shono
Advertisement

অজান্তেই নিয়মিত শরীরে ঢুকছে প্লাস্টিক, জানেন কী বিপদ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য?

এর থেকে বাঁচার উপায় কী? The post অজান্তেই নিয়মিত শরীরে ঢুকছে প্লাস্টিক, জানেন কী বিপদ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য? appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 09:12 PM Nov 02, 2019Updated: 09:12 PM Nov 02, 2019

দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গী প্লাস্টিক। ভয়ংকর অভিশাপ হয়েই সভ্যতার শিরায়-উপশিরায় ভেসে বেড়াচ্ছে এই ন্যানো প্লাস্টিক। বিশ্বময় গবেষণা চলছে। সেই সব নিয়েই কথা বললেন সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর এনভায়রনমেন্টের অভিকর্তা দীপায়ন দে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন গৌতম ব্রহ্ম।

Advertisement

মাসে দেড়শো গ্রামের বেশি প্লাস্টিক ঢুকছে আমাদের শরীরে। বারোটা বাজাচ্ছে স্বাস্থ্যের। বিশ্বাস না হলে আবার পড়ুন! কখনও থাইরয়েডের মতো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর কাজকর্মে বিপর্যয় আনছে। আবার কখনও প্লাস্টিকের বিষ অকেজো করে ফেলছে ফুসফুস, ক্ষুদ্রান্ত্র। সম্প্রতি বারাকপুরের ‘সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এই ভয়ংকর তথ্য প্রকাশ্যে এনে হইচই ফেলে দিয়েছে।

সত্যিই ভয়ংকর! কারণ, এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক বা মাইক্রো প্লাস্টিককে আলাদা করার কোনও ফিল্টার এখনও পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেনি বিজ্ঞান। ভয়ংকর অভিশাপ হয়েই সভ্যতার শিরা-উপশিরায় ভেসে বেড়াচ্ছে এই ন্যানো প্লাস্টিক। বিশ্বময় গবেষণা চলছে। এর উৎস কী? কেউ বলছেন, পেট জার, কেউ বলছেন ক্যারি ব্যাগ। কেউ বলছেন মাটিতে মিশে থাকা প্লাস্টিক। কলকাতার বাতাসে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি এখনও সেভাবে ধরা পড়েনি। তবে জলে এই বিষের উপস্থিতি প্রমাণিত। ‘সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর রিপোর্ট বলছে, কলকাতার পানীয় জলে মাইক্রো প্লাস্টিক ভয়ংকর মাত্রায় মিশে আছে। হিসাব বলছে, একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৫ গ্রাম মানে, মাসে প্রায় দেড়শো গ্রাম মাইক্রো প্লাস্টিক খাচ্ছে। প্রায় ৭৫ হাজার প্লাস্টিক কণা শরীরে ঢুকছে। কোনও ফিল্টারের ক্ষমতা নেই এই বিষকে আলাদা করে ছেঁকে দেওয়ার। রক্তে বিষাক্ত কিছু মিশলে তা যাতে ব্রেনে পৌঁছতে না পারে, তার জন্য ‘ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার’(বিবিবি)বড় ভূমিকা নেয়। প্রসূতির শরীরে ঢোকা কোনও অ্যান্টিবায়োটিক যাতে ভ্রূণের ক্ষতি করতে না পারে, তার জন্যও বিবিবি কাজ করে। বিবিবি-কে তাই ব্রেন এবং প্লাসেন্টার পাহারাদার বলা হয়। এই মাইক্রো প্লাস্টিক এত সংঘাতিক যে, বিবিবি-ও আটকাতে পারে না। এই কারণেই মাইক্রো প্লাস্টিক নিয়ে এত মাথাব্যথা। বিশ্বজুড়ে হইচই।

তাহলে কি প্লাস্টিককে সমাজ-সভ্যতা থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে? বিশেষজ্ঞরা কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন প্লাস্টিক ব্যবহারকারীদের। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, প্লাস্টিকের কোনও দোষ নেই। এটি সস্তা। কিছু ক্ষেত্রে বিকল্প নেই। ‘এমিশন ফুটপ্রিন্ট’ কাপড় বা কাগজের থেকে অনেক কম। আসল খলনায়ক প্লাস্টিকের অবৈজ্ঞানিক ‘ডিসপোজাল’। সেই কারণেই বিভিন্ন পুনঃচক্রায়িত পদার্থের সঙ্গে প্লাস্টিক ব্যবহারের চেষ্টা শুরু হয়েছে। তবে অনুতাপের বিষয়, মাইক্রো প্লাস্টিক নিয়ে ভারতে কোথাও তেমন কোনও কাজ এখনও শুরু হয়নি। সত্যেন্দ্রনাথ বোস ল্যাবরেটরির সঙ্গে জুটি বেঁধে একটি ‘সেন্সর’ তৈরির চেষ্টা করছে ‘সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর এনভায়রনমেন্ট’ (সেফ), যা জলে মিশে থাকা মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি জানান দেবে। মাস চারেক হল প্রকল্পটি শুরু হয়েছে। গবেষণার অগ্রগতি সন্তোষজনক। সফল হলে মাইক্রো প্লাস্টিকের উৎস নিয়ে ধোঁয়াশা অনেকটাই কাটবে। বর্তমানে ‘রমণ স্পেকটোমেট্রি’ দিয়ে মাইক্রো প্লাস্টিককে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু জল থেকে এই বিষকে আলাদা করার তেমন কোনও প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি। সমুদ্র উপকূলে সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্র বসিয়ে মাইক্রো প্লাস্টিক আলাদা করার একটা চেষ্টা অবশ্য শুরু করেছে জার্মানি।

আসলে মাইক্রো প্লাস্টিক হল ন্যানো পার্টিকল। খালি চোখে দেখা যায় না। প্লাস্টিক গলে না ঠিকই, কিন্তু প্লাস্টিক ভঙ্গুর। ভাঙতে ভাঙতে ন্যানো পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমনই পর্যবেক্ষণ বিশেষজ্ঞদের। মাইক্রো প্লাস্টিক শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। গবেষণায় দ্যাখা গিয়েছে, মিউকাস মেমব্রেন বা ঝিল্লিতে আটকে গিয়ে বিরাট বিপদ ডেকে আনতে পারে মাইক্রো প্লাস্টিক। প্রথমে ‘ইরিটেশন’ তৈরি করবে। তারপর টিউমার। যা ম্যালিগন্যান্টও হতে পারে। যদি হাওয়ায় মাইক্রো প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফুসফুস। ‘লাং কনজেশন’ হতে পারে। অথচ কোনও প্যাথোলজিক্যাল পরীক্ষায় ধরা পড়বে না। হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখে বুঝতে হবে। মাইক্রো প্লাস্টিক যদি আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছে যায়, তাহলে মাইক্রো ভিলাইয়ের খাদ্যশোষক ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেবে। যা খাবে, তা-ই বদহজম হয়ে যাবে। রোগ নির্ণয় করতে না পেরে ডাক্তারবাবু ভুল চিকিৎসা করবেন। কেউ ক্যানসারের, কেউ অ্যালার্জির। এমন অনেক ঘটনাই প্রকাশ্যে এসেছে। জানা গিয়েছে, মাইক্রো প্লাস্টিক আমাদের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দিচ্ছে। বিশেষ করে থাইরয়েডের গ্রন্থির বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।

[আরও পড়ুন: সাবধান! অতিরিক্ত ধূমপানে ক‌্যানসার বাসা বাঁধতে পারে কিডনিতেও]

২০০৪ সালে প্লাইমাউড বিশ্ববিদ্যালয় ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আন্টার্কটিকার সমুদ্রে মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে। যদিও মাইক্রো প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক প্রভাব প্রকাশ্যে আনে ‘নেচার’ পত্রিকা, বছর পাঁচেক আগে। জার্মানি এই নিয়ে প্রথম গবেষণা করে। ওরাই প্রথম আবিষ্কার করে, সমুদ্রের জলে থাকা মাইক্রো প্লাস্টিক ‘ফ্রেশ ওয়াটার’-এ থাকা মাইক্রো প্লাস্টিকের থেকে আলাদা। মাইক্রো প্লাস্টিক নিয়ে কেন্দ্রের ঘুম একটু দেরিতে ভেঙেছে। ‘সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড’ গত বছর মাইক্রো প্লাস্টিককে দূষণের অন্যতম উপাদান হিসাবে মান্যতা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মত, ব্যবহার হওয়া প্লাস্টিক কবে থেকে মাইক্রো প্লাস্টিক উৎপাদন শুরু করবে, তা অবশ্যই জানা উচিত। জাপান এই নিয়ে কাজ শুরু করেছে। ‘হাই ডেনসিটি প্লাস্টিক’ বা এইচডিপি ‘ডিসপোজাল’-এর সুন্দর ব্যবস্থা করেছে। এদেশেও চালু হওয়া উচিত। প্লাস্টিক-খেকো ব্যাকটিরিয়াকেও কাজে লাগানো যেতে পারে। উল্লেখ্য, প্লাস্টিকে থাকা পলি কার্বনিক শৃঙ্খলকে ভেঙে প্লাস্টিক পচাতে পারে সিউডোমোনাস জাতীয় ব্যাকটিরিয়া। রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে এই নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। তবে প্লাস্টিক নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট কেন্দ্রীয় নীতি এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ফলে, প্লাস্টিক ঠেকানোর চেষ্টাও সার্বিক হয়ে উঠছে না এদেশে।

সবচেয়ে মাথাব্যথা পানীয় জল নিয়ে। এদেশে পানীয় জল ফিল্টার করা হয় ‘রিভার্স অসমোসিস’ পদ্ধতিতে। দিল্লির একটি রিপোর্টে জানা গিয়েছে, বোতলবন্দি জলেও মাইক্রো প্লাস্টিক মিশে আছে। আসলে আমরা প্লাস্টিকে ঘিরে আছি। চোখ বন্ধ করে তিনটে জিনিসে হাত দিলে দেখা যাবে, দুটোই প্লাস্টিকের। প্লাস্টিকের বোতলের জন্যই শরীরে ৫ গ্রাম করে মাইক্রো প্লাস্টিক ঢুকছে, এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। বিশেষজ্ঞদের প্রেসক্রিপশন, জলের বোতল খোলার আগে অবশ্যই তার ‘সেলফ লাইফ’ দেখে নেওয়া উচিত। কারণ, যে কোনও প্লাস্টিক একটা সময় পরে মাইক্রো প্লাস্টিক উৎপাদন শুরু করে। তাই নির্দিষ্ট সময় অন্তর জল পরিবহণের পিভিসি পাইপও বদলানো দরকার। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, আগে প্লাম্বাররা লোহার জিআই পাইপ ব্যবহার করতেন। খরচ কমানোর জন্য এবং লেড সংক্রমণ ঠেকাতে এখন পিভিসির পাইপ ব্যবহার হয়। একটা সময় পর প্লাস্টিক পাইপ মাইক্রো প্লাস্টিক তৈরি করতে শুরু করে। একটা শত্রুকে আটকাতে গিয়ে আরও বড় শত্রুকে ডেকে এনেছি।

কলকাতা, বিধাননগর ও রাজপুর-সোনারপুর এই তিন পুরসভাতেই প্লাস্টিক পুনঃচক্রায়নের ভাল কাজ হচ্ছে। যদিও অসুখ অনেকটাই ডালপালা মেলেছে। কলকাতা ও সংলগ্ন পুর এলাকাগুলির কঠিন বর্জ্যের ২৮ থেকে ৩৫ শতাংশ প্লাস্টিক। কঠিন বর্জ্যের পাওয়া প্লাস্টিকের বেশির ভাগই ড্রেন ও লকগেটের ছাঁকনি থেকে উদ্ধার হওয়া। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৯ হাজার কেজি প্লাস্টিক জড়ো হচ্ছে শুধু পূর্ব কলকাতার জলাজমি এলাকায়। এটা ম্যাক্রো প্লাস্টিকের হিসাব। ৫ মিমির ওপরে থাকা সব প্লাস্টিকই ম্যাক্রো। নীচে হলে মাইক্রো। যে কোনও ক্যারি ব্যাগ ও জলের বোতল ম্যাক্রো পর্যায়ভুক্ত। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ব্যানার-পোস্টারের একটা বড় অংশ রয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য। বর্জ্য হয়ে যাওয়া মোট প্লাস্টিকের ৭০-৮০ শতাংশ এই তিন ধরনের। অর্থাৎ, পলিব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতল এবং ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুন।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্লাস্টিক বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। রাজপুর-সোনারপুরে কাপড়ের ব্যাগ বিলি করা হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ না হলে ব্যবহার বন্ধ হবে কীভাবে? মাছ-মাংস যে প্লাস্টিকে ভরে বাড়ি আসছে তাতেও তো বিষ মিশছে! অনেকেই প্লাস্টিকের বোতলে চা আনেন, ওই চা খাওয়া বিষপানের সমতুল্য! আসলে গরমে প্লাস্টিক যে যৌগ তৈরি করে, তা মাইক্রো প্লাস্টিকের থেকেও বিপজ্জনক। অনেকেই এখন তামার বোতল ব্যবহার করছেন। কাচ, মাটি, কাঠের উপকরণ ফিরিয়ে আনার দাবি জোরদার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মত, ফিডিং বোতল কাচের হোক। জল পরিবহণে লোহার পাইপ ব্যবহার হোক। তবে সবার আগে নিষিদ্ধ হোক প্লাস্টিকের পেট জার ও ক্যারি ব্যাগ।

The post অজান্তেই নিয়মিত শরীরে ঢুকছে প্লাস্টিক, জানেন কী বিপদ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য? appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement