দেবাংশু ভট্টাচার্য: ২০২১ সালের নির্বাচনী ফলাফলের পর বিধানসভা বাম-কংগ্রেস শূন্য। সবেধন নীলমণির মতো টিমটিম করে জ্বলে রইলেন আব্বাস সিদ্দিকি-র দলের একজন বিধায়ক। ২০১১ সালে পরিবর্তনের হাওয়ায় ধরাশায়ী হওয়া বামেরা যখন পুনরায় মাটি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিল এবং মনে-মনে ছক কষছিল প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে পুনরায় বাংলা দখল করার, হয়তো তখনও ভাবতে পারেনি, ঠিক এক দশক পরে মাটি ফিরে পাওয়া তো দূর অস্ত, বরং অবশিষ্ট জমি হারিয়ে তারা আদপে শূন্য হয়ে যাবে! কিন্তু এরকমটা হওয়ার কারণটা কী?
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: পিকে কি বিহারের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী?]
শেষ দু’বছর ধরে টেলিভিশন চ্যানেলে বিভিন্ন বিতর্কে যাওয়ার দৌলতে বহু বাম নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাঁদের ব্যক্তিগত স্তরে যা বলতাম, সেগুলোই আজ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই!
যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতা দখলের চেষ্টা
প্রায় সাড়ে তিন দশক শাসন করার পর একটা দলকে যখন মানুষ সমাজ ও রাজনীতির সর্বস্তর থেকে উপড়ে ফেলে দেয়, তখন সেই মৌরসিপাট্টা ঘুচে যাওয়ার শোকে কাতর হয়ে আত্মসমালোচনার পরিবর্তে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই পুনরায় ক্ষমতা দখল করার লালসার তাড়নায় ৬৪ রকমের ‘কলাকৌশল’-এর প্রয়োগ মানুষের চোখে বামেদের ক্ষমতা-পিপাসার মুখোশকে বারবার উন্মোচিত করেছে। এক সময় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়,/ রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’ স্লোগান তুলেছিল বামেরা, ‘পুঁজিবাদী আমেরিকার দালাল’ বলে সমর্থন তুলে নিয়েছিল তাদের সরকার থেকে, তাদের হাতে হাজার হাজার বামকর্মীর প্রাণ গিয়েছিল সাতের দশকে, আবার রাজনৈতিক হত্যালীলার নামে হাজার হাজার কংগ্রেস কর্মীর প্রাণের বলি দিয়েছিল এই বামেরা- দশকের পর দশক পারস্পরিকভাবে বিরোধী অবস্থানে থাকা এই দু’টি রাজনৈতিক দলের ‘জোট’-কে মানুষ কোনওভাবেই ‘মানুষের জোট’ ভাবেননি। বরং ভেবেছেন, মাত্র পাঁচ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেই যে দলটা নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নির্লজ্জ রাজনৈতিক সমঝোতার পথে হাঁটতে পারে, তারা আর যা-ই হোক, মানুষের স্বার্থে ব্রতী নয়!
‘বিরোধিতা’ এবং ‘কুৎসা’-র তফাত গুলিয়ে ফেলা
আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘বিরোধিতা’ আর ‘কুৎসা’-র মধ্যে তফাত কী? সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বাইশে শ্রাবণ’ সিনেমায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত সংলাপের অনুকরণে বলতে পারি, ‘বিরোধিতা হল গণতন্ত্রের নেসেসিটি, কিন্তু কুৎসা আধুনিক বিরোধীর লাক্সারি!’ একটা ভাত, আরেকটা বিরিয়ানি। রোজ ভাত খেলে আপনার পেটের সমস্যা হবে না, কিন্তু নিয়মিত বিরিয়ানি খাওয়া শুরু করলে পেটের ব্যামো দেখা দেওয়া নিশ্চিত!
একটা সরকারের যাত্রাপথে ভুলভ্রান্তি হয়, দলচালনার ক্ষেত্রেও একবাটি চালে দু’-একটা কাঁকর পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে বিরোধী দলের বিরোধিতা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু কুৎসা কোনটা? ধরুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সুবিধা দিচ্ছেন গ্রামবাংলার মেয়েদের, হঠাৎ এক বাম নেতা বলে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পাইয়ে দেওয়া’-র রাজনীতি (ডোল পলিটিক্স) করছেন। অথচ দেখা গেল, ‘ইউনাইটেড নেশনস’-এর মতো সংস্থা ৬২টি দেশের ৫৫২টি প্রকল্পকে নস্যাৎ করে বেমালুম সাধারণ ভারতের অতি সাধারণ একটি অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের একটি ‘পাইয়ে দেওয়া’-র প্রকল্পকে বেছে নিল এবং সেই প্রকল্পের স্রষ্টা, সাদা শাড়ি, হাওয়াই চটি-পরিহিত এক মহিলাকে মঞ্চে ডেকে বিশ্বদরবারে সম্মানে ভূষিত করল। গোটা রাজ্য সেদিন গর্বিত বোধ করলেও এ-রাজ্যের বাম নেতারা লজ্জায় মুখ লুকনোর পরিবর্তে ‘অতি-শিক্ষিত আলিমুদ্দিনের থেকে ইউনাইটেড নেশনস কম বোঝে’- এই তত্ত্ব খাড়া করতে প্লেনামের শরণাপন্ন হতে ব্যস্ত ছিল! এমনভাবেই ‘জাত নয়, ভাত দিন’ বলা বামপন্থীরা যখন ফ্রি-রেশনের বিরোধিতা করে, ‘শিক্ষা-স্বাস্থ্য চাই’ বলা বামপন্থীরা যখন ফ্রি-শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাসামগ্রী প্রদান, বিনামূল্যে চিকিৎসা, ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান, স্বাস্থ্যসাথী-র মতো যুগান্তকারী প্রকল্পের বিরোধিতা করে- তখন ‘নিশ্চিন্ত’ জীবন পাওয়া গরিব, প্রান্তিক মানুষ বঙ্গীয় বামফ্রন্টকে সজোরে প্রত্যাখ্যান করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেই আসল বামপন্থীকে খুঁজে নেয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগত আক্রমণ
তখন ছোট ছিলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিরোধী পদে আসীন; দেখতাম, জ্যোতি বসুর মতো প্রবল রাজনৈতিক বিরোধীর জন্মদিনে একটা হাওয়াই চপ্পল-পরা মহিলা কেমন দিব্যি মঞ্চে গিয়ে তাঁকে নতমস্তকে প্রণাম ঠুকছেন! সরল মনে ঠাকুমা-কে জিজ্ঞেস করতাম, ‘দিদি তো এই লোকটার পার্টির বিরুদ্ধেই লড়ছে, না গো? তাহলে ওঁকে প্রণাম করছে কেন?’ হাসিমুখে ঠাকুমা উত্তর দিত, ‘কারণ মেয়েটার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’ ঠিক এভাবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখনই অসুস্থ হয়েছেন, হয় হাসপাতাল নয়তো পাম অ্যাভিনিউয়ের সেই চেনা বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন এই মেয়েটা, ব্যবস্থা করেছে তাঁর চিকিৎসার। আমার মনে আছে, এই করোনা-পরিস্থিতিতে মাস্ক না-পরায় বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুকে অনুযোগের সুরে মাস্ক পরার অনুরোধ করেছিলেন দিদিমণি। অসুস্থ কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের খবর নিয়েছেন, অসুস্থ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়দের খোঁজ নিয়েছেন বারবার।
এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নন্দীগ্রামে আহত হলেন, স্পষ্ট দেখতে পেলাম, পা বাজেভাবে ফুলে গিয়েছে। অদম্য, জেদি ওই মহিলার মুখে সেদিন যে-যন্ত্রণার ছাপ দেখেছিলাম, তা দেখে সেদিন আমার মতোই গোটা বাংলা কেঁদেছিল। কিন্তু একদল নির্লজ্জ মানুষ চোখে জল তো দূরের কথা, বরং বিদ্রুপ আর অশালীন আক্রমণে বিষাক্ত করে তুলেছিল সৌজন্যের রাজনীতির সুন্দর পরিবেশটা। কোনও কোনও বাম যুবনেতা ফেসবুকে পোস্ট করলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি নাটক করছেন! বিশ্বাস করুন, সেদিন প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, দিদি কেন ওঁদের সমস্যার দিনে ওঁদের খেঁাজ নিতে যান? দিদি কেন ওঁদের মতো হন না? দিদি কেন কারও কষ্টে বিদ্রুপ করতে পারেন না? এসব ‘কেন’-র উত্তর, ঠাকুমার সেই বক্তব্য- ‘মেয়েটার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’
শুধু নন্দীগ্রাম কেন, বিমান বসু থেকে অনিল বসু, বিনয় কোঙার থেকে আনিসুর রহমান– ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে পাওয়া যাবে এক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মহিলার প্রতি ‘তথাকথিত’ শিক্ষিত বামনেতাদের ভাষার ক্রমাগত কুৎসিত ব্যবহার। সেই কারণেই আজ যখন এই বামেদের বিধানসভায় শূন্য আসনে দেখি, বুঝতে পারি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁদের ক্ষমা করলেও গণদেবতা করেননি।
‘তৃণমূল-বিজেপি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ’
টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনায় যখন যেতাম, বামেদের প্রতিনিধিদের একটা বক্তব্য প্রায়শই শুনতে পেতাম, তৃণমূলের হাত ধরেই রাজ্যে বিজেপির প্রবেশ। কিন্তু তাঁদের যখন পালটা প্রশ্ন করতাম, প্রবল রাজীব গান্ধী-বিরোধিতায় অন্ধ হয়ে কেন শহিদ মিনার ময়দানে পরম শ্রদ্ধেয় জ্যোতি বসু অটলবিহারী বাজপেয়ী-র হাত ধরে বিপ্লব প্রদর্শন করেছিলেন- তখন তাঁদের মধ্যে এক অদ্ভুত সাইলেন্স দেখতাম! তৃণমূল একসময় বিজেপির সঙ্গে জোট করেছিল, এটাই যদি রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তের প্রধান কারণ হয়, তাহলে ঠিক কোন ফর্মুলায় ত্রিপুরায় শাসনক্ষমতায় থাকা বামেদের হাত থেকে গোটা সরকারটাই ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল বিজেপি? বামেরা বলে, ওখানে বিরোধী নেতারা বিজেপিতে গিয়েছিলেন, তাই বামেদের দোষ নেই! অথচ একই যুক্তিতে এই বাংলায় বামেদের ভোট ও নিচুতলার কর্মীদের বিজেপিতে যাওয়া কেন বিজেপির উত্থানের কারণ নয়? ত্রিপুরায় যদি শাসক বামেদের দোষ না থাকে, বাংলায় শাসক তৃণমূল কীভাবে দোষী হয়? দুটো রাজ্য নিয়ে দু’-রকমের তত্ত্ব তো চলতে পারে না কমরেড! উলটে, ত্রিপুরায় শাসনে থাকা বামেরা বিজেপিকে রুখতে না পারলেও বাংলায় শাসনে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে অনায়াসে রুখে দিয়েছেন।
বামেদের ‘আব্বাস’-প্রাপ্তি ও দিদির যাত্রাভঙ্গের চেষ্টা
বিরোধী হিসাবে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য বামেরা কখনও কংগ্রেসের পায়ে হামলে পড়েছে, কখনও হাত ধরেছে আব্বাস সিদ্দিকির মতো ‘সাম্প্রদায়িক’ (সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন ভিডিওতে প্রমাণ পাওয়া যায়) শক্তির। লোকসভার পর বামেরা ভেবেছিল, যে সাত শতাংশ ভোট এখনও অবশিষ্ট আছে, সেটাকেও বিজেপিতে পাঠানোর একমাত্র উপায় কোনও মুসলিম ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে জোট করা। উদ্দেশ্য একটাই, তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসানো এবং নিজেদের কাছে অবশিষ্ট থাকা হিন্দু ভোটটা বিজেপিতে পাঠিয়ে দেওয়া। যার ফলে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৃণমূল ও লাভবান হবে বিজেপি! আর, এটা হলেই তো কেল্লা ফতে! ‘একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম’ নিশ্চিত! কিন্তু হল উল্টোটা! সচেতন বাঙালি হিন্দু-মুসলমান জোটবদ্ধ হয়ে উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই পরাস্ত করল এবং বাংলার চিরাচরিত সম্প্রীতির ধারাকে অব্যাহত রেখে, ধর্মীয় উন্মাদনার বদলে সামগ্রিক উন্নয়নকে বেছে নিয়ে তাঁদের পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির হাওয়াই চপ্পল-পরা দিদিকে আরও বেশি ভালবাসায় ভরিয়ে দিল।
এভাবেই বামেরা ‘দিদি’-র যাত্রাভঙ্গ করতে গিয়ে কখনও নিজের নাক, কখনও কান কেটেছে রোজ। প্রতি নির্বাচনে একটা করে প্রত্যঙ্গ কাটতে কাটতে দেখুন, আজ গোটা দেহটাই ভ্যানিশ! তাই এই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসাবে সম্মাননীয় বাম নেতাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ করব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষতির চিন্তা কম করে, নিজেদের ভালর চিন্তা করুন। দেখবেন, ভবিষ্যতে শূন্য থেকে আবার ধনাত্মক দিকে যাত্রা শুরু করতে পারবেন। কারণ আমার ঠাকুমা বলত, ‘নিজের ভাল না পারো, পরের ক্ষতি চেয়ো না। ঠাকুর পাপ দেবে।’
পুনশ্চ বামেরা ঠাকুর মানে না অবশ্য।