সুতীর্থ চক্রবর্তী: সল্টলেকের একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ঘটনা৷ স্কুলের সময়ই উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী উল্টোদিকের পার্কে পাঁচিলের এককোণে ঝোপঝাড়ের মধ্যে মদ খেতে গিয়ে ধরা পড়ে৷ এই ছাত্র-ছাত্রীদের দল যে প্রায়শই স্কুল থেকে দশ মিটার দূরে এই পার্কের পাঁচিলের আড়ালে মদের আসর বসাচ্ছে, সেই অভিযোগ এসেছিল সংশ্লিষ্ট ব্লকের আবাসিকদের কাছ থেকেই৷ ঘটনাটি গোপনই রাখে স্কুল কর্তৃপক্ষ৷ কিছু অভিভাবক বিষয়টি জেনে যাওয়ায় স্কুলের এক সভায় প্রসঙ্গটি ওঠে৷ অভিভাবকদের সমালোচনার জবাবে স্কুলের প্রধান-সহ অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা স্কুলের বাইরের ঘটনা বলে প্রাথমিকভাবে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করেন৷ সভায় প্রশ্ন ওঠে, এবার উল্টোদিকের পার্কেও কি স্কুলের দারোয়ান বসাতে হবে?
প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল, কীভাবে কতিপয় ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের উল্টোদিকের পার্কে গিয়ে মদ্যপানের সাহস পায়? কোন গভীর সামাজিক অবক্ষয় থেকে এই ঘটনা ঘটতে পারে? কী মূল্যবোধের শিক্ষা এই তথাকথিত নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলটি তার ছাত্রী-ছাত্রীদের মধ্যে চারিত করতে পারল, যা তাদের স্কুলের সময় মদ্যপানের মতো অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারছে না?
অভিভাবকদের ওই সভায় এই ধরনের গভীরতর প্রশ্নগুলি স্বাভাবিকভাবেই উত্থাপিত হয়নি৷ স্কুলের শৃঙ্খলা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ছোটখাটো কয়েকটি পদক্ষেপের বিষয় নিয়ে আলোচনার পর ঘটনাটি চিরতরে ধামাচাপা পড়ে যায়৷ আজকে যখন স্ন্যাপচ্যাটের দৌলতে সানি পার্কের ফ্ল্যাটের পার্টিতে অংশ নেওয়া কোনও এক কিশোর ছাত্রের তিনটি ফ্লেভার্ড ভদকার বোতল হাতে নিয়ে ছবি প্রকাশ্যে চলে এসেছে, তখন অনেকেই আতঙ্কে শিউরে উঠছেন৷ এমনকী, কলকাতা পুলিশের কর্তারাও এমন ছবি দেখে বিস্মিত৷ কিন্তু কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যের অসংখ্য তথাকথিত নামী স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই ঘটনা জলভাতের মতো৷ ‘সারপ্রাইজ পার্টি’, মদ্যপান, কথায় কথায় রেস্তোরাঁ বা বার-এ যাওয়া, এইসব কার্যত রুটিনের মধ্যেই৷
আমাদের স্কুলজীবনেও আমরা সেইসব শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষককে পেয়েছি যাঁরা স্কুলের প্রার্থনার সময় থেকে ছুটি পর্যন্ত বেত হাতে গোটা স্কুল চক্কর মেরে বেড়াতেন৷ ছাত্রজীবনে যে কয়েকটা বেতের ঘা গায়ে-পিঠে পড়েনি, তেমন নয়৷ কিন্তু এতে করে আমাদের কোমল হৃদয় যে সাঙঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তেমন নয়৷ বরং স্কুলের সেইসব শিক্ষকদের দেখলে আজও শ্রামিশ্রিত সমীহ জাগে৷ ছাত্রদের কোমল হৃদয়কে সুরক্ষিত রাখতে স্কুলে বেত মারা নিষিদ্ধ হয়েছে৷ সেটাও মেনে নেওয়া যায়৷ কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হেলায় অগ্রাহ্য করার মতো সাহস আজ ছাত্র-ছাত্রীরা কোথা থেকে অর্জন করে তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে৷ নিঃসন্দেহে এই রোগে কলকাতা বা রাজ্যের সব স্কুল আক্রান্ত নয়৷ বহু স্কুল আজও ছাত্র-ছাত্রীদের আদর্শ শিক্ষা পৌঁছে দেয়৷ তবে যে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ইউনিফর্ম পরে উল্টোদিকের পার্কে গিয়ে মদ্যপান করতে ভয় পায় না, সেই নামী স্কুলের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই৷ প্রশ্ন উঠবেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা নিয়েও৷
ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও আচরণগত সমস্যাটি শুধু অভিভাবকদের উপর ছেড়ে দিলে মনে হয় কোথাও ভুল হবে৷ ছেলেমেয়েদের হাতে অতিরিক্ত টাকা চলে আসাটাও মনে হয় সমস্যার একমাত্র কারণ নয়৷ ছোটবেলায় তো দেখেছি, যে বন্ধুর হাতে টাকা রয়েছে সে নিজের পছন্দমতো গল্পের বই কিনতে পারছে৷ আজ আমাদের সন্তানদের হাতে গল্পের বই তুলে দিলেও সে সেটা পাশে সরিয়ে রাখে৷ এখনও মনে আছে, ছাত্রাবস্থায় বুধ ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়িতে টিভি বন্ধ থাকত৷ কারণ ওই দু’দিন দূরদর্শনে ‘চিত্রমালা’ ও ‘চিত্রহার’ হত৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেও যা দেখার অনুমতি ছিল না৷ উঁচু ক্লাসে উঠেও ‘বিবিধ ভারতী’ শুনতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে বকুনি খেতে হত৷ এখন সন্তানের স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে দেখি চটুল ফিল্মি গানের সঙ্গে নাচ হচ্ছে৷ শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তা তারিয়ে তারিয়ে
উপভোগ করছেন৷ তাহলে বাড়িতে ছেলেকে টিভিতে ‘লুঙ্গি ডান্স’ দেখা থেকে বিরত করব কীভাবে?
যে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় গ্রাস করেছে সমস্ত সমাজকে, তার সব চেয়ে বড় শিকার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের স্কুলগুলি৷ বড় শহরে সরকার পরিপোষিত অধিকাংশ বাংলামাধ্যম স্কুলের প্রায় উঠে যাওয়ার দশা৷ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলির শিক্ষার এই ভয়াবহ মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক সংকট৷ ‘স্ট্রিট স্মার্ট’ ছাত্র তৈরির নামে চলছে বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা৷ সর্বভারতীয় বোর্ডের রেজাল্টের ভিত্তিতে অনেক স্কুল নামী বলেও বিবেচিত হচ্ছে৷ যদিও আধুনিক সিলেবাসের নাম করে লেখাপড়া এসে ঠেকেছে অসংখ্য টিক চিহ্ন মারায় ও কিছু প্রযুক্তি শিক্ষায়৷ এইসব স্কুলের অনুষ্ঠানে গেলে ভয় হয়৷ বুক কাঁপে৷ কোথায় আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, সুকান্ত, জীবনানন্দ? কোথায় ঘনাদা, ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুরা? কোন পোকেমনের হাতছানিতে তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানদের শৈশব! আবেশের পরিণতি দেখে আজ আমরা সত্যিই আতঙ্কিত৷ আবেশের মুখেই নিজের সন্তানের মুখ দেখছি, আর ভাবছি কেন হারিয়ে গেল প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের পাঠশালাগুলো৷ ব্রিটিশ শিক্ষাপতি থেকে মার্কিন শিক্ষার মডেলে উপনীত হয়েছি আমরা৷ কিন্তু মনে হয়, প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের ওই পাঠশালাগুলোই যেন অব্যর্থ ছিল৷ আসলে মূল্যবোধের শিক্ষাটাই যে সব চেয়ে বড় শিক্ষা, সেই উপলব্ধিতে পৌঁছনো প্রয়োজন৷ আর এইসব তথাকথিত নামী বেসরকারি স্কুলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবার সরকারি হস্তক্ষেপও মনে হয় জরুরি হয়ে পড়ছে৷ ছেলেমেয়েদের বিদেশি শিক্ষা দেওয়ার নাম করে যা খুশি তাই করা চলবে না, এটা স্কুলগুলিরও বোঝার প্রয়োজন রয়েছে৷
The post আবেশের মুখেই নিজের সন্তানের মুখ দেখছি appeared first on Sangbad Pratidin.