সুলয়া সিংহ: সালটা ২০১৮। টেস্টে আফগানিস্তানের হাতেখড়ি হয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধে।
এক ইনিংস এবং ২৬২ রানে সেই টেস্ট ম্যাচ জেতে টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু খেলার ফলাফলকে ছাপিয়ে গিয়েছিল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। ভারত অধিনায়ক অজিঙ্কে রাহানে ট্রফি নেওয়ার সময় ডেকে নিয়েছিলেন আফগান অধিনায়ক আসগর আফগান-সহ গোটা দলকে। একসঙ্গে দুই অধিনায়ক ট্রফি হাতে ছবি তুলে বিশ্বকে স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের বার্তা দিয়েছিলেন। ভারত ও আফগানিস্তান ক্রিকেট মাঠে অন্য এক ছবির জন্ম দিয়েছিলেন। আবেগে চোখের কোণ ভিজেছিল অগণিত ক্রিকেট ভক্তের। এই জন্যই হয়তো জেন্টলম্যান’স গেমের তকমা পেয়েছে ক্রিকেট।
কাট টু ২০২৩।
ভারতের আরেক অধিনায়কের কীর্তিকলাপে মাথা হেঁট হওয়ার জোগাড় দেশবাসীর। তিনি ভারতের মহিলা দলের অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌর।
হরমন, ঢাকায় আপনার কীর্তিতে ব্যথিত হয়েছি। বিস্মিতও হয়েছি। মনে প্রশ্ন উঠেছে, কেন? কেন? কেন? কেন এরকম করলেন আপনি? আপনার গুণমুগ্ধ হিসেবে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।
হরমনপ্রীত আপনি একসময়ে মিতালি রাজের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতের মহিলা ক্রিকেটকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়–দেশের ছোটছোট মেয়েদের চোখে স্বপ্নের বীজ বুনে দিয়েছিলেন।
সেই আপনিই কি না এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন!
আম্পায়ারিং নিয়ে অতীতে নানা প্রশ্ন তুলেছেন ক্রিকেটাররা। মাঠে মেজাজও হারিয়েছেন। কিন্তু আপনি সেই ঘটনা টেনে আনলেন পুরস্কারের অনুষ্ঠান মঞ্চ পর্যন্ত। আম্পায়ার ঘরের দল বাংলাদেশের পাশে না থাকলে ৩ ম্যাচের সিরিজ কোনওভাবেই ১-১ ড্র দিয়ে শেষ হত না। তাই এই ট্রফি শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয়, আম্পায়ারেরও প্রাপ্য। এই দাবি তুলেই হাজার ক্যামেরার ফ্ল্যাশের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ডেকে নেন আম্পায়ারকে। অপমান-অস্বস্তির ছাপ পড়ে বাংলাদেশি অধিনায়িকার চোখে-মুখে। এসবের কোনও প্রয়োজন কি সত্যিই ছিল হরমনপ্রীত? কোথায় গেল আপনার খেলোয়াড়ি স্পিরিট?
[আরও পড়ুন: ৬৫ তলা থেকে ঝাঁপ সেনাকর্মীর! অভিনব কায়দায় উন্মোচিত হল ডুরান্ড কাপের ট্রফি]
আপনার কথা মনে করিয়ে দিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের কথা। খেলা শুরুর আগে ওয়াসিম আক্রম কার্যত তাচ্ছিল্যের সুরেই বলেছিলেন, ‘এটা তো অনুশীলন ম্যাচ।’ সেই ম্যাচে ভারতের কাছে হেরে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল আক্রমকে। পাক অধিনায়কের ছায়া তো আপনার মধ্যে কেউ দেখতে চায়নি হরমনপ্রীত! আপনাদের জয়ে সেলিব্রেট করা, আপনার পরাজয়েও পাশে থাকা আর আপনাদের লড়াইয়ে উৎসাহ দেওয়ার কাজটা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন আপনার অনুরাগীরা। তাঁদেরও তো আজ আপনার এই কাণ্ডে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। কী উত্তর দেবেন তাঁরা? কীভাবে এই অখেলোয়াড়োচিত আচরণে পক্ষপাতদুষ্টের মতো রায় দেবে?
ছোটবেলায় একটা কথা বড়দের থেকে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই শুনে থাকি। খেলায় হার-জিত রয়েছে। কিন্তু শত্রুকে কখনও দুর্বল ভাববে না। প্রতিপক্ষকে সম্মান দেখালে নিজের সম্মান কখনও কমে না। কিন্তু এসব তত্ত্বকথার ধারেকাছ দিয়ে হাঁটলেন না আপনি। এই আচরণকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? ঔদ্ধত্য? নাকি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস? আগামীর জন্য যে এই ঘটনা একেবারেই ভাল বিজ্ঞাপন নয়।
হরমনপ্রীত, আপনি একজন নারী। নারীদের মধ্যে মায়া-মমতা নাকি একটু বেশি। এই প্রতিবেদনে নারী-পুরুষকে আলাদা করলে আবার ফেমিনিজমের কচকচানি মনে হতে পারে। তার উপর যেখানে বর্তমানে মহিলা ও পুরুষদের বেতনও সমান করে দিয়েছে ভারতীয় বোর্ড, সেখানে এই তুলনা চলে না। তবে ক্রিকেটের একজন ভক্ত হিসেবে সত্যি বলছি, আপনার সঙ্গে আমরা রিকি পন্টিংয়ের তুলনাও করতে চাই না। যিনি ‘দুর্বল দলের সঙ্গে টেস্ট খেলাই উচিত নয়’ বলে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন একসময়ে। তাঁর কথায় ফুটে উঠেছিল ঔদ্ধত্য। আর কে না জানেন, ঔদ্ধত্যকে ভাল ভাবে নিতে পারে না এই পৃথিবী।
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে মহিলা ক্রিকেটকে লাইমলাইটে আনার চেষ্টা করছে বিসিসিআই-আইসিসি। মহিলা ক্রিকেটারদের বেতন বাড়ানো থেকে শুরু করে নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়া, মহিলা আইপিএল চালু করার মতো পদক্ষেপ করে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মহিলা ক্রিকেটেরও সমান মর্যাদা প্রাপ্য। যাতে ২২ গজে ইতিহাস রচনার অনুপ্রেরণা পায় আগামীরা। এভাবে সেই স্বপ্নের হত্যা করবেন না।
আগামীর জন্য শুভেচ্ছা রইল।