সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: “কেসটা ফুল ব্যুমেরাং হয়ে যাচ্ছে।”
গৌতম গম্ভীরের ছেড়ে আসা পূর্ব দিল্লি লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি (BJP) প্রার্থী হর্ষ মালহোত্রার এক নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে কথা হচ্ছিল স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে। সেই সময়ই কানে এল এই স্বগতোক্তি। না, শুধু এই একটি জায়গায় নয়। দিল্লি জুড়ে বিজেপির যে কোনও পার্টি অফিস, নির্বাচনী কার্যালয়ে গেলেই শুনতে পাওয়া যাবে এই ধরনের কথাবার্তা। হয়তো প্রকাশ্যে নয়। আড়ালে-আবডালে।
আসলে, বিজেপি ভেবেছিল লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে দিল্লি মুখ্যমন্ত্রীকে (Delhi CM) গ্রেপ্তার করিয়ে কোমর ভেঙে দেওয়া যাবে আম আদমি পার্টির (AAP)। প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী-সহ দলের একাধিক সিনিয়র হেভিওয়েট নেতাদের গ্রেপ্তারি এক, আর খোদ দলের প্রধানকে গারদের পিছনে পাঠিয়ে দেওয়া আরেক। এই চালেই কেল্লাফতে করার পরিকল্পনা ছিল পদ্ম শিবিরে। কিন্তু ফুটবলে যেমন অফসাইড ট্র্যাপ করতে গিয়ে অনেক সময় ভুল করে ফেলেন বিশ্বের তাবড় ডিফেন্ডাররা, ভুল চালে গোল করে চলে যান প্রতিপক্ষের কোনও ধুর্ত স্ট্রাইকার, অনেকটা তেমনই হয়ে গিয়েছে কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রে। কেজরির গ্রেপ্তারির চালে ভুল হয়ে যাওয়ায় একসঙ্গে অনেকগুলো ক্ষতি হয়ে গিয়েছে বিজেপির।
[আরও পড়ুন: দলীয় পতাকার লাঠি, চেয়ার ছুড়ে মারামারি! ইন্ডিয়া জোটের সভায় চরম বিশৃঙ্খলা, ভিডিও ভাইরাল]
প্রথমত, আম আদমি পার্টির দ্বিতীয় সারির নেতারা ভয় পেয়ে কাবু হয়ে যাওয়ার বদলে আরও বেশি করে ইনকিলাবি হয়ে উঠেছেন। আইপিএল আবহে অতীশি, সৌরভ ভরদ্বাজরা প্রায় রোজই ব্যাট করতে নামছেন টি-২০ মেজাজে। হাঁটু কাঁপা তো দূর, উল্টে এখনও পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচে থাকা বাকি নেতাদের একজোট করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালানোর পাশাপাশি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে আক্রমণ করে যাচ্ছেন বিজেপি ও তাদের নীতিকে। উপরি পাওনা হিসাবে তাঁরা পেয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের সমর্থন। নির্বাচনের বাজারে যার থেকে বড় তোফা আর কিছুই হতে পারে না।
[আরও পড়ুন: পরীক্ষায় ফেল করায় মনখারাপ, CA হওয়ার স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই আত্মঘাতী কসবার ছাত্রী]
দ্বিতীয়ত, আম আদমি পার্টি-সহ দেশের অন্যান্য বিরোধী দল সাধারণ মানুষকে যেটা বোঝাতে চেয়েছিল, তা প্রায় পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিয়েছেন দিল্লির এক বড় অংশের মানুষ। তাঁরা মনে করছেন, সত্যি সত্যিই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বেছে বেছে বিরোধী দলের নেতাদের বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে ভয় দেখাচ্ছে বিজেপি। তাতে লাভ না হলে চালান করে দেওয়া হচ্ছে হাজতে। অন্যান্য দলগুলির তুলনায় আম আদমি পার্টিকে যে বিষয়টি বেশি সাহায্য করছে, তা হল, এখনও পর্যন্ত আবগারি দুর্নীতির তদন্তে আর্থিক তছরূপের সামান্যতম হদিশ না মেলা সত্ত্বেও কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়াদের গ্রেপ্তারি। ফ্লোটিং ভোটার হিসাবে যাঁরা পরিচিত, ঘরোয়া আলোচনায় তাঁদের অনেকেই আপ নেতাদের সুরে প্রশ্ন করছেন, কোটি কোটি টাকার যে কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর কানাকড়িও উদ্ধার হল না কেন? যদি নাই হল, তাহলে কোন যুক্তিতে হাজতবাস করতে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রীদের?
কেন এই প্রশ্ন করছেন দিল্লিবাসীরা? এর ছানবিন করলেই মিলবে বিজেপির বিরুদ্ধে চলা চোরাস্রোতের তৃতীয় কারণ। স্বাধীন ভারতে কেজরিওয়ালই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যাঁকে হাজতবাস করতে হয়েছে। এর আগে জেলে যাওয়া বাকিদের মতো, তিনি ইস্তফা দেননি। সংবিধানে তেমন কোনওরকমের বাধ্যবাধকতা না থাকায়, গারদের ওপার থেকেই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন প্রশাসনিক কাজ। যার জেরে দিল্লি সরকারের দৈনন্দিন কাজে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটছে। সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এই কারণেই ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মনে। আম আদমি পার্টির এক মুখপাত্রের ‘বেসরকারী’ বক্তব্য অনুযায়ী তাঁরা এখন অপেক্ষা করছেন বিজেপির পরবর্তী চালের জন্য। আপাতত যা খবর, তাতে হাজার চাপ এলেও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে কেজরির পদত্যাগের সম্ভাবনা বেশ কম। এই পরিস্থিতিতে যদি দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে দেয় কেন্দ্র, তাহলে পোয়াবারো হবে আম আদমি পার্টির। সেই নেতার বক্তব্য অনুযায়ী, সেক্ষেত্রে তাঁরা দিল্লিবাসীদের দরবারে এই বার্তা নিয়ে যাবেন যে, কীভাবে ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজধানীতে গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করছে কেন্দ্রের শাসক। উল্টোদিকে বিজেপিও মোটামুটি আপ-এর এই চালের গন্ধ পেয়ে গিয়েছে। তাই পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত, তাই নিয়েই চলছে পদ্মকাননের চায়ে পে চর্চা।
কেজরিওয়ালের গ্রেফতারিতে চতুর্থ যে ধাক্কাটি খেয়েছে বিজেপি, তা হল ‘ইন্ডিয়া’-র আরও কাছাকাছি চলে আসা। বিভিন্ন কারণে, সমীকরণে মাঝের সময়ে বিজেপি বিরোধী দলগুলির বাঁধন একটু আলগা হয়েছিল। যা আরও কষে বসেছে দিল্লি মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেপ্তারির পর। গতমাসের শেষদিনে দিল্লির রামলীলা ময়দানে হয়েছে মেগা র্যালি। যেখানে উপস্থিত ছিলেন ‘ইন্ডিয়া’-র বিভিন্ন শীর্ষ নেতা। যে দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে ক’দিন আগেও আদায়-কাঁচকলায় ছিল আম আদমি পার্টির সম্পর্ক, সেই অজয় মাকেনদের গলাতেও এখন সহানুভূতির সুর।
সব মিলিয়ে বলা যেতেই পারে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারিতে লোকসভা নির্বাচনের আগে যথেষ্ট চাপে বিজেপি। গতবারের যা ফল, তার থেকে ভাল করার আর কোনও রাস্তা নেই বিজেপির। পাঁচ বছর আগে সাতের সাতটি কেন্দ্রেই ফুটেছিল পদ্ম। পাটিগণিতের নিয়মেই তাই এর থেকে উন্নততর ফলাফল করা বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয়। উল্টে যদি এক-আধটি আসনও হাতছাড়া হয়, সেক্ষেত্রে নৈতিক জয় হবে দিল্লির আপ-কংগ্রেস জোটের। ধাক্কা খাবে বিজেপি। আপাতত যা পরিস্থিত, তাতে ৪ জুন হয়তো এই ছবিই দেখতে হতে পারে রাজধানী শহরকে। এমনটাই বিশ্বাস রাজধানীর রাজনৈতিক কারবারীদের। সেক্ষেত্রে কেজরির গ্রেপ্তারির পর হয়তো দিল্লি বিজেপির নেতাদের কানে ভাসছে সাড়ে ছয় দশক আগে কিশোর কুমার-মধুবালার চলতি কা নাম গাড়ি ছবির সুপারহিট গানের এক লাইন। 'যাতে থে জাপান, পহোচ গয়ে চিন সমঝ গয়ে না...।'