২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী যে দুর্নীতি-বিরোধী স্লোগান তুলেছিলেন, তাকে এখন রাজনৈতিক ভাষ্য ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। এই ভাষ্যের তাৎপর্য যদি থাকত, তাহলে কেন বিজেপি-শাসিত কর্নাটক ও গোয়ায় দুর্নীতি দমন করা হচ্ছে না প্রশাসনিক তরফে? ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ঠিক পাশে পাশেই যে সহাবস্থান করে দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ! লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
এই মুহূর্তে একটাই জব্বর প্রশ্ন- নরেন্দ্র মোদি সরকারের সাত বছরে দুর্নীতি কি কমেছে, বেড়েছে, না কি একই থেকে গিয়েছে? ভুলে গেলে চলবে না, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পর তাঁর প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে জাতির উদ্দেশে মোদি বার্তা দিয়েছিলেন- ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’, অর্থাৎ, নিজেও ঘুষ খাব না, কাউকে ঘুষ খেতে দেবও না। কিন্তু এ-কথা এখন কর্ণাটকের কন্ট্রাক্টরদের বললে তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? বিগত মাসে কর্ণাটকের স্টেট কন্ট্রাক্টর অ্যাসোসিয়েশন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে একটি চিঠিতে দাবি করেছে, বেঙ্গালুরুতে যে কোনও নির্মাণকাজ শুরু করতে গেলে আগে টেন্ডারের মূল্যের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিতে হয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিল ক্লিয়ার করার জন্য উপরি ৫ শতাংশ। গোয়ার রাজ্য সরকারি কর্মচারীরাই বা এখন কী ভাবছেন মোদির সেই শপথ নিয়ে? সে-রাজ্যের বিজেপি বিধায়ক নিজেরই দলের পিডব্লিউডি বিভাগের মন্ত্রী সম্পর্কে অভিযোগ এনেছেন যে, তাঁর দপ্তরে প্রতিটি নিয়োগের জন্য তিনি ২৫-৩০ লাখ টাকা ঘুষ হিসাবে নিচ্ছেন। মহারাষ্ট্রের পুলিশ অফিসারদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সেখানে একজন প্রাক্তন শীর্ষস্থানীয় পুলিশকর্তা রাজ্যের প্রাক্তন এবং অধুনা গ্রেপ্তার হওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। অভিযোগটি ছিল, সেই মন্ত্রী পুলিশ বিভাগের থেকে মাসিক ১০০ কোটি টাকা ‘ভাসুলি’ চেয়েছিলেন।
[আরও পড়ুন: পুরনো বন্ধুত্বের স্পর্শ, অতিরিক্ত মার্কিন নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার পাশেই ভারত]
এর মধ্যে কর্ণাটক আর গোয়া বিজেপি-শাসিত রাজ্য, মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসীন বিরোধী জোটের সরকার। ঘটনাক্রম থেকে যা স্পষ্ট হচ্ছে, রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বহাল তবিয়তে রয়েছে এখনও। প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার শপথের তাহলে কী পরিণতি হল? ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগের পরিস্থিতির কথা একবার মনে করে দেখুন। মোদির লৌহপুরুষ সত্তার নির্মাণ কিন্তু হয়েছিল তাঁর দুর্নীতি-বিরোধী যোদ্ধার পরিচিতির উপর নির্ভর করে। ২০১৪ সালে ভোটের স্লোগান ছিল- ‘বহুৎ হুয়া ভ্রষ্টাচার, আবকি বার মোদি সরকার’, মানে, অনেক দুর্নীতি হয়েছে, এবার মোদি সরকারকে এনে তার অবসান ঘটানো হোক। এই স্লোগানের তিরের ডগায় ছিল বিধ্বস্ত ও দুর্বল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ সরকার। তখন সেই সরকার একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে জেরবার। কিন্তু ভোটের প্রচারে দুর্নীতিবিরোধী স্লোগান তোলা তুলনায় সহজ কাজ, বাস্তবে প্রকৃত বাঁকবদলকারী পরিবর্তন আনা ততটা সহজ নয়। কাজেই দেখা প্রয়োজন, ভাষণে উচ্চারিত বড় বড় কথার আড়ালে আসল বাস্তবতাটা কী?
এই বছরের জানুয়ারি মাসে ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’-এর বার্ষিক কোরাপশন ইনডেক্সে ভারত ৮৬তম স্থান পেয়েছে। ২০১৩ সালে ভারত ছিল ৯৪তম স্থানে। মাত্র ছ’টি স্থান অতিক্রম করেছে ভারত এই আট বছরে। নেহাতই প্রান্তিক স্তরের উন্নতি বলা যায় একে। ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার ঝুঁকি কতটা রয়েছে- সেই বিষয়ে দেশে ব্যবসারত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় ‘গ্লোবাল ব্রাইবারি রিস্ক ইনডেক্স’, সেই তালিকায় ২০১৩ সালে ভারত ছিল ১৮৫তম স্থানে। ২০২০ সালে অনেকটা এগিয়ে এসেছে ভারত এই তালিকায়, ঘুষের ঝুঁকির নিরিখে দেশ রয়েছে ৭৭তম স্থানে। ডিজিটাইজেশন এবং বিবিধ সরকারি প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে করসংগ্রহ হোক বা জনপরিষেবা- সরকারি বিভিন্ন উচ্চপদের অপব্যবহার কমে গিয়েছে। ইউপিএ আমলের থেকে মোদি সরকারের আমলের এই একটি বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। কোনও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ এই আমলে নেই যা সরকারের স্থিতি নষ্ট করতে পারে। মন্ত্রিসভার দায়িত্ববোধ দুর্বল ইউপিএ জোট সরকারের আমলে বিশেষ দেখা যায়নি। এই আমলে তা আবার প্রতীয়মান হয়েছে। মন্ত্রিদের দায়িত্ব নিয়ে বড়সড় সরকারি কাটাছেঁড়া চলে। একজন ‘বিগ বস’ জাতীয় চিফ এগজিকিউটিভ এই গোটা বিষয়টার তদারকি করেন।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, বড় মাপের কোনও দুর্নীতির পর্দা ফাঁস হয় সাধারণত প্রভাবশালী কোনও নজরদার প্রতিষ্ঠান বা স্বাধীন মিডিয়া হাউসের তদন্তের ফলে। বিগত কয়েক বছরে যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলি অকেজো হয়ে গিয়েছে, মিডিয়া যেভাবে আপস করেছে, তাতে একটি সর্বশক্তিমান সরকারের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার উপর অস্বচ্ছতার পরত চাপিয়ে দেওয়া কোনও বিষয়ই নয় এখন আর। ‘রাইট টু ইনফরমেশন’-এর অল্প কিছু আবেদনেরই সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়। ‘সিএজি’ বা ‘কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’-এর কোনও রিপোর্টই আর জনপরিসরে তর্কের বিষয় হয়ে নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাবতীয় জেহাদ, লোকপাল ইত্যাদি কার্যত উবে গিয়েছে আলোচনার পরিসর থেকে। মাঝেমধ্যে যদিও বা মিডিয়ার তরফে কোনও দুর্নীতির ঘটনার একটি শক্তিশালী তদন্তের আভাস পাওয়া যায়, তা নিয়ে সচরাচর ঠিকঠাক প্রচার চোখে পড়ে না।
এই দেশের বুকে বিপুল ও নিয়ন্ত্রণহীন নির্বাচনী তহবিল সিস্টেমের নেপথ্যে যে বিতর্কিত ইলেক্টোরাল বন্ড স্কিম জুড়ে রয়েছে, সেই ধ্রুপদী উদাহরণটির কথাই না হয় ধরা যাক। ২০১৯-’২০ নির্বাচনী বছরে, ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে বিভিন্ন দল যত টাকা পেয়েছিল, তার মোট পরিমাণ ছিল ৩,২৪৯ কোটি টাকা। দেখা গিয়েছে, এর সিংহভাগ, ২,৬০৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোটের ৭৫ শতাংশরও বেশি পরিমাণ টাকা গিয়েছিল বিজেপির ট্যাঁকে। বলা বাহুল্য, এই পরিসংখ্যান পুঁজির বিপুল বৈষম্যই তুলে ধরে। তার চেয়েও সমস্যাজনক বিষয় হল, এই ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা কার থেকে আসছে, তা নিয়ে অস্বচ্ছতা। এবং সেই তথ্য ও পুঁজি অধিগত করার ক্ষমতা থাকবে একমাত্র ক্ষমতাসীন দলের কাছেই! এর থেকে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল স্বজনপোষণ-জনিত ‘ক্রায়োনিজম’-এর সম্ভাবনা উঁকি দেবে এবং এমনকী, সন্দেহের আওতায় ঢুকে পড়বে যথাসম্ভব ত্রুটি ছাড়াই গোপন চুক্তির চিন্তাও। সর্বোচ্চ আদালতকে সম্মান দিয়েই বলতে চাই, এই ইলেক্টোরাল বন্ড বিষয়ক মামলায় এখনও প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি ঘটেনি।
আমার মতে, নির্বাচন যদি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মূল যন্ত্র হয়, তাহলে সেই যন্ত্রটি চলে পুরোপুরি টাকা নামক তেলে! গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বড় মাপের নির্বাচন অবধি, প্রতি বছর বিভিন্ন নৈমিত্তিক নির্বাচনে টাকার অবিরাম জোগান প্রয়োজন। যদি বড় বড় পার্টির ফান্ড বড় বড় কর্পোরেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে, তবে নিচু তলার ছোট ছোট পার্টির ফান্ড চলে আঞ্চলিক বা স্থানীয় সিন্ডিকেটের টাকায়। শেষমেশ ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই- ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ঠিক পাশে পাশেই সহাবস্থান করছে দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ! সরকারি আধিকারিককে ‘রেট কার্ড’-এর অজুহাতে বদলি করা হোক বা পোস্ট দেওয়া, ডান্স বার থেকে ‘হপ্তা’ তোলা হোক বা খনিতে বেআইনি খনন, জমি কিংবা বিল্ডিংয়ের রেগুলশন বদলে দেওয়া হোক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত ম্যানেজমেন্ট সিটের অনুমোদন, কিংবা গ্রামের সড়ক নির্মাণের টেন্ডারে গরমিল করানো- দুর্নীতির ধরন বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই স্থানীয় নেতা ও আমলার পারস্পরিক পৃষ্ঠকণ্ডূয়ণ-সমৃদ্ধ বহুকালীন গেড়ে বসা সিস্টেম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখুনই না, প্রতিটি স্তরের নির্বাচিত নেতাদের ধনদৌলত কীভাবে প্রতি বছর অন্তর কী বিপুল হারে বেড়ে যায়! কীভাবে সম্ভব হয় এমনটা? নোটবন্দি-উত্তর বিশ্বে অর্থের যেভাবে পুনরুত্থান ঘটল, স্পষ্টত, দেশজোড়া এই ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার সংস্কৃতিতে অবসান ঘটানো অতটাও সহজ কাজ হবে না। কথাগুলি সারা দেশ সম্বন্ধে প্রযোজ্য।
সুতরাং, মোদির দুর্নীতি-বিরোধী স্লোগানকে এখন আরও বেশি করে রাজনৈতিক ভাষ্য ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। কারণ, খুঁটিয়ে ভাবলে, এই ভাষ্যের আসলে কোনও অর্থই নেই। যদি থাকেই, তাহলে সর্বাগ্রে কেন বিজেপি-শাসিত কর্নাটক ও গোয়ায় এই দুর্নীতি-বিরোধিতা দমন হচ্ছে না প্রশাসনিক তরফে, যেখানে কিনা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটছে ব্যাপকভাবে? দুর্নীতির দায় পূর্বতন সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে আর বেশিদিন চিঁড়ে ভেজানো যাবে কি? মজার বিষয়, কর্নাটকের কনট্রাক্টররা আগে যে জেডি(এস)-কংগ্রেস জোট সরকারের বিরুদ্ধে ১০ শতাংশ কমিশন খাওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন, এখন তাঁরাই বলছেন, নব্য সরকার ‘রেট কার্ড’ দেওয়ার ব্যাপারে ৩০ শতাংশ কমিশন নিতে শুরু করেছে! দুর্নীতির মাপকাঠি দিয়ে আরও বেশি করে মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ বুঝতে পারা যায়!
পুনশ্চ গত মাসে মেঘালয়ের গভর্নর সত্যপাল মালিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। একেবারে ঠেঁাটকাটা মানুষ। তিনি নির্বিকার চিত্তে দাবি করলেন যে, গোয়ার গভর্নর থাকাকালীন, পাঞ্জিমের বিজেপি সরকার এমনকী, কোভিড ত্রাণ তহবিলেও বড়সড় দুর্নীতি করেছিল এবং এ-বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অভিযোগপত্রও পাঠিয়েছিলেন। ‘কী হল তারপর’, আমি জিজ্ঞেস করলাম। দীর্ঘশ্বাস-সহ উত্তর এল– ওয়েল, কী আর, আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে শিলংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল!