পাকিস্তান যখন চাপের মুখে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রচনায় মরিয়া তখন দুর্বল পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়া খুবই উচিত কাজ। পাকিস্তান এখন কাশ্মীরে ৩৭০ ফিরিয়ে আনার দাবি তুলছে না। কাশ্মীরে ভোট করাতেই বরং খুশি। তাদের দাবি, মোদি কাশ্মীরে ভবিষ্যতে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলুন, তাতেই আলোচনা শুরু হতে পারে। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দেখা হতে চলেছে উজবেকিস্তানের সমরখন্দে। ১৫ সেপ্টেম্বর ‘এসসিও’ (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন) বৈঠক শুরু। সেখানে অন্যদের পাশাপাশি চিন, এমনকী, তালিবান সরকারও থাকবে। শাহবাজ শরিফ নওয়াজ শরিফের ভাই। তাঁর সঙ্গে দেখা তো হচ্ছেই, দু’-দেশের পক্ষ থেকে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে একটা মুখোমুখি ‘ওয়ান টু ওয়ান’ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেরও চেষ্টা চলছে। জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রী নিজেও এখন নানা কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করতে আগ্রহী। সম্প্রতি তাঁর বেশ কিছু পদক্ষেপ এ বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিতবাহী।
প্রথমত, এই বছর মহরমের দিন মোদি এক অভূতপূর্ব টুইট করেছেন দিনটির পবিত্রতার কথা স্মরণ করে, দিনটির বিশেষ তাৎপর্য তুলে ধরে। যিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও স্কালক্যাপ পরতে রাজি হননি, তিনি এহেন টুইট করায় কট্টরবাদী বহু বিজেপি নেতা অসন্তুষ্ট। এক বিজেপি নেতা বলছিলেন, মহরমের দিন এহেন টুইট না করা বাঞ্ছনীয় ছিল। অমিত শাহ কিন্তু কোনও দিন এমন টুইট করবেন না।
[আরও পড়ুন: এই আছি, এই নেই, ঠিক কী চাইছেন রাহুল গান্ধী?]
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানে ঘোরতর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভয়ংকর বন্যায় সেখানকার মানুষের বিপর্যয় দেখেও মোদি টুইট করে সহানুভূতি ব্যক্ত করেছেন। আবার, পাক-মন্ত্রী ভারতের কাছ থেকে বন্যাত্রাণে সাহায্যও চেয়েছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে ভারতের বিদেশমন্ত্রক জানিয়েছে, পাক সরকার কোনও আবেদন জানায়নি। ‘ট্র্যাক টু-ডিপ্লোমেসি’ যাঁরা করেন তাঁরা মোদি সরকারকে বলছেন- পাকিস্তান সরকার এই সংকটে ভারতের দ্বারস্থ হলে, শাহবাজ সরকারকে নাস্তানুবাদ করে ছাড়বেন ইমরান খান। পাঞ্জাব থেকে উপনির্বাচনে ভাল ফল করায় ইমরান আবার নতুন সরকারকে বিপাকে ফেলতে আগ্রহী। ভারতের কূটনীতিকদেরও বক্তব্য- এদেশেও তো কট্টরবাদী কম নয়। সব জেনেও যদি পাকিস্তানকে সাহায্য করতে যায় ভারত, তারপর কাশ্মীরে খুব শীঘ্র কোনও পাক-সন্ত্রাস হলে, তখন কী হবে?
তৃতীয়ত, শাহবাজ শরিফ সেনাবাহিনীর সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এই ঘটনার অনেক আগে থেকেই অজিত ডোভালের সঙ্গে পাক সেনাপ্রধান যোগাযোগ রাখছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোদি তাঁকে টুইট করে অভিনন্দন জানান। চিঠিও পাঠান। শরিফও প্রতি-শুভেচ্ছা জানিয়ে সৌজন্যের চিঠি পাঠান।
চতুর্থত, সাংহাই কর্পোরেশনের বিগত বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকে তাসখন্দে সম্প্রতি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক না হলেও অনেক দিন পর এক ছাদের তলায় জয়শংকর আর বিলাবল ভুট্টোর সাক্ষাৎকার হল। হল হাসি ও শুভেচ্ছা বিনিময়। ক’-দিন আগে তা-ও হয়নি।
পঞ্চমত, কাশ্মীরের বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে দিল্লিতে ডেকে মোদি সম্প্রতি বৈঠক করলেন। কাশ্মীরে ভোটের কথা ভাবছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকী, তিনি এ-কথাও বলে দিলেন যে, নতুন ডিলিমিটেশনের ভোটার তালিকা তৈরি না হলে পুরনো তালিকা দিয়েই তৈরি হতে পারে।
ষষ্ঠত, আবু ধাবির বিমানবন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির প্রেসিডেন্ট শেখ মহম্মদ বিন জায়েদের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন যখন দিল্লিতে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মা নবিকে সরাসরি আক্রমণ হেতু দেশ তোলপাড় হয়ে উঠেছে। দল তাঁকে সাসপেন্ড করে মোদির নির্দেশে।
মোদি কেন এমন করছেন? মোদি কি দশ বছর পর গোধরার স্মৃতি মুছে দিতে চাইছেন? তিনি কি এবার অটলবিহারী বাজপেয়ী হতে চাইছেন? লালকৃষ্ণ আদবানির ভাবমূর্তি ছিল কট্টর হিন্দুত্ববাদী, তিনি পাকিস্তান সফরে গিয়ে জিন্নাকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে বিপদে পড়েন। দলের মধ্যে বিতর্কের ঝড় ওঠে। খোদ আরএসএস এতটাই ক্ষুব্ধ হয় যে, তাঁকে দল থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়। মোদি কি সেদিনের কথা ভুলে গিয়েছেন? আদবানি যখন ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার প্রবল চেষ্টা করছেন, তখন আমার তৎকালীন সম্পাদক মহাশয় সেই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে বলেন, আমরা যখন ধর্মনিরপেক্ষ তখন এই প্রচেষ্টাকেও সমর্থন করতে হবে। কিন্তু
সেদিন এক প্রবীণ সাংবাদিক আমার লেখা পড়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন- বেড়াল বলে মাছ খাব না? কাশী যাব? কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে? আদবানি তো নিজেরই কট্টর ভাবমূর্তিতে বন্দি।
আসলে, আফগানিস্তানে তালিবান সরকার আসার পর তালিবানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়া জরুরি ছিল। সে কাজটি মোদি-ডোভাল সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন। তাতে পাকিস্তান ও চিনের সমস্যা হয়েছে। আমরা ইউক্রেন ইস্যুতে তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেও ‘ন্যাটো’-র সদস্য হইনি। রাশিয়ার সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক নষ্ট করতেও দেননি মোদি। আবার চিন আগ্রাসীমূলক মনোভাব নিলেও ভারত ধীরে ধীরে সুকৌশলে তাদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনার পথে যেতে চায়। জে. এন. দীক্ষিত বলেছিলেন- চিনের সঙ্গে সম্পর্কও রাখতে হবে, আবার সবসময় সাবধানতা অবলম্বনও প্রয়োজন। একে বলে ‘স্নেক ইন দ্য গার্ডেন’ সচেতনতা। বাগানে মালি ফুলগাছে জল দিচ্ছে, কিন্তু জানে এ বাগানে সাপও আছে। পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের সম্পর্কেও বেশ কিছু জায়গায় ঝামেলা হচ্ছে। প্রথমত, পাক-অর্থনীতি নাভিশ্বাস ফেলছে। আইএমএফের টাকা চাই। পাক সেনা তাই পুরনো মার্কিন সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে চাইছে। দ্বিতীয়ত, চিনা অস্ত্রের মান খুব খারাপ। অস্ত্র আমেরিকার কাছ থেকেই নিতে হবে। তৃতীয়ত, চিন ঋণ দিলে কী অবস্থা হয়, তা শ্রীলঙ্কায় সবাই দেখেছে। তাই পাকিস্তান চিনের খপ্পরে পড়তে চায় না। চতুর্থত, তালিবান সরকারের উপর পাক-নিয়ন্ত্রণ কমছে, ভারতের নিয়ন্ত্রণ আবার বাড়ছে দেখে চিনের কাছে পাকিস্তানের চেয়ে ভারত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। পঞ্চমত, চিনের বেশ কিছু এলাকায় তালিবান ও পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা সক্রিয়। চিনও তথাকথিত ইসলামিক সন্ত্রাসের বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন।
পাকিস্তান যখন চাপের মুখে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রচনায় মরিয়া তখন দুর্বল পাকিস্তানের সঙ্গে বোঝাপড়া খুবই উচিত কাজ। পাকিস্তান এখন কাশ্মীরে ৩৭০ ফিরিয়ে আনার দাবি তুলছে না। কাশ্মীরে ভোট করাতেই বরং খুশি। তাদের দাবি, মোদি কাশ্মীরে ভবিষ্যতে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলুন, তাতেই আলোচনা শুরু হতে পারে। পাক সেনাপ্রধান বাজওয়া-র সঙ্গে ভারতের ভাল সম্পর্ক। একমাস পর তাঁর অবসর। এই সময়ে ভারত-পাক আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হলে ভাল। আমেরিকা তথা আন্তর্জাতিক দুনিয়া তো তা-ই চায়।
রাষ্ট্রসংঘ বন্যার পর পাকিস্তানে যাচ্ছে। গোটা দুনিয়া ‘ক্লাইমেট ডিজাসটার’ নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই উপমহাদেশের সব দেশ এই পরিবেশের মতো বিষয়ে আপাতত একত্র হতে পারে। সন্ত্রাস আর কাশ্মীর আলোচনা না হয় পরে হবে। ‘এসসিও’ বৈঠকে এ ব্যাপারে একটা যৌথ প্রস্তাব গ্রহণের চেষ্টা হচ্ছে। মোদির এই বিদেশনীতির নয়া অভিযান অভিনন্দনযোগ্য, কিন্তু সমস্যা অন্যত্র।
দেশের ভিতর যখন একদিনে দুটো রায় হয়- সুপ্রিম কোর্ট বলে, কর্ণাটকের চমরাজপেট ইদ্গা ময়দানে গণেশ পুজো হবে না তখন হাই কোর্ট বলে, হবে। সঙ্গে সঙ্গে সে রায়ের পর গোমূত্রে ‘পবিত্র’ করা হয় ইদ্গা। যখন গুজরাটে ধর্ষণকারীদের মালা পরানো লাড্ডু খাওয়ানো হয়, বিলকিস বেগম ইস্যুতে দেশের প্রধানমন্ত্রী গুজরাটে গিয়েও নীরব থাকেন, যখন গোটা দেশজুড়ে উগ্র-হিন্দুত্বর নামে সমাজটাই দু’ভাগ হতে বসেছে, এক তীব্র রাজনৈতিক ও সামাজিক অসহিষ্ণুতার জন্য মোদি সরকারকে নানা স্তরে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তখন কীভাবে মোদির এই স্টেটসম্যানশিপের উদ্যোগ, ‘বিশ্বনেতা’-র উদারতা সফল হবে?
মনে আছে, গোধরার পর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায় পারভেজ মোশারফ তাঁর বক্তৃতায় গুজরাটের দাঙ্গার কথা উত্থাপন করে ভারতীয় মুসলিমদের নিরাপত্তার অভাবে সোচ্চার হন। সেদিন গোধরার জন্য বাজপেয়ীকেও বিশ্ব দরবারে বিপদে পড়তে হয়। মোদির এই নয়া উদ্যোগকে তাই স্বাগত জানাই। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাবে, দেশের ভিতর বিজেপির রাজনীতির প্রধান উপজীব্য যদি হয়, উগ্র-হিন্দুত্ব যা আজ চূড়ান্ত সামাজিক বিরোধ পৌঁছে দিচ্ছে ভারতীয় সমাজকে, তবে দেশের বাইরে বিশ্বভ্রাতৃত্বের উদার কূটনীতি সফল হবে কীভাবে?