shono
Advertisement

উদ্বাস্তু জীবনের আয়না হাতে এক ছিন্নমূলের বৃত্তান্ত

সে জানে, মানুষ স্মৃতি দিয়েই তৈরি। স্মৃতিই তার সত্য, তার সত্তা।
Posted: 03:48 PM Oct 11, 2021Updated: 03:48 PM Oct 11, 2021

সে জানে, মানুষ স্মৃতি দিয়েই তৈরি। স্মৃতিই তার সত্য, তার সত্তা। বিশ শতকে পূর্ব আফ্রিকার রক্তস্নাত ইতিহাস যারা জানে, তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বের দাবি করবে গারনা-র সাম্প্রতিকতম উপন্যাস ‘আফটারলাইভ্‌স্‌’। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ব্যাপ্ত ১৯০৪-এর নামিবিয়ায় সংঘটিত নামা ও হেরেরো গণঅভ্যুত্থান থেকে ১৯০৭-এর মাজি মাজি আন্দোলন অবধি। লিখছেন দীপায়ন দত্ত রায়

Advertisement

সাহিত্যে সম্ভাব্য নোবেলবিজেতার নামের তালিকায় এবারেও ছিল হারুকি মুরাকামি, ওয়া থিয়োংগো, লুডমিলা উলিতস্কায়াদের নাম। কিন্তু সমস্ত সম্ভাবনা আর প্রত্যাশাকে ম্লান করে শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার পেলেন আবদুলরাজাক গারনা। তিনিই প্রথম তানজানিয়ার মানুষ যিনি এই সম্মান পেলেন। গারনা-র জন্ম ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবারে। অবশ্য খুব বেশিদিন তাঁর সে-দেশে থাকা হয়নি। ১৯৬৪ সালে জাঞ্জিবারে সুলতানি শাসনের অবসান হলেও একনায়কতন্ত্র আর স্বৈরাচারের অব্যাহত আক্রমণে বছর কুড়ির আবদুল দেশ ছেড়ে চলে আসেন ব্রিটেনে। সেই থেকেই তিনি ব্রিটেননিবাসী। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদ থেকে, যেখানে দীর্ঘ চার দশক তিনি উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন।

[আরও পড়ুন: বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী ঐক্যে কাঁটা ‘সেটিং’ তত্ত্ব]

গারনা-র এমন কোনও লেখা নেই, যে লেখায় উত্তর-ঔপনিবেশিকতার প্রসঙ্গ আসেনি। আর এসেছে ছিন্নমূল মানুষের অনুষঙ্গ। ওঁর উপন্যাসে বারবার ফিরে এসেছে আত্মপ্রসঙ্গ। ‘উদ্বাস্তু জীবনের আয়না হাতে ধরে’ লেখা গারনা-র বহু উপন্যাসের মধ্যে বিশেষভাবে সমাদৃত ‘মেমরি অব ডিপার্চার’ (১৯৮৭), ‘পিলগ্রিমস ওয়ে’ (১৯৮৮), ‘ডোটি’ (১৯৯০), ‘প্যারাডাইস’ (১৯৯৪), ‘অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স’ (১৯৯৬), ‘গ্র্যাভেল হার্ট’ (২০১৭) এবং সাম্প্রতিকতম ‘আফটারলাইভ্‌স্‌’ (২০২০)। গারনা নিজে যেমন ছিন্নমূল, তেমনই তাঁর চরিত্ররাও। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ‘যে স্থান ছেড়ে চলে এসেছি, তা অনেক বেশি জরুরি আমার লেখায়। আমি ভয় পেয়েছি। আমি থাকতে পারিনি। তাই আমার সমস্ত লেখাই আমার স্বীকারোক্তি। আমার সমস্ত নায়কই পরাজিত, অপরাধবোধে আচ্ছন্ন।’

​গারনা-র লেখা সবচেয়ে বহুলপঠিত উপন্যাস ‘প্যারাডাইস’-এর নায়ক ইউসুফ-ও যেমন একজন পরাজিত মানুষ। বাবা ঋণশোধ করতে না পারায় বিক্রি হয়ে যেতে হয় ইউসুফকে, আরবের এক ধনকুবেরের আশ্রয়ে ক্রীতদাসের জীবন কাটে তার। কিন্তু সেটুকুই সব নয়, ইউসুফ পরদেশে গিয়ে ক্যারাভানে থেকে-থেকেই ভাবে শুধু তার বাড়ির কথা, মা-বাবার কথা। অভিমান হয় তার, ঠিক করে সে আর ভাববে না বাড়ির কথা। কিন্তু এতদিনে ইউসুফ বুঝে গিয়েছে, ছিন্নমূলের সবচেয়ে বড় অভিশাপ তার স্মৃতি।

গারনা-র লেখায় স্মৃতি কখনও-কখনও যেমন অভিশাপ, তেমনই কোনও কোনও সময় আশীর্বাদও। যেমন ‘দ্য লাস্ট গিফ্ট’ উপন্যাসে সদ্য হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে ফেরা বছর তেষট্টির আব্বাস হঠাৎই একদিন এক অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়: কেন সে নিজের দেশ ছেড়ে এসেছিল? সে কি তাহলে কাপুরুষ? আজ বিলেতে সে চার দশকের স্থায়ী পরিযায়ী। তার সঙ্গে থাকে তার স্ত্রী মরিয়ম আর দুই ছেলে-মেয়ে হানা, জামাল। আব্বাসের ইচ্ছা, মৃত্যুর আগে সে তার ছেড়ে আসা জন্মভূমির সব স্মৃতি দিয়ে যাবে তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েকে। সেই হবে তার শেষ আশীর্বাদ, ‘শেষ উপহার’।

‘অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স’ গারনা-র আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। কিন্তু সে উপন্যাসের অনাম্নী দেশত্যাগী নায়ক অবশ্য ইউসুফ, আব্বাস, লতিফদের মতো অপাঙ্‌ক্তেয় জীবনে অভ্যস্ত নয়, সে ইংরেজি শিক্ষিত উচ্চবিত্ত, প্রিভিলেজ্‌ড। তবে ছিন্নমূল মানুষ তো যে কোনও অবস্থাতেই প্রান্তিক। শুরু থেকেই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রকে দেখি সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজেকে নীরবে, নিরাপদে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু একেবারে শেষে, যখন সে দ্বিতীয়বারের জন্য জাঞ্জিবার ছেড়ে বিলেত পাড়ি দিল তখন সে সব হারিয়ে ফেলেছে। হারিয়েছে তার বান্ধবী অ্যামেলিয়া, মেয়ে এমাকে। তখন তার সম্বল শুধু স্মৃতি। সে তখন অনেকার্থে ছিন্নমূল। তার প্রতিটা স্মৃতিই রক্তপাত ঘটাচ্ছে তখন। তবে স্মৃতি যতই কষ্টদায়ক হোক না কেন, তার মতো নির্ভর‍যোগ্য অবলম্বন আর একটিও নেই। নেই বলেই, ‘বাই দ্য সি’ উপন্যাসের বৃদ্ধ সালেহ্ ওমার ভুয়া পাসপোর্টে নিজের নাম বদলে তাঞ্জানিয়া থেকে ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে আশ্রয় খুঁজতে এসে বুঝতে পারে, মিথ্যেকে কেন্দ্র করে বাঁচতে-বাঁচতে সে নিজেকেই আর চিনতে পারছে না। তার কোনও স্মৃতি নেই, অতীত নেই। অথচ সে জানে, মানুষ স্মৃতি দিয়েই তৈরি। স্মৃতিই তার সত্য, তার সত্তা। বিশ শতকে পূর্ব আফ্রিকার রক্তস্নাত ইতিহাস যারা জানে, তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্বের দাবি করবে গারনা-র সাম্প্রতিকতম উপন্যাস ‘আফটারলাইভ্‌স্‌’। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ব্যাপ্ত ১৯০৪-এর নামিবিয়ায় সংঘটিত নামা ও হেরেরো গণঅভ্যুত্থান থেকে ১৯০৭-এর মাজি মাজি আন্দোলন অবধি। একদিকে জার্মান প্রশাসন-পরিচালিত গণহত্যা, অন্যদিকে জার্মান সেনা দ্বারা প্রশিক্ষিত দেশীয় সেনাদল শুৎজস্ট্রুপ আস্কারিস- এই দুইয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ টাঙ্গানিকার (এখন তানজানিয়া) মানুষের রোজনামচা এই উপন্যাস। সামরিক দ্বন্দ্বের সমান্তরেই রয়েছে পরিবারতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা।

উপন্যাসটি শুরু আপাতদৃষ্টিতে একটি সাদামাঠা বাক্য দিয়ে: ‘আমুর বিয়াশারার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় খলিফার বয়স ছিল ছাব্বিশ।’ কিন্তু ক্রমশ ঘটতে থাকে একের পর এক চরিত্রের আগমন, বাড়তে থাকে জটিলতা। গারনা অবশ্য যত না বেশি বর্ণনা ঔপনিবেশিক পর্যায়ের দিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন উপনিবেশ-পরবর্তী যুগের অবস্থা নিয়ে। গারনা স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেন, উপনিবেশগুলি ‘স্বাধীন’ হলেও, সেখানকার ‘স্বাধীন’ নাগরিকদের মন থেকে ঔপনিবেশিকতাকে কখনওই ওপড়ানো যাবে না। তাই তো উপন্যাসের নাম ‘উত্তর জীবন’- উপনিবেশের উত্তর জীবন। গারনা-র আরও একটি উপন্যাস ‘গ্র‍্যাভেল হার্ট’-এর দেশান্তরি নায়ক সেলিম তার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দেশে ফিরবে। কিন্তু এটুকু গল্পের সূচনাবিন্দু। উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সেইখানটা যেখানে সেলিম তার বাবাকে বলছে: ‘কী অদ্ভুত! আমরা আমাদের দেশকে জানছি তাদের (ইউরোপীয়দের) লেখা পড়ে, যারা আমাদের সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে।’ সেলিম আরেক জায়গায় বলছে, তাদের পরিবারে এ-যাবৎ যা কিছু হয়েছে তা অনেকটা ‘মেজার ফর মেজার’ নাটকের মতো। তবে এখানে এমন কোনও ডিউক নেই যে সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। আবদুলরাজাক গারনা-র উপন্যাসের চরিত্রদের যে অভিজ্ঞতা, তা বর্তমানের যে কোনও আধুনিকমনস্ক মানুষের অভিজ্ঞতা। আমরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও অর্থে আজ ছিন্নমূল। আমাদের প্রকৃত কোনও পুনর্বাসনের সম্ভাবনাও বর্তমানে হয়তো আর নেই। তাই গারনা-র লেখার প্রাসঙ্গিকতা শুধু আফ্রিকাকেন্দ্রিক নয়, বিশ্বজনীন।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক dwipayan.dr1994@gmail.com

[আরও পড়ুন: অবসরের নির্দিষ্ট বয়স নেই, ক্ষমতা হস্তান্তরই বড় চ্যালেঞ্জ ভারতীয় রাজনীতিতে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement