কৃশানু মজুমদার: দিয়েগো মারাদোনার (Diego Maradona) শতাব্দীর সেরা গোল তো সবারই মনে আছে। কিন্তু যাঁর কাছ থেকে সেদিন শেষ বলটা পেয়েছিলেন ফুটবল-ঈশ্বর, তাঁর কথা ক’জন জানেন? কতজন মনে রেখেছেন তাঁকে? তিনি হেক্টর এনরিকে (Hector Enrique)।
আর্জেন্টিনায় তাঁর বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছেন মারোদানা। তাঁর বেডরুমে মারাদোনা, ড্রয়িং রুমে মারাদোনা। হেক্টরের হৃদয় জুড়ে শুধুই মারাদোনা আর মারাদোনা। দেখে কে বলবে এটা ২০২২? মনে হবে তিনি তো পড়ে রয়েছেন সেই ১৯৮৬-তেই।
২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর চলে গিয়েছেন আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ী অধিনায়ক। কিন্তু হেক্টরের স্মৃতিতে মৃত্যু নেই তাঁর ক্যাপ্টেনের। মারাদোনা রয়েছেন তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসে। তাই সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের প্রতিনিধিকে তিনি বলছেন, ”দিয়েগো আমার সঙ্গে রয়েছে প্রতিদিন, সর্বক্ষণ।”
[আরও পড়ুন: দোহাই সিআর, আপনি আজ অন্তত দুর্ভাগ্যের সন্তান হবেন না]
১৯৮৬ সালের ২২ জুন। মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের সামনে আর্জেন্টিনা। প্রথমে সেই বিতর্কিত ‘ঈশ্বরের হাত’, আর তার পর মাঝ মাঠ থেকে ঐতিহাসিক দৌড়। ইংল্যান্ডের একের পর এক খেলোয়াড়কে মাটি ধরিয়ে মারাদোনা যখন ষাট মিটারের রূপকথার দৌড় থামালেন, তখন‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হয়ে গিয়েছে। বল ইংল্যান্ডের জালে। পিটার শিলটনরা স্তম্ভিত। বিস্মিত ধারাভাষ্যকারও। আবেগ ধরে রাখতে পারেননি তিনিও। স্বপ্নের গোলের পরে রসিকতা করে হেক্টর এনরিকে বলেছিলেন, ”এমন বল বাড়িয়েছিলাম যে গোল করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলা ছিল না দিয়েগোর।” জনশ্রুতি এমনটাই বলে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি, হেক্টর এনরিকে কী বলছেন সেই বিখ্যাত গোল নিয়ে? ”মারাদোনা নিজের হাফ থেকে বল ধরে ছ’ জন ইংল্যান্ডের ফুটবলারকে কাটিয়ে গোল করেছিল। ফুটবল-ইতিহাসের সেরা গোল। মারাদোনা কার কাছ থেকে শেষ বলটা সেদিন পেয়েছিল, সেটা চিরকালই কৌতূহলের বিষয় হয়েই থাকবেন,” বলছিলেন হেক্টর।
একক দক্ষতা ও প্রতিভার স্ফুরণ এই পৃথিবীতে বিরাট পার্থক্য গড়ে দিতে পারে, তা দেখা গিয়েছিল মেক্সিকোয়। একটা গোল মারাদোনাকে বসিয়ে দিয়েছিল ঈশ্বরের বেদিতে। তিনি হারতে পারেন না। তিনি অমর। সতীর্থদের কাছে এমন এক ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল বিখ্যাত দশ নম্বর জার্সিধারীর। হর্হে বুরুচাগার মতো বিশ্বজয়ী প্রাক্তন বলেছিলেন, ”আমরা তো মনে করতাম দিয়েগো মৃত্যুকেও হারিয়ে দিতে পারে।” কিন্তু বছর দুয়েক আগের সেই অভিশপ্ত দিন মনে করিয়ে দিল মারাদোনা আর পাঁচ জনের মতোই রক্তমাংসের একজন মানুষ। নিঃশব্দে, নীরবে মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে গেল সকলের হৃদয়ের রাজাকে।
দেখতে দেখতে আরও একটা ২৫ নভেম্বর দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। তার আগে মারাদোনা-ভক্ত হেক্টর অভিশপ্ত দিনের স্মৃতিচারণ করে বলছেন, ”সেদিন দুপুরে ট্রেনিং থেকে ফিরেই শুনলাম দিয়েগো মারাদোনার মৃত্যুর খবর। দিয়েগোর সঙ্গে একসময়ে কাজ করেছিল ডক্টর লেনটিনি। তিনিই আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি মারাদোনা সম্পর্কে কিছু শুনেছো? দিয়েগো আর নেই, ও মারা গিয়েছে, এমন কথা আমারও কানে এসেছিল। তবে আমি বিশ্বাসই করিনি। আমি ডক্টর লেনটিনিকে বললাম, এটা সম্পূর্ণ ভুয়ো খবর। দিয়েগো একদম ঠিক আছে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আমাদের সবার ভুল ভাঙে। মারাদোনা এবার আর মৃত্যুকে ড্রিবল করতে পারল না। দিয়েগোর বাবা-মা ‘ডোনা টোটা’ আর ‘ডন দিয়েগো’ ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। ওঁরা ওকে খুব ভালবসত। দিয়েগো ওদের সঙ্গে শান্তিতে শুয়ে আছে।”
[আরও পড়ুন: বিশ্বকাপে নামার আগেই রোনাল্ডোর জন্য দুঃসংবাদ, দু’ ম্যাচের নির্বাসনে মহাতারকা]
ফুটবলকে শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন মারাদোনা। সবুজ ঘাসের গালচেতে বল পায়ে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে উঠতেন তিনি। মারাদোনা এক আবেগের নাম। তাঁর জীবনে অদ্ভুত বৈপরীত্য। একদিকে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি, অন্যদিকে বিতর্কের বরপুত্র। হাত দিয়ে গোল, ডোপিং, মাদকাসক্ত এক কলঙ্কিত নায়ক। তবুও তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। মৃত্যুর পরেও সবার বিশ্বাস মারাদোনা আছেন। রয়ে গিয়েছেন আমাদের আশপাশে। ফুটবলপ্রেমীদের চোখে ভাসছে বল পায়ে মারাদোনার সেই সব বিখ্যাত দৌড়। প্রিয় ক্যাপ্টেনের স্মৃতিতে ডুব দিচ্ছেন হেক্টরও। বলছেন, ”আমার কাছে মারাদোনা ইউনিক একজন খেলোয়াড়। ওর মতো কেউ ছিল না, হবেও না এবং এখনও কেউ নেই। দিয়েগো মারাদোনার মতো হৃদয়বান মানুষও বিরল এই পৃথিবীতে। মারাদোনার খেলা ছিল নয়নাভিরাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দিয়েগোকে দেখে আমার হিংসেই হত। এত সহজে ড্রিবলিং করত, খুব সহজে গোল করে আসত, এগুলো দেখলে ঈর্ষা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বকাপ আমিও জিতেছি। কিন্তু দিয়েগোকে খেলতে দেখলে দারুণ এক অনুভূতি তৈরি হত। আমার কাছে মারাদোনা দারুণ এক ফুটবলার, যাঁর তুলনা সে নিজেই।”
বিশ্বকাপ-বুভুক্ষু এক দেশ আর্জেন্টিনা। সেই কবে মেক্সিকোয় বিশ্বজয় করেছিল নীল-সাদা জার্সিধারীরা। তার পর কেটে গিয়েছে ৩৬ বছর। বিশ্বের বহুদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে, ফুটবল পেয়েছে মারাদোনার উত্তরসূরি লিয়োনেল মেসিকে। কিন্তু কাপ আসেনি। এবার কাতারে প্রথম ম্যাচেই পদস্খলন হয়েছে মেসিদের। ধারে ও ভারে অনেক দুর্বল সৌদি আরবের কাছে পরাস্ত হয়ে মরুভূমিতে পথ খুঁজছে আর্জেন্টিনা। দেশ থেকে মরুদেশে এখন হেক্টর। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন প্রাক্তন বিশ্বজয়ী বাতিস্তা, কার্লোস তাপিয়ারা। মেসির আর্জেন্টিনাকে নিয়ে কী বলছেন একসময়ের বিশ্বজয়ী? হেক্টর বলছেন, ”আগের ম্যাচ অতীত। এখন জাতীয় দলকে উৎসাহ দেওয়ার সময়। স্কালোনি এবং তাঁর কোচিং স্টাফের উপরে আমাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। প্রতিটি ফুটবলারের উপরেই আস্থা রয়েছে। বিশেষ করে বলবো মেসির কথা। ও ফুটবল জিনিয়াস। ওকে খেলতে দেখলে অদ্ভুত রকমের এক অনুভূতি হয় আমার। কেরিয়ারে একটা বিশ্বখেতাব মেসি আশা করতেই পারে। আশা রাখি ঈশ্বরও তাই চাইবেন।” অগ্রজ হেক্টর অনুজ মেসির পাশে দাঁড়াচ্ছেন বিপর্যয়ের সময়ে।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে হেক্টর ফিরে যাচ্ছেন ফেলে আসা সময়ে। উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন মারাদোনা। আবেগপ্রবণ হেক্টর বলছেন, ”আমার ঘরে দিয়েগোর ছবি। সেই ছবিটাই আপনাকে পাঠালাম। মারাদোনার প্রতি আমার অনুভূতি আপনি নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারবেন। খুব ছোটবেলা থেকে আমি মারাদোনাকে চিনতাম। আমার যখন ১৪ বছর বয়স, মারোদানার তখন ১৫। দিয়েগো ততদিনে প্রথম ডিভিশনে খেলা শুরু করে দিয়েছে। জাদু দেখাতে শুরু করে দিয়েছে মারাদোনা। দিয়েগোর সঙ্গে যখন আমার সাক্ষাৎ হয়, তখন থেকেই ওর প্রেমে পড়ে যাই। মানুষ হিসেবে মারাদোনা অনেক বড়। দিয়েগো আমার সঙ্গে রয়েছে প্রতিদিন। সর্বক্ষণের সঙ্গী আমার।”
ফুটবলার হিসেবে জাতীয় দলে মারাদোনার সতীর্থ ছিলেন হেক্টর। কোচ মারাদোনার সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন তিনি। ক্লাব ফুটবলেও তিনি ছিলেন মারাদোনার সঙ্গী। টাইমমেশিনের সাহায্য না নিয়ে হেক্টর বলছেন, ”আল ওয়সল ক্লাবে দিয়েগো কোচ ছিল। আমি ছিলাম ওর সহকারী। দিয়েগোর সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি। নিঃসন্দেহে দিয়েগো গ্রেট কোচ। আমার মনে হয় ফুটবলার দিয়েগোর থেকেও কোচ দিয়েগো অনেক বড়।দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপেও আমি দিয়েগোর সহকারী ছিলাম। জার্মানির বিরুদ্ধে ম্যাচটায় আমাদের কিছুই ঠিকঠাক হয়নি। আমরা যে শুধু বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়েছিলাম তা নয়, জার্মানির কাছে চার গোল খেয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিলাম। ওই হৃদয়বিদারক পরাজয়ের পরে আমরা জাতীয় দলের দায়িত্ব ছেড়ে দিই।
২০১০ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খুবই ভাল খেলেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেবার মেসি একটি গোলও করতে পারেনি। সেটাও মেনে নেওয়া কঠিন ছিল আমাদের কাছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ওই বিশ্বকাপে হারের পরে কোচের পদ ছেড়ে দিয়েছিল দিয়েগো। নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি মারাদোনা।”
মারাদোনাহীন এই বিশ্বে প্রথম বিশ্বকাপ। প্রাক্তনরা বলছেন, ”লিও, দিয়েগোর জন্য অন্তত এবার কাপটা জেতো।” কিন্তু বিশ্বকাপ কি যাবে বুয়েনোস আইরেসে? মেসিদের বিশ্বকাপ জয়ের পথ ক্রমেই কণ্টকাকীর্ণ হচ্ছে। হেক্টর বলছেন, ”আমাদের আগে ১৯৭৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ১৯৯০ এবং ২০১৪ সালে বিশ্বজয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা। ঈশ্বর চাইলে আমরা জিততেই পারি এবার। আর্জেন্টিনার মানুষের জন্য ট্রফিটা দেশে আসা দরকার। দেশের মানুষের খুব দরকার ট্রফিটা।” মেসিরা কি শুনছেন অগ্রজর কথা?
চলতি মাসের ২০ তারিখ ফুটবল মহাযজ্ঞের বোধন হয়েছে কাতারে। সেদিনই আর্জেন্টিনা থেকে কাতারে এসেছেন হেক্টর। সুদূর কলকাতা থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে শুনে আবেগাপ্লুত বিশ্বকাপার মারাদোনার স্মৃতি সম্বলিত ছবি পাঠান এই প্রতিবেদককে। তার মধ্যে একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে মারাদোনা-হেক্টররা বিমানের সিটে বসে ঘুমোচ্ছেন। সেই ছবি প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ”আমি একটা ছবি পাঠালাম আপনাকে। সেখানে দেখবেন আমরা সবাই ঘুমোচ্ছি। স্বপ্নপূরণ করে আমরা ফিরছিলাম। ধন্যবাদ জানাই কার্লোস বিলার্দোকে, তাঁর সমস্ত কোচিং স্টাফদের এবং অবশ্যই দিয়েগো মারাদোনাকে।”
মারাদোনা নেই। ভক্তরা মনে করেন, দূর আকাশে ফুটবলের সঙ্গে সন্ধি করছেন দিয়েগো। কেউ বলছেন, মেসিদের জন্য অবিরাম আশীর্বাদ বর্ষণ করে চলছেন তিনি। শুক্রবার ২৫ নভেম্বর ফুটবলপ্রেমীদের আবেগ গণ হিস্টিরিয়ার আকার ধারণ করবে তা বলাই বাহুল্য। আর দীর্ঘ তিন যুগ আগের স্মৃতি ভেসে উঠবে হেক্টরের চোখে। তাঁর কাছ থেকে বল পেয়ে মারাদোনা ইংল্যান্ডের স্বপ্ন ভেঙেচুরে দিচ্ছেন। তার পর গোল উদযাপনের জন্য হাত তুলে ছুটছেন কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে।৩৬ বছর দীর্ঘ সময়। কথায় বলে, টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। কে বলল, সময় সব ভুলিয়ে দেয়? সময় তো অনেক কিছু ফিরিয়েও দেয়।