দেবব্রত মণ্ডল, বারুইপুর: শম্পা সর্দার (নাম পরিবর্তিত)। বাসন্তী থানার চড়বিদ্যা ৫ নম্বর এলাকার দশম শ্রেণীর ছাত্রী সে। এবছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। পাশের পাড়ার একটি ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয় বেশ কয়েকদিন ধরে। তারপর একদিন টিউশন পড়তে গিয়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ। নভেম্বর মাসে যেদিন মেয়েটি বাড়ি থেকে চলে যায়, ঠিক তার একদিন পরে চলে গেল পাশের পাড়ার ছেলেটা। নাম প্রসেনজিৎ সর্দার। ঘটনার পর এলাকায় জানাজানি হল তাদের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু গত ৩ মাস হয়ে গেল সেই মেয়েটির সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগ করতে পারেনি তার পরিবারের লোকজন। বিভিন্ন সময় থানা পুলিশ, রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সকলকে জানানো হয়েছে মেয়েটি উদ্ধারের জন্য। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
বাবা বাবলু সর্দারের অভিযোগ, তাঁর মেয়েকে হয়ত বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে ভিনরাজ্যে। আর্থিক স্বচ্ছলতাও নেই। তাই তাঁদের কথায় কেউ কান দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার সভাও বসে। কিন্তু উদ্ধার করা যায়নি তাঁর মেয়েকে। শম্পা সর্দার শুধু একটি উদাহরণ মাত্র। করোনা পরিস্থিতিতে বহু ছাত্রছাত্রীই এখন স্কুলছুট। বহু ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে নির্দিষ্ট বয়সের আগেও। কেউবা বাবা-মার সঙ্গে ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে সেখানেই প্রেম করে বিয়েও করে নিয়েছে। আর বিয়ের পর খুব সহজেই পাচার করা সম্ভব হচ্ছে। গত কয়েকদিন আগে সুন্দরবন উপকূলীয় থানার এবং জীবনতলা থানার পুলিশ উদ্ধার করেছে ২ নাবালিকাকে। একজনকে উদ্ধার করা হয় তামিলনাডু থেকে। অন্য জনকে উদ্ধার করা হয়েছে তেলেঙ্গানা থেকে। বর্তমানে দুই নাবালিকা এখন হোমে।
[আরও পড়ুন: ‘তালিবান মনে করে আমার শরীরটাও ওদের’, বিস্ফোরক দাবি একমাত্র আফগান পর্ন তারকার]
তদন্তকারী আধিকারিকরা জানিয়েছেন, মূলত এলাকা থেকে কখনও কাজের সন্ধানে আবার কখনও প্রেমের টানে তারা চলে যায় ভিন রাজ্যে। কখনও চেন্নাই, কখনও বেঙ্গালুরু, কখনও দিল্লি, কখনও আবার মহারাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে কেউ কেউ হাতবদল হয়ে বিক্রি হয়ে যায়। কেউ আবার দেহব্যবসায় নাম লেখাচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশ কয়েকজন পাচার হওয়ার কিশোরী বা তরুণীকে উদ্ধার করা হয়েছে। আর এই উদ্ধারে পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন। উদ্ধারকারী সংগঠনের সদস্য আমিনা খাতুন লস্কর বলেন, “মানুষের অভাব বেড়েছে। আর একটা বয়সের পর মেয়েদের বাড়িতে কাজের জন্য চাপ দিচ্ছে। শুধু তাই নয় কখনও কখনও সম্পর্ক তৈরি করে স্রেফ প্রেমের টানে তাঁরা চলে যাচ্ছেন বিভিন্ন রাজ্যে। পাচার হয়ে যাচ্ছেন।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী, গোসাবা, জীবনতলা, বারুইপুর, কুলতলি, জয়নগর, ভাঙড়, লক্ষীকান্তপুর, নামখানা ও পাথরপ্রতিমা – এই সমস্ত এলাকা থেকেই সবথেকে বেশি পাচারের ঘটনাগুলি ঘটছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, গত দু’বছরে ৫৭ জন উদ্ধার হয়েছেন। প্রত্যেকেই সুন্দরবনের বাসিন্দা। এখনও ওই এলাকায় নিখোঁজ অন্তত শতাধিক। জেলার এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, “আমরা বিভিন্নভাবে অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। সচেতনতামূলক ব্যবস্থার জন্য ট্যাবলো, ব্যানার, ফেস্টুনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নাটকের মাধ্যমেও পুরো বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। অভিভাবকরা সচেতন না হলে সমাজের এই ব্যাধি কখনই সমাজ থেকে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়।”