রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: প্রখর ক্রিকেটবোধ আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) আজও অদ্বিতীয়। গোয়েন্দাগিরিতে একটা বহুল প্রচারিত এক শব্দ আছে–ডিডাকশন। নিগুঢ় অর্থ হল, যা তুমি দেখছ, শুনছো, তার অনুপাতে তোমার বিচার, তোমার রায়। আর তাতে তুমি কতটা নিখুঁত, কতটা নির্ভুল, তার উপর নির্ভর করে তোমার দর! সময়-সময় মনে হয়, ক্রিকেটীয় ‘ডিডাকশনে’ বঙ্গসন্তান প্রদোষ মিত্তিরের সমতুল্য বিশেষ। মন-মেজাজ প্রসন্ন থাকলে যা বলেন-টলেন, যে নিদান দেন, লিখে রাখার মতো। অক্ষরে-অক্ষরে যা অনুসরণ করলেই চলবে। আলাদা করে কোচের প্রয়োজন পড়ে না!
এই যেমন, রোববারের চিপকে ভারত-অস্ট্রেলিয়া (India vs Australia) মহাযুদ্ধ নিয়ে যে নিদান দিলেন। সেই মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে যা যা বললেন। যতই দেশের মাটিতে গত সিরিজে হলুদ জার্সিধারীদের রোহিত শর্মারা দাবড়ে দিন, বিশ্বজয়-অভিযানের প্রচ্ছদে কে আর শখ করে তাদের খেলতে চায়? আহা, স্টিভ ওয়ার না হোক, রিকি পন্টিংয়ের না হোক, দেশটার নাম অস্ট্রেলিয়া তো!
[আরও পড়ুন: Asian Games 2023: ভারতের একশো পদক জয়! সফল অ্যাথলিটদের সঙ্গে দেখা করবেন প্রধানমন্ত্রী মোদি]
ওয়ান ডে ক্রিকেটে পাঁচ বারের বিশ্বজয়ী তো! আসমুদ্রহিমাচলের হৃদয় কাঁপবে না এরপর? আশঙ্কার তড়িৎপ্রবাহ বইবে না? সৌরভ, স্টিভ-পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়ার মহড়া নেওয়া ভারত অধিনায়ক, ক্রিকেটজীবনে ও সমস্ত নেকুপুষু আশঙ্কার আশপাশ দিয়ে যাননি কখনও, এখনও যান না। ‘‘আরে, বিশ্বকাপে কি দ্বিতীয় ডিভিশনের টিম পাওয়া যাবে নাকি? বিশ্বকাপে সব টিমই ভাল, সব টিমই তৈরি। আজ না হোক কাল, খেলতে তো হবে অস্ট্রেলিয়াকে,’’ ফুৎকারে প্রশ্ন উড়িয়ে বরং ‘দাওয়াই’ লিখতে বসে যান। লিখে ফেলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিনের নাম। বলে ফেলেন, মহম্মদ সামির নাম।
রবিবাসরীয় চিপকে ভারত কোন টিম নামাবে, সময় বলবে। কিন্তু সৌরভ বলছেন, এই দু’জনকে রাখতে। ফার্স্ট ইলেভেনে। ‘‘অশ্বিন খেললে টিমে বৈচিত্র বাড়বে। মনে রাখা দরকার যে, অস্ট্রেলিয়া টিমে জনা কয়েক বাঁ হাতি ব্যাটার আছে। ডেভিড ওয়ার্নার। অ্যালেক্স ক্যারি। তা ছাড়া স্টিভ স্মিথ কিংবা মারনাস লাবুশেনকেও বিপাকে ফেলার ক্ষমতা রাখে অশ্বিন। আর পেসারদের মধ্যে সামি মাস্ট। মাস্ট মানে, মাস্ট। তিন পেসার খেলালে, বুমরা-সিরাজের সঙ্গে সামি। চতুর্থ পেসার হিসেবে হার্দিক থাকবে,’’ এক নিঃশ্বাসে বলে যান প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক।
নিঃসন্দেহে, ‘মাস্ট’। অশ্বিন-সামি–দু’জনেই ‘মাস্ট’। কিন্তু হালফিল ইতিহাস আবার বলে, অবিচার এই দুইয়ের সঙ্গেই অধিকাংশ সময় হয়েছে। সামিকে এশিয়া কাপে প্রায় খেলানোই হয়নি। যতই ফাইনালে লঙ্কাকাণ্ড করে ভারত এশিয়া-জয়ীর রাজতিলক পরুক। আর অশ্বিন! অক্ষর প্যাটেলের না লেগে গেলে চিপকের ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখতে হত!
আপাত-দৃষ্টিতে সৌরভের মনে হয়, ভারত ভাল পারফর্ম করবে বিশ্বকাপে। রোহিত শর্মারাই তাঁর ফেভারিট। যুক্তিও দেন যথাযথ। বলে দেন, ‘‘টিমটা একদম ঠিক সময়ে ছন্দে ফিরেছে। এশিয়া কাপ জিতল। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতল। ভাল অধিনায়কত্ব করছে রোহিত। বুমরা পুরো ফিট হয়ে গিয়েছে। সিরাজ ফর্মে আছে। তবে ব্যাটারদের রান করতে হবে। বিরাট-রোহিতরা রান করলে, ভারতকে থামানো কঠিন হবে।’’ সমান্তরাল ভাবে বিশ্বকাপের গুরুত্ব নিয়ে বলেন। এই বিশ্বকাপ একদিকে যেমন ওয়ান ডে ক্রিকেটের অস্তিত্বরক্ষার অগ্নিপরীক্ষা, ঠিক তেমন অধুনা বিশ্বক্রিকেটের ‘ফ্যাব ফাইভ’-এর চার জনের সম্ভাব্য শেষও বটে। বাবর আজম খেলবেন পরের বিশ্বকাপ। কিন্তু বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, জো রুট কিংবা স্টিভ স্মিথ–এঁরা চার বছর আর নামবেন কি? ‘‘কী সব প্লেয়ার এরা, তাই না?’’ অস্ফুটে বলে ফেলেন সৌরভ। সে ঠিক, কিন্তু এই পাঁচের মধ্যে এবার জিতবেন কে? ‘‘বিরাট ভাল করবে। আর বাবর। বাবরেরও ভাল করার সম্ভাবনা প্রবল।’’ বাবরের মতো বাবরের টিম নিয়েও যথেষ্ট সম্ভ্রমের ছোঁয়া পাওয়া যায় সৌরভের গলায়। যিনি বিশ্বাস করেন, আমেদাবাদে চাপে পড়লেও সার্বিক ভাবে বিশ্বকাপে ভাল করবে পাকিস্তান। তা সে যতই শাহিন শাহ আফ্রিদিরা দু’টো প্রস্তুতি ম্যাচেই ধরাশায়ী হন। যতই নাসিম শাহ না থাকুন। ‘‘আমেদাবাদে এক লক্ষ লোকের সমর্থনের চাপ নিতে হবে পাকিস্তানকে। যা সহজ হবে না। কিন্তু তার পরেও ওরা ভাল টিম। আমার মতে, ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ভারতের সঙ্গে ওরাও সেমিফাইনাল যাবে।’’ এবং বলতে-বলতে হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে যেন, কোথা থেকে যেন মনে পড়ে
চিপক পিচ। ‘‘পিচ কেমন হচ্ছে?’’ উৎসুক প্রশ্ন আসে।
চিপক সাধারণত ঘূর্ণি-বন্ধু হয় বলতে ছিটকে আসে এবার আশঙ্কা। সম্পূর্ণ কথোপকথনে প্রথম বারের মতো।
‘‘না, না। টার্নার করা যাবে না। টার্নার হলে ঝামেলা আছে। অস্ট্রেলিয়ার স্পিনাররা কিন্তু মন্দ নয়। ব্যাটিং ট্র্যাক হলে বরং ভাল।’’ আর টস জিতলে? ব্যাটিং না বোলিং? ‘‘ব্যাটিং, ব্যাটিং। চেন্নাইয়ে অসম্ভব গরম।’’
শুনবেন রোহিত? নেবেন পূর্বসুরির ‘মন্ত্রগুপ্তি’? নিলে ভাল। মানলে ভাল। পঞ্চাশ পেরিয়েও তো ভদ্রলোকের ক্রিকেট মেধার লয়-ক্ষয় ঘটেনি এখনও, শ্রদ্ধায় বিশ্ব এখনও নতজানু হয় তাঁর তিন অক্ষরের পদবী শুনলে। গাঙ্গুলি!