সুতীর্থ চক্রবর্তী: ১৯৯৫ সালে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি তথ্য সে সময় সবাইকে চমকে দিয়েছিল। ওই তথ্যে দেখা গিয়েছিল, ১৯৮৮ সালে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ শুরু হওয়ার পর থেকে যত জন সেখানে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসের বলি হয়েছে, সেই একই সময়ে বিহারে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ জাতিদাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে। মধ্য ও দক্ষিণ বিহারে সেই সময় জাতিদাঙ্গা ও গণহত্যা রোজকার খবরের বিষয় ছিল। ১৯৯৭ সালেও আমরা বিহারের ভোজপুর লাগোয়া লক্ষ্মণপুর বাথে গ্রামে ৬২ জন দলিতের একরাতে নিহত হওয়ার ঘটনা দেখেছি। উচ্চবর্ণের রণবীর সেনার ঘাতকরা ঘোড়ায় চেপে ওই রাতে শোন নদীর চরের ওই দলিত গ্রামটিতে হামলা চালিয়েছিল। হিন্দি বলয়ের জাতপাতের লড়াই নিয়ে বলিউডে অসংখ্য থ্রিলার হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মণপুর বাথের নৃশংসতা রুপোলি পর্দার সব কল্পনাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
[আরও পড়ুন: ‘করদাতাদের টাকায় কেনা প্রধানমন্ত্রীর ৮ হাজার কোটির বিমান বিলাসিতা নয়?’ পালটা খোঁচা রাহুলের]
বিহারের ওই জাতিদাঙ্গার দিনগুলি ইতিহাসে চলে গিয়েছে। বিজেপিকে সঙ্গী করে নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর নিচু জাত ও উঁচু জাতের ক্ষমতা ভাগাভাগির রসায়নটা আপাতত বিহারে পুলিশ প্রশাসন থেকে সমাজের একেবারে নিচুতলা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। সে কারণেই কিছুদিনের জন্য হয়তো রণবীর সেনা, ভূমিহার সেনাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। ছয়ের দশকের শেষভাগ থেকেই দেশজুড়ে জাতিবৈরিতা এক হিংসাত্মক চেহারা নেয়। এমনকী, ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় যে দশকটিকে দেশের ‘উন্নয়নের দশক’ বলা হত, সেই সময়ও ৪০ হাজার হরিজন বিরোধী হিংসার ঘটনা ঘটেছিল। স্বাধীনোত্তর ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় যে উঁচুজাতির অাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, বি. আর. আম্বেদকরের সেই অাশঙ্কাই পাঁচ ও ছয়ের দশকে প্রকট হয়েছিল। নয়ের দশকের গোড়ায় মণ্ডল কমিশন এক বিরাট প্রভাব বিস্তার করল সমাজে। একদিকে যেমন হিন্দি বলয়ে লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিং যাদব, মায়াবতীরা দলিতদের সমর্থনে ক্ষমতা দখল করলেন, অন্যদিকে সক্রিয় হয়ে উঠল ঠাকুর, ভূমিহার, রাজপুতদের সেনারা।
উন্নাও, হাথরস, বলরামপুর, ভাদোই– পরপর কয়েকটি ঘটনা আবার এক নতুন বাস্তবতাকে সামনে তুলে আনছে। দলিত অত্যাচারের ঘটনা দেশে যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তা কখনওই নয়, হিন্দি বলয়ের বাইরেও ধারাবাহিকভাবে তা ঘটে চলেছে। আম্বেদকর চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের পরপর কয়েকটি ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথের আমলে ফের প্রশাসনে উচ্চবর্ণের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
হাথরাসের ক্ষেত্রে খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, অভিযুক্ত উচ্চবর্ণের চার যুবকের পক্ষে গ্রামে ঠাকুর সম্প্রদায়ের মহাপঞ্চায়েত আহ্বান। সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিজেপির এক প্রাক্তন বিধায়ক। হাথরসের নির্যাতিতা দিল্লির হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর খুব স্বাভাবিকভাবে শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে তোলপাড় হয়, যেমনটা কয়েক বছর আগে নির্ভয়ার ঘটনার ক্ষেত্রেও হয়েছিল। কিন্তু হাথরসের ঘটনার প্রেক্ষিতটা সাম্প্রতিককালের অন্য যে কোনও নারী নির্যাতনের ঘটনার চেয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলিতদের উপর অত্যাচার, সামাজিক বঞ্চনার মতো বিষয়গুলি। অামরা দেখতে পাচ্ছি, হাথরাসের নির্যাতিতার গোটা পরিবার গ্রামে আর এক মুহূর্তের জন্যও নিরাপদ বোধ করছে না। একদিকে উচ্চবর্ণের লোকেরা জোট বেঁধেছে, অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৈরি হয়েছে চাপ। পরিবারকে বন্দি রেখে যেভাবে নির্যাতিতার দেহ সৎকার করা হয়েছে, তা এককথায় বেনজির।
প্রশাসনের তরফে চাপ দিয়ে নির্যাতিতার পরিবারের বয়ান বদল করার উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশাসনের তরফে গোটা পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া পক্ষপাতের এক নগ্ন দৃষ্টান্ত। হাথরসের এই অভিজ্ঞতা থেকে চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়, উত্তরপ্রদেশে পুলিশ প্রশাসন নিচুতলায় খুবই একপেশে দৃষ্টি নিয়ে চলেছে। স্বাধীনোত্তর ভারতের রাষ্ট্রকাঠামোয় উচ্চবর্ণের এই আধিপত্যের আশঙ্কাই আম্বেদকর সবসময় প্রকাশ করতেন। দেশজুড়ে হইচইয়ের মধ্যেও গ্রামের উচ্চবর্ণের লোকেরা যেভাবে নির্যাতিতার পরিবারটির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে সভা করল, তা খুবই উদ্বেগের। উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনের মদতে উচ্চবর্ণের লোকেদের বেপরোয়া মনোভাব এই ঘটনা দেখিয়ে দেয়। নির্যাতিতার ভাই অসহায়ভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেছে, ‘আমরা এবার গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চাই।’ নির্ভয়ার ঘটনার পর ধর্ষকদের পরিবার সামাজিক বয়কটের মধে্য পড়েছিল। এখানে অভিযুক্তদের প্রতি ন্যায়ের দাবি তুলছে গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ উচ্চবর্ণ। ৫০০ জনকে নিয়ে মহাপঞ্চায়েত বসছে। সেখানে উপস্থিত থাকছেন শাসকদলের প্রাক্তন বিধায়ক। নিঃসন্দেহে ভয়াবহ পরিস্থিতি। হাথরসের নির্যাতিতার মৃত্যুর পরের দিনই একইরকম ঘটনা উত্তরপ্রদেশের আরও এক গ্রামে। তারপরের দিন উত্তরপ্রদেশের আরও একটি গ্রামে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে এক দলিত কন্যাকে। সবক্ষেত্রেই অভিযোগের তির উচ্চবর্ণের দিকে।
সুতরাং এই ঘটনাগুলি বন্ধ করতে চাইলে সমস্যার গভীরে যেতে হবে। আম্বেদকর চেয়েছিলেন বর্ণব্যবস্থার অবসান। গান্ধীজি অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ করে শুধু বর্ণব্যবস্থার সংস্কারের পথে হেঁটেছিলেন। আমূল পরিবর্তনে যাননি। শেষ জীবনে এসে আম্বেদকর বুঝেছিলেন বর্ণব্যবস্থার অবসান হওয়া অসম্ভব। মৃতু্যর আগে হতাশ হয়ে আম্বেদকর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের পরপর দলিত নির্যাতনের ঘটনা কিন্তু ফের সিঁদুরে মেঘ দেখাচ্ছে। রাষ্ট্র পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে সমূহ বিপদ। কোনওভাবেই বন্ধ করা যাবে না এই ঘটনাগুলি।