shono
Advertisement

আবেশের মুখেই নিজের সন্তানের মুখ দেখছি

প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল, কীভাবে কতিপয় ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের উল্টোদিকের পার্কে গিয়ে মদ্যপানের সাহস পায়? কোন গভীর সামাজিক অবক্ষয় থেকে এই ঘটনা ঘটতে পারে? কী মূল্যবোধের শিক্ষা এই তথাকথিত নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলটি তার ছাত্রী-ছাত্রীদের মধ্যে চারিত করতে পারল, যা তাদের স্কুলের সময় মদ্যপানের মতো অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারছে না? The post আবেশের মুখেই নিজের সন্তানের মুখ দেখছি appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 08:02 PM Jul 26, 2016Updated: 02:32 PM Jul 26, 2016

সুতীর্থ চক্রবর্তী: সল্টলেকের একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ঘটনা৷ স্কুলের সময়ই উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী উল্টোদিকের পার্কে পাঁচিলের এককোণে ঝোপঝাড়ের মধ্যে মদ খেতে গিয়ে ধরা পড়ে৷ এই ছাত্র-ছাত্রীদের দল যে প্রায়শই স্কুল থেকে দশ মিটার দূরে এই পার্কের পাঁচিলের আড়ালে মদের আসর বসাচ্ছে, সেই অভিযোগ এসেছিল সংশ্লিষ্ট ব্লকের আবাসিকদের কাছ থেকেই৷ ঘটনাটি গোপনই রাখে স্কুল কর্তৃপক্ষ৷ কিছু অভিভাবক বিষয়টি জেনে যাওয়ায় স্কুলের এক সভায় প্রসঙ্গটি ওঠে৷ অভিভাবকদের সমালোচনার জবাবে স্কুলের প্রধান-সহ অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা স্কুলের বাইরের ঘটনা বলে প্রাথমিকভাবে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করেন৷ সভায় প্রশ্ন ওঠে, এবার উল্টোদিকের পার্কেও কি স্কুলের দারোয়ান বসাতে হবে?

Advertisement

প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল, কীভাবে কতিপয় ছাত্র-ছাত্রী স্কুলের উল্টোদিকের পার্কে গিয়ে মদ্যপানের সাহস পায়? কোন গভীর সামাজিক অবক্ষয় থেকে এই ঘটনা ঘটতে পারে? কী মূল্যবোধের শিক্ষা এই তথাকথিত নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলটি তার ছাত্রী-ছাত্রীদের মধ্যে চারিত করতে পারল, যা তাদের স্কুলের সময় মদ্যপানের মতো অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারছে না?

অভিভাবকদের ওই সভায় এই ধরনের গভীরতর প্রশ্নগুলি স্বাভাবিকভাবেই উত্থাপিত হয়নি৷ স্কুলের শৃঙ্খলা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ছোটখাটো কয়েকটি পদক্ষেপের বিষয় নিয়ে আলোচনার পর ঘটনাটি চিরতরে ধামাচাপা পড়ে যায়৷ আজকে যখন স্ন্যাপচ্যাটের দৌলতে সানি পার্কের ফ্ল্যাটের পার্টিতে অংশ নেওয়া কোনও এক কিশোর ছাত্রের তিনটি ফ্লেভার্ড ভদকার বোতল হাতে নিয়ে ছবি প্রকাশ্যে চলে এসেছে, তখন অনেকেই আতঙ্কে শিউরে উঠছেন৷ এমনকী, কলকাতা পুলিশের কর্তারাও এমন ছবি দেখে বিস্মিত৷ কিন্তু কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যের অসংখ্য তথাকথিত নামী স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই ঘটনা জলভাতের মতো৷ ‘সারপ্রাইজ পার্টি’, মদ্যপান, কথায় কথায় রেস্তোরাঁ বা বার-এ যাওয়া, এইসব কার্যত রুটিনের মধ্যেই৷

আমাদের স্কুলজীবনেও আমরা সেইসব শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষককে পেয়েছি যাঁরা স্কুলের প্রার্থনার সময় থেকে ছুটি পর্যন্ত বেত হাতে গোটা স্কুল চক্কর মেরে বেড়াতেন৷ ছাত্রজীবনে যে কয়েকটা বেতের ঘা গায়ে-পিঠে পড়েনি, তেমন নয়৷ কিন্তু এতে করে আমাদের কোমল হৃদয় যে সাঙঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তেমন নয়৷ বরং স্কুলের সেইসব শিক্ষকদের দেখলে আজও শ্রামিশ্রিত সমীহ জাগে৷ ছাত্রদের কোমল হৃদয়কে সুরক্ষিত রাখতে স্কুলে বেত মারা নিষিদ্ধ হয়েছে৷ সেটাও মেনে নেওয়া যায়৷ কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হেলায় অগ্রাহ্য করার মতো সাহস আজ ছাত্র-ছাত্রীরা কোথা থেকে অর্জন করে তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে৷ নিঃসন্দেহে এই রোগে কলকাতা বা রাজ্যের সব স্কুল আক্রান্ত নয়৷ বহু স্কুল আজও ছাত্র-ছাত্রীদের আদর্শ শিক্ষা পৌঁছে দেয়৷ তবে যে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ইউনিফর্ম পরে উল্টোদিকের পার্কে গিয়ে মদ্যপান করতে ভয় পায় না, সেই নামী স্কুলের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই৷ প্রশ্ন উঠবেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা নিয়েও৷

ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও আচরণগত সমস্যাটি শুধু অভিভাবকদের উপর ছেড়ে দিলে মনে হয় কোথাও ভুল হবে৷ ছেলেমেয়েদের হাতে অতিরিক্ত টাকা চলে আসাটাও মনে হয় সমস্যার একমাত্র কারণ নয়৷ ছোটবেলায় তো দেখেছি, যে বন্ধুর হাতে টাকা রয়েছে সে নিজের পছন্দমতো গল্পের বই কিনতে পারছে৷ আজ আমাদের সন্তানদের হাতে গল্পের বই তুলে দিলেও সে সেটা পাশে সরিয়ে রাখে৷ এখনও মনে আছে, ছাত্রাবস্থায় বুধ ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়িতে টিভি বন্ধ থাকত৷ কারণ ওই দু’দিন দূরদর্শনে ‘চিত্রমালা’ ও ‘চিত্রহার’ হত৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেও যা দেখার অনুমতি ছিল না৷ উঁচু ক্লাসে উঠেও ‘বিবিধ ভারতী’ শুনতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে বকুনি খেতে হত৷ এখন সন্তানের স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে দেখি চটুল ফিল্মি গানের সঙ্গে নাচ হচ্ছে৷ শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তা তারিয়ে তারিয়ে

উপভোগ করছেন৷ তাহলে বাড়িতে ছেলেকে টিভিতে ‘লুঙ্গি ডান্স’ দেখা থেকে বিরত করব কীভাবে?

যে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় গ্রাস করেছে সমস্ত সমাজকে, তার সব চেয়ে বড় শিকার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের স্কুলগুলি৷ বড় শহরে সরকার পরিপোষিত অধিকাংশ বাংলামাধ্যম স্কুলের প্রায় উঠে যাওয়ার দশা৷ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলির শিক্ষার এই ভয়াবহ মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক সংকট৷ ‘স্ট্রিট স্মার্ট’ ছাত্র তৈরির নামে চলছে বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা৷ সর্বভারতীয় বোর্ডের রেজাল্টের ভিত্তিতে অনেক স্কুল নামী বলেও বিবেচিত হচ্ছে৷ যদিও আধুনিক সিলেবাসের নাম করে লেখাপড়া এসে ঠেকেছে অসংখ্য টিক চিহ্ন মারায় ও কিছু প্রযুক্তি শিক্ষায়৷ এইসব স্কুলের অনুষ্ঠানে গেলে ভয় হয়৷ বুক কাঁপে৷ কোথায় আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, সুকান্ত, জীবনানন্দ? কোথায় ঘনাদা, ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুরা? কোন পোকেমনের হাতছানিতে তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তানদের শৈশব! আবেশের পরিণতি দেখে আজ আমরা সত্যিই আতঙ্কিত৷ আবেশের মুখেই নিজের সন্তানের মুখ দেখছি, আর ভাবছি কেন হারিয়ে গেল প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের পাঠশালাগুলো৷ ব্রিটিশ শিক্ষাপতি থেকে মার্কিন শিক্ষার মডেলে উপনীত হয়েছি আমরা৷ কিন্তু মনে হয়, প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের ওই পাঠশালাগুলোই যেন অব্যর্থ ছিল৷ আসলে মূল্যবোধের শিক্ষাটাই যে সব চেয়ে বড় শিক্ষা, সেই উপলব্ধিতে পৌঁছনো প্রয়োজন৷ আর এইসব তথাকথিত নামী বেসরকারি স্কুলগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবার সরকারি হস্তক্ষেপও মনে হয় জরুরি হয়ে পড়ছে৷ ছেলেমেয়েদের বিদেশি শিক্ষা দেওয়ার নাম করে যা খুশি তাই করা চলবে না, এটা স্কুলগুলিরও বোঝার প্রয়োজন রয়েছে৷

The post আবেশের মুখেই নিজের সন্তানের মুখ দেখছি appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement