এখনও দ্বিধান্বিত? এক বছর আগের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, দেশের ৪০ শতাংশ ইন্টারনেট-ব্যবহারকারী জুয়ায় আগ্রহী। ভারতে অবৈধ জুয়ার বাজার ১০০ বিলিয়ন ডলারের! প্রতি বছর তা সাত শতাংশ হারে বাড়ছে! পৃথিবীজোড়া ক্রিকেট বেটিংয়ের ৮০ শতাংশই ভারতে। এই বাজার ‘বৈধ’ হলে সরকারকে রাজস্ব বাড়াতে ধার করতে হবে না। অযথা কর বসানোরও দরকার নেই! প্রথাভাঙা প্রধানমন্ত্রীর দল নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে মাংস রফতানির বাজারে ক্রমশ পিছনপানে হটছে! সোনা, জমি, ‘এনিমি প্রপার্টি’ বা ‘বেটিং’-এর দোদুল্যমানতা কাটালে রাজকোষ ঘাটতি এক তুড়িতে ভ্যানিশ হয়! বাজেটে সেই সাহস দেখলাম কই?